যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করার আহ্বান
- প্রকাশের সময় : ০৯:১৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১০৯ বার পঠিত
সালাহউদ্দিন আহমেদ: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছরের বিতর্কের প্রতিপাদ্য ‘আস্থার পুনঃনির্মাণ এবং বিশ্বব্যাপী সংহতির পুনরুজ্জীবন: আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও জোরদার করে ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং এর আওতাধীন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের মাধ্যমে সকলের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ’ এর আলোকে ‘যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে। বলেন, আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। খবর ইউএনএ’র।
শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণ দেন। অতীতের মতো এবারো তিনি মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেন। এবার নিয়ে তিনি ১৯তম বার জাতিসংঘে ভাষণ দিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে মানুষের আস্থাহীনতা, করোনা মহামারি ও জলবায়ু সঙ্কটের প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য, অর্থায়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, ফিলিস্তিনী জনগণের বৈধ অধিকার অর্জনে ব্যর্থতা, রোহিঙ্গা সমস্যা, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি অর্জনে সহায়তা কামনা, এমডিজি অর্জন, তাঁর সরকারের ভিশন ২০৪১-এর আওতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়া, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরেন।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে চলতি বছরের মার্চ মাসে কাতারের দোহাতে অনুষ্ঠিত এলডিসি-৫ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য অপেক্ষমান দেশগুলোকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের দোহা কর্মসূচির সম্পূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সহ তাঁর সফরসঙ্গীরা জাতিসংঘের মূল অধিবেশনে বসে তাঁর ভাষণ শুনেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মীও বিশেষ পাস নিয়ে অধিবেশন কক্ষের গ্যালারিতে বসে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে চলতি বছর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনাপত্রের ৭৫তম বার্ষিকী পালনের কথা স্মরণ করে বলেন, বিশ্ব মানবতার প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে সকলের জন্য সমতা, ন্যায্যতা, স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি যাতে উন্নয়নশীল দেশের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান সকলের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সকলকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান ও সুবিচার নিশ্চিতকরণে গত এক দশকে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধন করা হয়েছে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে, জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারাবদ্ধ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আমরা সারা বিশ্বের আপামর জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণে অন্যান্য সদস্যগণের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আজ এই অধিবেশনে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই যে, বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে।’
বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ-এর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্থিরতা, বিদ্বেষমূলক এবং উগ্রপন্থী বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। সাম্প্রতিককালে পবিত্র কুরআন শরীফ পোড়ানোর মত জঘন্য অপরাধ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকেই আঘাত করে না, এটি অস্থিরতাকে উসকে দেয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে’।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফিলিস্তিনী জনগণের বৈধ অধিকার অর্জনের পথ এখনও আশার মুখ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে থাকবে’।
রোহিঙ্গা সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুুচূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গত মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচূত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু, পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি বলেন, বাস্তুচূত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। এই নিঃস্ব মানুষের জন্য তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শেষ পর্যায়ে বরাবরের মতোই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর পিতা ‘জাতির পিতা’ ও বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কথা তুলে ধরে বলেন, সেদিন আমার মা, আমার তিন ছোট ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূ, চাচাসহ পরিবারের মোট আঠার সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট বোন এবং আমি বিদেশে থাকায় সেই বর্বরতা থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। এর আগে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লাখ দেশবাসীকে হত্যা করা হয়, দুই লাখ নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। আমি নিজে নিপীড়িত এবং যুদ্ধ ও হত্যার নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যুদ্ধ, হত্যা, অভ্যুত্থান ও সংঘাতের ভয়াবহতার কারণে মানুষ যে বেদনা ও যন্ত্রণা সহ্য করে তা অনুভব করতে পারি। তাই, আজ আপনাদের সকলের কাছে, বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার আবেদন, যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন’।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের শেষ কর্মদিবসে শুক্রবার কর্মব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। এদিন তিনি জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার পর বাংলাদেশ মিশনে সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর তিনি সন্ধ্যায় তাঁর সম্মানে নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধানায় যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শনিবার সকালে নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যান। তিনি ২৩ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অবস্থান করবেন। প্রধানমন্ত্রী ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০.৪৫ টায় (ওয়াশিংটন সময়) লন্ডনের উদ্দেশে ওয়াশিংটন ডিসি ত্যাগ করবেন এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে লন্ডন পৌঁছাবেন। প্রধানমন্ত্রী ৩ অক্টোবর রাতে লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন এবং ৪ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১২টায় (বাংলাদেশ সময়) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন বলে সরকারী সূত্রে জানা গেছে।