নিউইয়র্ক ০৬:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

দুর্বল হয়েও হামাস কেন যুদ্ধ করে!

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:৩৭:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩
  • / ৬৬ বার পঠিত

মোহাম্মদ আবুল হোসেন : তারা এখন ইসরাইলের ক্ষোভের আগুনের মুখে। দেশটির নেতারা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। তারা গাজা উপত্যকাকে নির্জন দ্বীপে পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন। এই প্রবল সামরিক শক্তির কাছে গাজা উপত্যকা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ সময়ে এসে বিশ্ববিবেকের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সব ফিলিস্তিনি। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কোনো পক্ষকে উস্কানি না দিয়ে, তাদেরকে নিবৃত করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন-

গাজা উপত্যকায় যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস ইসরাইলে আকস্মিকভাবে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ চালিয়েছে। এতে ইসরাইলের কমপক্ষে ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তাতে কমপক্ষে ২৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

এই লেখা যখন পাঠকের হাতে তখন এই সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসতি গাজা উপত্যকাকে ‘নির্জন দ্বীপে’ পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হামাস যে হামলা চালিয়েছে, তা নিন্দনীয়। পশ্চিমা বিশ্বসহ সবাই এ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে, জানানো উচিত। কিন্তু হামাস জানে ইট মারলে তাদেরকে জবাবে কী হজম করতে হবে। তা জানার পরও দুর্বল একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে দশকের পর দশক, তারা কেন এমন হামলা চালাতে গেল? প্রশ্নটি এ সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের কাছে অতি পবিত্র, সম্মানের আল আকসা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করেছেন ইসরাইলের অতি উগ্রপন্থি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতমার বেন-গাভি। তিনি কমপক্ষে এক হাজার উগ্রপন্থি বসতিস্থাপনকারীকে সঙ্গে নিয়ে দখলীকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল আকসা চত্বরে প্রবেশ করেন গত জুলাইয়ে। একবার দু’বার নয়, এক বছরের মধ্যে এটা তার তৃতীয়বার মুসলিমদের এই পবিত্র স্থানে প্রবেশ। এই পবিত্র স্থানে তিনি প্রবেশ করে মুসলিমদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি গাজার অধিবাসীদের উস্কানি দিয়েছেন। ইসরাইল দখল করা গাজা উপত্যকা, পশ্চিমতীর, নাবলুসে প্রতিনিয়ত বসতি সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। তারা গাজা সহ এসব স্থানকে পুরোপুরি দখল করে নিতে চায়।

এ জন্যই সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি নিজেদের জমিতে যখন গাজার অধিবাসীরা কোনো সবজি, কোনো কৃষিকাজ করতে যান, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন নেমে আসে। এখানে ২০১৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারিতে রিলিফওয়েবে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট উল্লেখ করার মতো। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি কৃষকরা অভিযোগ করেন, তাদের কৃষিজমিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিমান থেকে হার্বিসাইডস ছিটানো হয়েছে ৮,২১ এবং ২৩ তারিখে। হার্বিসাইড হলো কোনো ফসলের ক্ষতি করার জন্য সেখানে অন্য বীজ ছড়িয়ে দেয়া। গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলের মধ্যে সীমান্ত বেড়া থেকে ২০০ মিটার পশ্চিমে কৃষিজমিতে এমন অত্যাচার চালায় ইসরাইল। গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থল থেকে দক্ষিণে, আল বুরেইজ শরণার্থী শিবির থেকে পূর্বে খুজা’আ পর্যন্ত এভাবে হার্বিসাইডস স্প্রে করা হয়। ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের জানিয়ে দেয় যে, সীমান্ত বেড়া থেকে ১০০ মিটার দূরের জমিতে কৃষিকাজ করতে পারবেন তারা। কিন্তু ওই সময়ে বাতাসের গতি অনেক বেশি থাকার কারণে হার্বিসাইড ছড়িয়ে পড়ে আরও বিস্তৃত কৃষিজমিতে। এরপর একইভাবে বছরে একবার বা দু’বার এভাবে হার্বিসাইড স্প্রে করে ইসরাইল। এর আগের বছরগুলোতে ফিলিস্তিনিদের সবজি ক্ষেত বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেয় তারা।

অহরহ দখলীকৃত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালায় ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। এমনকি গাজার নাগরিকরা তাদের জমিতে পর্যন্ত যেতে পারেন না বসতিস্থাপন-কারীদের অত্যাচারে। এসব বিষয়ে হামাস বা ফিলিস্তিনি নেতারা বার বার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের কথায় কান দেয়নি। দশকের পর দশক ধরে এভাবে নিষ্পেষিত হতে হতে হামাস শেষ পর্যন্ত আকস্মিকভাবে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা চালিয়েছে শনিবার। এমন অবস্থায় হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ বলেছেন, সময় এসে গেছে শত্রুদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, পরিণতি ভোগ করা ছাড়া তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। তারা গাজায় যে নির্যাতন, নিষ্পেষণ চালু করেছে তা পশ্চিমতীর ও জেরুজালেমে ছড়িয়ে পড়বে।

দ্য নিউ আরব অনলাইন ২০২০ সালের ২৮শে অক্টোবর প্রকাশিত এক রিপোর্টের শিরোনাম- প্যালেস্টাইন্স অলিভ হার্ভেস্ট মারড বাই রাইজিং ইসরাইলি সেটেলার ভায়োলেন্স। অর্থাৎ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে ফিলিস্তিনিদের অলিভ উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অলিভ উত্তোলনের মওসুম তখন। কিন্তু তারা অলিভ তুলতে গেলেই তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। এমনকি দখলদাররা তাদেরকে ক্ষেতে পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না। কয়েক ডজন ফিলিস্তিনির ওপর তারা হামলা করেছে। পশ্চিমতীরজুড়ে ফসল এবং শত শত অলিভ গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশেষ করে রামাল্লাহ, নাবলুস, বেথলেহেজম এবং সালফিট এলাকায় তা বেশি করা হচ্ছে। ইসরাইলের মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ বি’সেলেম এমন কমপক্ষে ২৯টি ঘটনা প্রামাণ্য আকারে ধারণ করেছে। ইসরাইলের দখলদারদের সহিংসতার মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, অলিভ চুরি করে নিয়ে যাওয়া, পুড়িয়ে দেয়া, গাছ কেটে ফেলা বা উপড়ে ফেলা, জমিতে যেতে বাধা দেয়া।

গাজা উপত্যকা তথা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অন্যায় নেই, যা করা হয় না। তারা তাদের নিজদেশের অধিকার পান না। তাদের চোখের সামনে দেশ দখল করে নিচ্ছে ইসরাইল। বিশ্ববিবেক এসব নির্যাতন, নিষ্পেষণ চোখ বন্ধ করে দেখছে। এমন নির্যাতন, নিষ্পেষণ জমতে জমতে তা কালো মেঘের রূপ ধারণ করেছে। অত্যাচারিত এবং দুর্বল মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমতে জমতে তা এক সময় হিংস্রতায় রূপ নেয়। তার প্রেক্ষিতেই হয়তো হামাস ৭ই অক্টোবর আকস্মিক রকেট হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। এমন হামলাকে সমর্থন দেয়া যায় না।

আল জাজিরাতে সাংবাদিক মারওয়ান বিশারা ‘ফ্রম হাব্রিস টু হিউমিলিয়েশন: দ্য ১০ আওয়ারস দ্যাট শকড ইসরাইল’ শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছেন, কয়েকদিন আগেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে হিংসাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন মধ্যপ্রাচ্য হতে হবে ইসরাইলকে কেন্দ্র করে। তার এই মন্তব্যে তারই আরব মিত্র এবং ফিলিস্তিন (যাকে তিনি আঞ্চলিক মানচিত্র থেকে পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলেন) তার ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া আঘাত নিয়ে আসে। সেটা রাজনৈতিকভাবে এবং কৌশলগতভাবেও। ফিলিস্তিনের যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস সুপরিকল্পিতভাবে গাজা থেকে আকাশ, সমুদ্রপথে ও স্থলপথে ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। কয়েক হাজার রকেট ছোড়া হয়। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক এলাকায় এই হামলা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০০ ইসরাইলি নিহত হন।

কয়েক ডজন সেনাকে আটক করে জিম্মি করেছে হামাস। হামাসের এই অপারেশন কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। প্রথমত, দখলদারিত্ব, নিষ্পেষণ চালানো, অবৈধ বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদকে অপবিত্রকরণের কারণে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের সঙ্গে আরবের সম্পর্ককে স্বাভাবিকীকরণ, যা এ অঞ্চলে ইসরাইলের বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করবে। এবং সর্বশেষ কারণ হলো, ইসরাইলের জেলে বন্দি বহু ফিলিস্তিনি। তাদের যতবেশি বন্দিকে বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে সম্ভব মুক্ত করে আনা।

গাজা উপত্যকার হামাস নেতা ইয়াহিয়া আল সিনওয়ার কমপক্ষে দু’দশক ইসরাইলের কারাগারে বন্দি থাকার পর বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মেদ দিয়েইফ অন্য ফিলিস্তিনিদের মতোই প্রিয়জনকে হারিয়েছেন ইসরাইলের নৃশংসতায়। তার এক নবজাতক ছেলে, তিন বছর বয়সী কন্যা ও স্ত্রীকে হত্যা করেছে ইসরাইলিরা। ফিলিস্তিনের প্রথিতযশা সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে ২০২২ সালের ১১ই মে হত্যা করে ইসরাইলি সেনারা। বিভিন্ন তদন্তে দেখা গেছে, তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করা হয়েছে। এ নিয়ে সিএনএন তদন্ত করেছে। তারা বলেছে, আবু আকলেহকে হত্যার নতুন তথ্যপ্রমাণ এসেছে। তাকে যখন গুলি করা হয়েছে, তখন সেখানে কোনো পাল্টা গুলি চলছিল না। কোনো হামাস সদস্যও সেখানে ছিল না। কিন্তু এ ইস্যুতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসরাইল। এসব হিসাবে নিয়ে হামাস বিস্ময়কর হামলা চালিয়েছে। তারা এখন ইসরাইলের ক্ষোভের আগুনের মুখে। দেশটির নেতারা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। তারা গাজা উপত্যকাকে নির্জন দ্বীপে পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন। এই প্রবল সামরিক শক্তির কাছে গাজা উপত্যকা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ সময়ে এসে বিশ্ববিবেকের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সব ফিলিস্তিনি। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কোনো পক্ষকে উস্কানি না দিয়ে, তাদেরকে নিবৃত করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন- যেখানে ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলে, তাদের আত্মসম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সূত্র : মানবজমিন

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

দুর্বল হয়েও হামাস কেন যুদ্ধ করে!

প্রকাশের সময় : ০৫:৩৭:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩

মোহাম্মদ আবুল হোসেন : তারা এখন ইসরাইলের ক্ষোভের আগুনের মুখে। দেশটির নেতারা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। তারা গাজা উপত্যকাকে নির্জন দ্বীপে পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন। এই প্রবল সামরিক শক্তির কাছে গাজা উপত্যকা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ সময়ে এসে বিশ্ববিবেকের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সব ফিলিস্তিনি। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কোনো পক্ষকে উস্কানি না দিয়ে, তাদেরকে নিবৃত করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন-

গাজা উপত্যকায় যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস ইসরাইলে আকস্মিকভাবে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ চালিয়েছে। এতে ইসরাইলের কমপক্ষে ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তাতে কমপক্ষে ২৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

এই লেখা যখন পাঠকের হাতে তখন এই সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসতি গাজা উপত্যকাকে ‘নির্জন দ্বীপে’ পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হামাস যে হামলা চালিয়েছে, তা নিন্দনীয়। পশ্চিমা বিশ্বসহ সবাই এ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে, জানানো উচিত। কিন্তু হামাস জানে ইট মারলে তাদেরকে জবাবে কী হজম করতে হবে। তা জানার পরও দুর্বল একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে দশকের পর দশক, তারা কেন এমন হামলা চালাতে গেল? প্রশ্নটি এ সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের কাছে অতি পবিত্র, সম্মানের আল আকসা মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করেছেন ইসরাইলের অতি উগ্রপন্থি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতমার বেন-গাভি। তিনি কমপক্ষে এক হাজার উগ্রপন্থি বসতিস্থাপনকারীকে সঙ্গে নিয়ে দখলীকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল আকসা চত্বরে প্রবেশ করেন গত জুলাইয়ে। একবার দু’বার নয়, এক বছরের মধ্যে এটা তার তৃতীয়বার মুসলিমদের এই পবিত্র স্থানে প্রবেশ। এই পবিত্র স্থানে তিনি প্রবেশ করে মুসলিমদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি গাজার অধিবাসীদের উস্কানি দিয়েছেন। ইসরাইল দখল করা গাজা উপত্যকা, পশ্চিমতীর, নাবলুসে প্রতিনিয়ত বসতি সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। তারা গাজা সহ এসব স্থানকে পুরোপুরি দখল করে নিতে চায়।

এ জন্যই সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি নিজেদের জমিতে যখন গাজার অধিবাসীরা কোনো সবজি, কোনো কৃষিকাজ করতে যান, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন নেমে আসে। এখানে ২০১৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারিতে রিলিফওয়েবে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট উল্লেখ করার মতো। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনি কৃষকরা অভিযোগ করেন, তাদের কৃষিজমিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিমান থেকে হার্বিসাইডস ছিটানো হয়েছে ৮,২১ এবং ২৩ তারিখে। হার্বিসাইড হলো কোনো ফসলের ক্ষতি করার জন্য সেখানে অন্য বীজ ছড়িয়ে দেয়া। গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলের মধ্যে সীমান্ত বেড়া থেকে ২০০ মিটার পশ্চিমে কৃষিজমিতে এমন অত্যাচার চালায় ইসরাইল। গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থল থেকে দক্ষিণে, আল বুরেইজ শরণার্থী শিবির থেকে পূর্বে খুজা’আ পর্যন্ত এভাবে হার্বিসাইডস স্প্রে করা হয়। ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের জানিয়ে দেয় যে, সীমান্ত বেড়া থেকে ১০০ মিটার দূরের জমিতে কৃষিকাজ করতে পারবেন তারা। কিন্তু ওই সময়ে বাতাসের গতি অনেক বেশি থাকার কারণে হার্বিসাইড ছড়িয়ে পড়ে আরও বিস্তৃত কৃষিজমিতে। এরপর একইভাবে বছরে একবার বা দু’বার এভাবে হার্বিসাইড স্প্রে করে ইসরাইল। এর আগের বছরগুলোতে ফিলিস্তিনিদের সবজি ক্ষেত বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেয় তারা।

অহরহ দখলীকৃত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালায় ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। এমনকি গাজার নাগরিকরা তাদের জমিতে পর্যন্ত যেতে পারেন না বসতিস্থাপন-কারীদের অত্যাচারে। এসব বিষয়ে হামাস বা ফিলিস্তিনি নেতারা বার বার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের কথায় কান দেয়নি। দশকের পর দশক ধরে এভাবে নিষ্পেষিত হতে হতে হামাস শেষ পর্যন্ত আকস্মিকভাবে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা চালিয়েছে শনিবার। এমন অবস্থায় হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ বলেছেন, সময় এসে গেছে শত্রুদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, পরিণতি ভোগ করা ছাড়া তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। তারা গাজায় যে নির্যাতন, নিষ্পেষণ চালু করেছে তা পশ্চিমতীর ও জেরুজালেমে ছড়িয়ে পড়বে।

দ্য নিউ আরব অনলাইন ২০২০ সালের ২৮শে অক্টোবর প্রকাশিত এক রিপোর্টের শিরোনাম- প্যালেস্টাইন্স অলিভ হার্ভেস্ট মারড বাই রাইজিং ইসরাইলি সেটেলার ভায়োলেন্স। অর্থাৎ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে ফিলিস্তিনিদের অলিভ উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অলিভ উত্তোলনের মওসুম তখন। কিন্তু তারা অলিভ তুলতে গেলেই তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা। এমনকি দখলদাররা তাদেরকে ক্ষেতে পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না। কয়েক ডজন ফিলিস্তিনির ওপর তারা হামলা করেছে। পশ্চিমতীরজুড়ে ফসল এবং শত শত অলিভ গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশেষ করে রামাল্লাহ, নাবলুস, বেথলেহেজম এবং সালফিট এলাকায় তা বেশি করা হচ্ছে। ইসরাইলের মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ বি’সেলেম এমন কমপক্ষে ২৯টি ঘটনা প্রামাণ্য আকারে ধারণ করেছে। ইসরাইলের দখলদারদের সহিংসতার মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, অলিভ চুরি করে নিয়ে যাওয়া, পুড়িয়ে দেয়া, গাছ কেটে ফেলা বা উপড়ে ফেলা, জমিতে যেতে বাধা দেয়া।

গাজা উপত্যকা তথা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অন্যায় নেই, যা করা হয় না। তারা তাদের নিজদেশের অধিকার পান না। তাদের চোখের সামনে দেশ দখল করে নিচ্ছে ইসরাইল। বিশ্ববিবেক এসব নির্যাতন, নিষ্পেষণ চোখ বন্ধ করে দেখছে। এমন নির্যাতন, নিষ্পেষণ জমতে জমতে তা কালো মেঘের রূপ ধারণ করেছে। অত্যাচারিত এবং দুর্বল মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমতে জমতে তা এক সময় হিংস্রতায় রূপ নেয়। তার প্রেক্ষিতেই হয়তো হামাস ৭ই অক্টোবর আকস্মিক রকেট হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। এমন হামলাকে সমর্থন দেয়া যায় না।

আল জাজিরাতে সাংবাদিক মারওয়ান বিশারা ‘ফ্রম হাব্রিস টু হিউমিলিয়েশন: দ্য ১০ আওয়ারস দ্যাট শকড ইসরাইল’ শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছেন, কয়েকদিন আগেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে হিংসাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন মধ্যপ্রাচ্য হতে হবে ইসরাইলকে কেন্দ্র করে। তার এই মন্তব্যে তারই আরব মিত্র এবং ফিলিস্তিন (যাকে তিনি আঞ্চলিক মানচিত্র থেকে পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলেন) তার ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া আঘাত নিয়ে আসে। সেটা রাজনৈতিকভাবে এবং কৌশলগতভাবেও। ফিলিস্তিনের যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস সুপরিকল্পিতভাবে গাজা থেকে আকাশ, সমুদ্রপথে ও স্থলপথে ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। কয়েক হাজার রকেট ছোড়া হয়। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক এলাকায় এই হামলা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০০ ইসরাইলি নিহত হন।

কয়েক ডজন সেনাকে আটক করে জিম্মি করেছে হামাস। হামাসের এই অপারেশন কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। প্রথমত, দখলদারিত্ব, নিষ্পেষণ চালানো, অবৈধ বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদকে অপবিত্রকরণের কারণে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের সঙ্গে আরবের সম্পর্ককে স্বাভাবিকীকরণ, যা এ অঞ্চলে ইসরাইলের বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করবে। এবং সর্বশেষ কারণ হলো, ইসরাইলের জেলে বন্দি বহু ফিলিস্তিনি। তাদের যতবেশি বন্দিকে বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে সম্ভব মুক্ত করে আনা।

গাজা উপত্যকার হামাস নেতা ইয়াহিয়া আল সিনওয়ার কমপক্ষে দু’দশক ইসরাইলের কারাগারে বন্দি থাকার পর বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মেদ দিয়েইফ অন্য ফিলিস্তিনিদের মতোই প্রিয়জনকে হারিয়েছেন ইসরাইলের নৃশংসতায়। তার এক নবজাতক ছেলে, তিন বছর বয়সী কন্যা ও স্ত্রীকে হত্যা করেছে ইসরাইলিরা। ফিলিস্তিনের প্রথিতযশা সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে ২০২২ সালের ১১ই মে হত্যা করে ইসরাইলি সেনারা। বিভিন্ন তদন্তে দেখা গেছে, তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করা হয়েছে। এ নিয়ে সিএনএন তদন্ত করেছে। তারা বলেছে, আবু আকলেহকে হত্যার নতুন তথ্যপ্রমাণ এসেছে। তাকে যখন গুলি করা হয়েছে, তখন সেখানে কোনো পাল্টা গুলি চলছিল না। কোনো হামাস সদস্যও সেখানে ছিল না। কিন্তু এ ইস্যুতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসরাইল। এসব হিসাবে নিয়ে হামাস বিস্ময়কর হামলা চালিয়েছে। তারা এখন ইসরাইলের ক্ষোভের আগুনের মুখে। দেশটির নেতারা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। তারা গাজা উপত্যকাকে নির্জন দ্বীপে পরিণত করার হুঙ্কার দিয়েছেন। এই প্রবল সামরিক শক্তির কাছে গাজা উপত্যকা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ সময়ে এসে বিশ্ববিবেকের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সব ফিলিস্তিনি। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কোনো পক্ষকে উস্কানি না দিয়ে, তাদেরকে নিবৃত করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন- যেখানে ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলে, তাদের আত্মসম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সূত্র : মানবজমিন