প্রশংসার খরচ শতকোটি টাকা

- প্রকাশের সময় : ০৭:১৯:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩
- / ৮০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় ৬১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৪ টাকা। আর সংসদ সদস্যরা নির্ধারিত সময়ে না আসায় সংসদের ২২টি অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে সংসদ কার্যক্রম শুরু হতে দেরি হওয়ায় সংসদের ব্যয় হয়েছে ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। এর অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ আট হাজার ৭৭৯ টাকা।
টিআইবিগতকাল রবিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘পার্লামেন্টওয়াচ : একাদশ জাতীয় সংসদ—প্রথম থেকে ২২তম অধিবেশন (জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩)’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একাদশ সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আইন প্রণয়ন, বাজেট ও স্থায়ী কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা করতে দেখা গেছে। সংসদকে কার্যকর করে তুলতে বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ঘাটতি ছিল।
জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কার্যক্রমে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চলতি সংসদের অধিবেশনগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না। একই সঙ্গে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় স্পিকারের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি ছিল। সংসদীয় কার্যক্রমে সদস্যদের অনুপস্থিতি, যথাযথ গুরুত্বসহকারে অংশগ্রহণ না করা, প্রতিপক্ষের মতামত প্রকাশে বিঘ্ন ঘটানো ও মতামত গ্রহণ না করার কারণে কার্যক্রমগুলোর কার্যকারিতা কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি সংসদে অধিবেশন শুরুর তুলনায় বিরতি-পরবর্তী সময়ে কোরাম সংকটের আধিক্য ছিল। অধিবেশনের ৮৪ শতাংশ কার্যদিবস নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বে শুরু হয়। এতে কোরাম সংকটে মোট ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট কর্মঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে, যা কার্যদিবস অনুযায়ী গড়প্রতি ১৪ মিনিট ৮ সেকেন্ড। কোরাম সংকটে মিনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় দুই লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকা। সেই হিসাবে কোরাম সংকটে ব্যয়িত সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ আট হাজার ৭৭৯ টাকা।
টিআইবির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রশংসায় সরকারি দলের সদস্যরা মোট ৬১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট সময় ব্যয় করেছেন। প্রতি মিনিটে ব্যয় দুই লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকার হিসাবে ওই সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ১০০ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৪ টাকা। চলতি সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্যরা তাঁদের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় ১৯.৮ শতাংশ এবং সরকারের প্রশংসায় ১৯.৪ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন। তবে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের সদস্যরাও সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় সময় ব্যয় করেছেন। ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মোট ১৮৬ ঘণ্টা ২৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি দলের সদস্যরা ১৫৬ ঘণ্টা ২৮ মিনিট (৮৬.২%), প্রধান বিরোধী দল ২০ ঘণ্টা ১৮ মিনিট (১১.২%) এবং অন্যান্য বিরোধী দল চার ঘণ্টা ৪৮ মিনিট (২.৬%) আলোচনা করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংসদে পাসকৃত ৫২ শতাংশ বিলের ক্ষেত্রে কোনো সংশোধনী গৃহীত হয়নি এবং ৪৭ শতাংশ বিলে আংশিকভাবে সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। বিলের ওপর প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাব থাকলেও সংশোধনী গ্রহণের ক্ষেত্রে শব্দ সন্নিবেশ ও প্রতিস্থাপনই প্রাধান্য পেয়েছে। বিল পাসের আলোচনাকালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্থাপিত প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে বিরোধী দলের অতীত ইতিহাস, বিলের প্রয়োজনীয়তা, যথেষ্ট যাচাই-বাছাই পূর্বক বিলের প্রস্তাব উত্থাপিত ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে বিলের ওপর প্রদত্ত নোটিশগুলো খারিজ করা হয়েছে। ফলে উল্লেখযোগ্য কোনো সংশোধনী ছাড়াই বিল পাস হয়েছে।
আরো বলা হয়েছে, মাত্র ২৮ মিনিটে সংসদে বিল পাস করা হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। ২২টি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে মোট ১২৪ ঘণ্টা ১৮ মিনিট সময় ব্যয় হয়, যা সংসদ কার্যক্রমের ব্যয়িত সময়ের প্রায় ১৬.৭ শতাংশ। ২০১৯-২০-এ যুক্তরাজ্যে এই হার ছিল প্রায় ৪৯.৩ শতাংশ এবং ২০১৮-১৯-এ ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ। বাজেট সম্পর্কিত ১২টি বিল ছাড়া সংসদে উত্থাপিত মোট বিলের সংখ্যা ১০৮টি (সরকারি বিল ১০৭টি ও বেসরকারি বিল ১টি)। এর মধ্যে পাসকৃত বিলের সংখ্যা ৯৬টি (নতুন বিল ৬৮, সংশোধনী বিল ২৬টি ও রহিতকরণ বিল দুটি)।
চলতি সংসদে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বর্জনের অপসংস্কৃতি থেকে এই সংসদ সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসেছে। বিরোধী দল মাত্র পাঁচবার সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছে। কোরাম সংকটের সময় কমেছে। সংসদ নেতার উপস্থিতি বেড়েছে। আইন প্রণয়নের সময় তুলনামূলক বেশি ব্যয় হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিগত তিনটি সংসদের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলতি সংসদের উন্নতি থাকলেও তা প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও কার্যকর বিরোধী দলের অভাবের কারণে মূলত সংসদ প্রত্যাশিত মাত্রায় ভূমিকা রাখতে পারেনি।’ বরং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদের কার্যকর ভূমিকার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এ জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। কারণ এখন অনেকটা বিরোধী দলবিহীন সংসদ চলছে। বিরোধী দল পরিচয়ধারী যে দলটি এখন আছে, তারা আগের তুলনায় কিছুটা সক্রিয় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করলেও সার্বিকভাবে আত্মপরিচয়ের সংকটে ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক রাবেয়া আক্তার কনিকা ও মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার। উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সূত্র : কালেরকণ্ঠ