বাংলাদেশের সংবিধান, চুল পরিমাণ না নড়ার ঘোষণা ও বাস্তবতা

- প্রকাশের সময় : ০২:১৮:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৩
- / ৭৮ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : বাংলাদেশের সংবিধান অনেক বড় ও ব্যাপক। বস্তুত: জাতিসংঘের আওতাধীন পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের মধ্যে যে কয়টি দেশের অনেক বড় ও ব্যাপক সংবিধান আছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
উল্লেখ্য, সাইজের দিক দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চেয়ে অন্তত: ৫/৬ গুণ বড়। মাত্র ৫২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে ১৭ বার। অথচ ১৭৭৬ সালে Proclamation of Independence তথা স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৪৭ বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২৭ বার সংবিধান সংশোধন করেছে। বাংলাদেশে ব্যক্তির জন্য একাধিকবার সংবিধান সংশোধনী করা যেমন একটি কালো দিক আবার সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে একাধিকবার সংবিধান সংশোধনী করা একটি পজিটিভ দিক। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কাঁটাছেড়া করে সংবিধানকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে এখন সংবিধান সঠিকভাবে অনুসরণই করা যাবে না সংবিধানের কোনো না কোনো প্রভিশন মোটামুটি না ভেঙ্গে! নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমান সরকারের একাধিক মন্ত্রী বারংবার বলে চলছেন আমরা সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়বো না। শুনে তো ভাল লাগার কথা যে তারা সংবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, এ থেকে এক চুল পরিমাণ না নড়তে বদ্ধপরিকর। আসলে উনাদের সংবিধান অনুসরণের ইতিহাস, নমুনা ও বাস্তবতা কী? এটা কি তাদের মনের কথা? সংবিধানের অন্যান্য প্রভিশনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী ও কোথায়? জনগণ তো চায়ই সরকার ও মন্ত্রীরা পুরো সংবিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। তাঁরা কি তা বাস্তবে করছেন? এক পলকে গোটা সংবিধান ঘাটলে অন্তত: অর্ধডজন উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে সরকার সংবিধান ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে অবস্থান করছে যোজন যোজন দূরে, এমনকি মাইল কা মাইল দূরে! ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার কথা সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে। একই অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের দায়িত্ব, তদন্ত ও ক্ষমতা এবং কীভাবে, কখন ও কোথায় রিপোর্ট পেশ করতে হবে তার সুন্দর বিবরণ দেয়া আছে।
অথচ ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার বিধান ১৯৮০ সালে সংবিধানে সন্নিবেশিত করার ৪৩ বছর হতে চললো এখন পর্যন্ত ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। তাহলে এই বিধান সংবিধানে রাখার দরকারই বা কী? বর্তমান সরকার প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় তারা এই পদ প্রতিষ্ঠা করলেন না অথচ এটি করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুযায়ী সুপ্রীমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতার বিধিমালা প্রণয়ন করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো সরকারই এই বিধিমালা প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কেন করেননি তা সহজেই অনুমেয়।
নিম্ন আদালতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) এর কঠিন প্রতিযোগীতামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে মেধাবীদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিভিন্ন দিকের যোগ্যতার কঠোর বিধিমালা প্রণয়ন করলে প্রখর মেধাবী, প্রজ্ঞাবান, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দল-নিরপেক্ষ লোকদেরকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পথ সুগম হতো। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকার পরও অন্যান্য সরকারের মতো বর্তমান সরকারও গত ১৫ বছরে যোগ্যতার বিধিমালা প্রণয়ন করেনি। শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় ছাড়া বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন। জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তিও সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করার বাধ্যবাধকতা আছে। বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরে অসংখ্য চুক্তি করেছে অনেক বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে। এর কয়টা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করত: সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করেছে? অথচ এটা করা সরাসরি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সংবিধানের তৃতীয় তফশিলের অন্তর্গত ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নেন। আর সেই শপথে যেসব শব্দগুলো তারা মুখে উচ্চারণ করেন এবং পরে তাদেরকে শপথনামায় দস্তখত করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো “…….এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।” এবার যদি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়দের শপথের বাক্যগুলো মিলিয়ে দেখেন বা তুলনা করেন তাদের দেয়া বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যের সাথে তখন দেখবেন সংবিধানে লিখিত তাদের শপথের বাক্য থেকে তারা কত দূরে। অহরহ অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিরোধী দল ও তাদের নেতাকর্মীদের বিরোদ্ধে তারা কতো ধরনের দৃশ্যত আপত্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের এমন আচরণ তাদের সরকারি সিদ্ধান্তে ও অনুমোদনে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। আর অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কথা বলা ও সিদ্ধান্ত নেয়া তো শপথ ভঙ্গ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে অবজ্ঞা করার শামিল।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সাংবিধানিক নির্দেশ। অপরদিকে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদ বলেছে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হবে। এবার সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ ও ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত যথাক্রমে “জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ” এবং “প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে” শব্দগুলোর সাথে হাল আমলের নির্বাচনগুলোর তুলনা করুন আর মনকে প্রশ্ন করুন কোথায় সংবিধান ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আর কোথায় বাস্তবতা! উপরের অর্ধ ডজনের মতো আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে সরকার সংবিধান ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। অথচ ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এমতাবস্থায় মন্ত্রীরা যখন বলেন আমরা সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়বো না, তখন তা শুনে হাসি পায়।
এগুলো যে ভাগাড়ম্বর ও অতিকথন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার বিশ্বাস সংবিধান যদি নিজে কথা বলতে পারত তাহলে হয়তো কেঁদে কেঁদে বলতো – নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে মন্ত্রী মহাশয়রা শুধু বলেন এক চুল পরিমাণ নড়বো না কিন্তু বাস্তবে আমার বিভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুসরণে আপনারা শুধু চুল পরিমাণ নয় বরং অবস্থান করছেন যোজন যোজন দূরে, এমনকি মাইল কা মাইল! জাতি আজ গভীর সংকটের দ্বারপ্রান্তে। পরাশক্তিগুলোর দৃষ্টি পড়েছে আমাদের দেশে। নিজেরা সমাধান করতে না চাইলে আস্তে আস্তে এক সময় তা নিজেদের সমাধানক্ষমতার বাহিরে চলে যেতে পারে। অতীতে এমন নজীর আছে। সংবিধান মানুষের জন্য। মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। ভাগাড়ম্বর ও একগুয়েমি ছাড়েন। বাস্তবতা মেনে নিয়ে মন বড় করে দেশের কথা চিন্তা করে আলোচনার টেবিলে বসুন। সংবিধানকে ঢাল বা বাঁধা হিসেবে দাঁড় করাবেন না। স্বদিচ্ছা থাকলে সংবিধান মোটেই কোনো বাঁধা নয়। সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী এর জ্বলন্ত প্রমাণ। চিন্তা করতে পারেন – বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একসাথে বসে এই দুই সংশোধনী পাশ করেছে! এটি সম্ভব হয়েছিল বৃহৎ দু’দলের স্বদিচ্ছা থাকার ও ঐক্যমত হবার কারণে। ফেলে আসা দিনের সেই সোনালী ঐতিহ্য জাতি আবার দেখতে উদগ্রীব। নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার। সূত্র : মানবজিমন