স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ
- প্রকাশের সময় : ০৮:১৮:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
- / ৮১১ বার পঠিত
ঢাকা: স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের এক ধরনের গতিধারা (প্যাটার্ন) দেখা যাচ্ছে দেশটিতে। তীব্র চাপের মুখে রয়েছে নিরপেক্ষ গণমাধ্যম। হত্যা করা হয়েছে কয়েকজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও প্রকাশককে। কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করার ওপর আইনগত নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে এনজিওসমূহ।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৫/১৬-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব বলা হয়েছে। ৪০৯ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতা ও দেশের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা। বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি, নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতা, মৃত্যুদন্ড ও আইসিটি’র বিচার প্রক্রিয়া, ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ অনুচ্ছেদের ভূমিকায় বলা হয়েছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলা হলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে অন্তরীণ হন শত শত বিরোধী দলীয় সমর্থক। প্রায়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারণে এসব করা হয়েছে। ৯ জন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও প্রকাশকের ওপর হামলা হয়েছে। এদের পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেছেন। ৪০ জনেরও বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারী থেকে মার্চের মধ্যে বিরোধী দল বিএনপি’র নেতৃত্বে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করে। কয়েক শ’ বাস ও অন্যান্য যানবাহনে হামলা চালানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হামলায় পেট্রলবোমা ব্যবহারের অভিযোগ উঠে। বহু যাত্রী এতে হতাহত হয়। কিন্তু এসব হামলায় সরাসরি জড়িত কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। পুলিশ বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে আটক করে অগ্নিসংযোগের দায়ে অভিযুক্ত করে। এদের মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রয়েছেন। ওই সময় প্রায়ই কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হতো। বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীকে বহুদিন এমনকি মাসখানেক আটক রেখে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এদের কারও বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দেশটিতে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে এক ইতালিয়ান ত্রাণকর্মী ও এক জাপানি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বন্দুক হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে গেছেন এক ইতালিয়ান ডাক্তার। জুলাইয়ে চুরির দায়ে প্রকাশ্যে সামিউল ইসলাম রাজন নামে ১৩ বছরের একটি শিশুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এতে দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয়। শিগগিরই সরকার এ হত্যার ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত অন্তত ১৬ জনের বিচার গত বছরের শেষ পর্যন্ত চলছিল। তবে স্বাধীনতাপন্থিদের হত্যাকান্ডের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা: কর্তৃপক্ষের সমালোচনাকারী নিরপেক্ষ গণমাধ্যমগুলো তীব্র চাপে পড়েছে। অক্টোবরে সরকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে দেয়, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেয়া হলে শাস্তি দেয়া হবে। এ দু’টি পত্রিকা তাদের সমালোচনামূলক অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিল। নভেম্বরে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করে যে, সংসদের সমালোচনা করায় দুর্নীতি-বিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবির নিবন্ধন বাতিল করা উচিত। ঢাকার একটি আদালত নাগরিক সমাজের ৪৯ জন সদস্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে। এই ৪৯ জন বিচার প্রক্রিয়াকে অন্যায্য বলে সমালোচনা করেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান ও অন্যান্য যোগাযোগের অ্যাপ্লিকেশন নভেম্বরে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এটি নিষেধাজ্ঞা আরোপের শামিল।
ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করায় ব্লগারদের ওপর হামলা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, উগ্রপন্থিরা ওই হামলা চালিয়েছে। ফেব্রুয়ারীতে চাপাতি হাতে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে অভিজিৎ রায়কে। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বেঁচে যান। আগস্টে ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় নীল ও অনন্ত বিজয় দাস নামে আরও তিন ব্লগারকে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে, ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের এক প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আরেক প্রকাশক ও দুই ধর্মনিরপেক্ষ লেখক হামলায় বেঁচে যান। ব্লগার ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারি কর্তৃপক্ষ।
গুম: সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বহু মানুষকে আটক করেছে। কিন্তু পরে তাদেরকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালিত একটি জরিপে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে অন্তত ৪৩ জন ব্যক্তি গুম হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন নারীও রয়েছেন। ছয়জনকে পরে মৃত পাওয়া গেছে। চারজনকে আটক করে পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পাঁচ জনকে পুলিশের হেফাজতে পাওয়া গেছে। বাকি ২৮ জনের সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ৭ ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আটক র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচার অব্যাহত রয়েছে। এ মামলার বাইরে অন্য ঘটনায় জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তাদের কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার: পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের প্রচলন অনেক বেশি। নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করার ঘটনা বিরল। মার্চে, জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষাকবজ নিয়ে নালিশ জানিয়েছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ যুদ্ধাবস্থায়, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জরুরি অবস্থার সময় করা নির্যাতন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এ সময় জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ও বেসামরিক প্রশাসনের নির্দেশে নির্যাতন হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম: জানুয়ারিতে সরকারের জারিকৃত নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষের সফর ও অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ‘ইন্ডিজেনাস’ জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সরকারের বাধ্যবাধকতা, বৈষম্য থেকে মুক্তি, স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আয়োজন ও সংগঠন করার স্বাধীনতার লঙ্ঘন ওই নির্দেশনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা: বাংলাদেশ জাতীয় নারী আইনজীবী সমিতির মতে, জানুয়ারী ও মে মাসের মধ্যে ২৪০টিরও বেশি ধর্ষণের অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, জ্ঞাত ধর্ষণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে, তবে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। সময়োপযোগী ও কার্যকরী তদন্তের অভাবের কারণেই এমনটি ঘটছে। অনেক নারী ও মেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্ষণের ঘটনা জানাতে অনাগ্রহী। ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়েদের প্রমাণ করতে হয়, তাদের ওপর জোর প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েও তাদের যেতে হয়।
মৃত্যুদন্ড: সামিউল আলম রাজন হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত ছয়জন সহ বিভিন্ন মামলায় অন্তত ১৯৮ জনকে ফাঁসির সাজা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ঐশী রহমান, যিনি ২০১৩ সালে নিজের পিতা-মাতাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির সাজা পান। তার আইনজীবীদের যুক্তি, কথিত খুনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম। তাই তার ফাঁসির সাজা হতে পারে না। তবে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ঐশীর বয়স ১৮ ছিল বলে উপসংহার টানা হয়েছে। আদালত ওই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ঘটনা তদন্তে প্রতিষ্ঠিত দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আরও চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালিতে গুরুতর অনিয়ম ও ন্যায়বিচারের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এ আদালতের বিচারিক এখতিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২৪ ফেব্রুয়ারী বুধবার তাদের এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ২০১৫ সালে বিশ্বের ১৬০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার খর্ব হওয়ার এক ধরনের গতিধারা পরিলক্ষিত হয়েছে। সংস্থাটির মহাসচিব সলিল শেঠি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনার অধিকার হুমকির মুখে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমাদের অধিকারই নয় আমাদেরকে রক্ষা করার আইনকানুন ও ব্যবস্থাও হুমকির মুখে।’ (দৈনিক মানবজমিন)