ভিসানীতিতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
- প্রকাশের সময় : ০৯:২২:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ৫৫ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা আসে শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর)। যদিও এই নীতির আওতায় কারা পড়েছেন বা ভবিষ্যতে পড়বেন তা নিয়ে রয়েছে নানা অস্পষ্টতা।
এমন এক দিনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করে যেদিন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ১৯তম বক্তব্য প্রদান করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে যারা এর আওতায় রয়েছে, তারা হচ্ছে— বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্য, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
তবে বাংলাদেশই প্রথম নয়, এর আগে আরও কিছু দেশের ক্ষেত্রেও এমন পদক্ষেপ নিয়েছে আমেরিকা। সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র মধ্য আমেরিকার চার দেশের কর্মকর্তাদের টার্গেট করে ভিসানীতি আরোপ করে।
দেশগুলো হচ্ছে, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া এবং এল সালভাদর। এসব দেশের মোট ৩৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। ৩৯ জনের মধ্যে ১০ জন গুয়াতেমালার, ১০ জন হন্ডুরাসের, ১৩ জন নিকারাগুয়ার এবং এল সালভাদরের ৬ জন ছিলেন।যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ঘোষিত ওই নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। এমনকি কারও যদি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থাকে, তাও বাতিল হয়ে গেছে।
তাদের বিরুদ্ধে আনা প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, তারা নিজ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিলেন। এছাড়া দুর্নীতি ও সাংবাদিকদের টার্গেট করার মতো অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এদিকে, বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি। এর সঙ্গে কূটনীতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতিসহ অনেক বিষয় জড়িত। এছাড়া এই ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেললে তা সামাল দিতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হট কেকে পরিণত হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো রোবেল মোল্লা ইত্তেফাককে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অগ্রাধিকার নির্ধারণে আরও স্পেস পাচ্ছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক শক্তিসমূহের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উত্থান আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি ও ভূ-কৌশলগত কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বৃদ্ধি ও চীনের প্রভাব ঠেকাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রচেষ্টা বলয়ের বাইরে নয়। তাই ভিসা নীতিকে বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির হিসেব নিকেশ থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান জার্মানি এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এখানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র একা নয়, এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা আছে। ভিতরের বাইরের প্রতিক্রিয়াগুলো স্পষ্ট হতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। যে কারা আসলে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
তিনি আরও বলেন, যারা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে সামনে রেখে কাজ করে। কিন্তু তাদের মূল বিষয় হলো ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় তাদের অবস্থান এবং নিরাপত্তা। বাংলাদেশকে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এই দুইটি বিষয়ে তাদের পুরোপুরি পক্ষের মনে না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নানা ধরনের চাপ বাড়াবে।
ভিসানীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে বহিঃবিশ্বের সম্পর্কের কোনো তারতম্য ঘটবে কিনা এ বিষয়ে জাগাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক খালিদ কুদ্দুস ইত্তেফাককে বলেন, আমেরিকা যেখানে নিষেধাজ্ঞা দেবে ইউরোপীয়ান দেশ গুলোও সেখানে আসবে না। বাংলাদেশের যাদের ওপর স্যাংশন গুলো দিয়েছে তাদের কারণে যদি আমাদের রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর কোন প্রভাব পড়ে তাহলে দেশ একধরণের সংকটে পড়বো বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর কারণে আমাদের পুরো অর্থনীতির ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক ভালো আছে। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে এ সমস্যা সমাধানের। তবে সরকারের উচিত হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংকট থেকে বেড়িয়ে আসা।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসানীতির বিষয়ে গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়ে। অ্যান্টনি ব্লিংকেন প্রথমে টুইট করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবৃতি প্রকাশ করে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার সংবাদ সম্মেলনেও নতুন ভিসানীতির বিষয়টি তুলে ধরেন।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক