চাহিদামত কাঁচামাল পেলে গার্মেন্টসের মতো প্রবৃদ্ধি আনবে স্বর্ণশিল্প
- প্রকাশের সময় : ০৫:৪৮:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ জুলাই ২০২৩
- / ৫৫ বার পঠিত
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার : পর পর দু’বছর জুয়েলারি মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে দেশের জুয়েলারি শিল্প নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নতুন উদ্যম তৈরি হয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের মাঝে। এ শিল্পে এখন রপ্তানির নতুন দিগন্ত হাতছানি দিচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পের মতো জুয়েলারিকেও দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়ের খাতে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখছেন এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা। তবে উপযুক্ত মূল্যে জুয়েলারির কাঁচামাল আমদানি ও অলংকার রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত পরিবর্তন দরকার আছে বলে মনে করেন অলংকার ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশে যেহেতু স্বর্ণের কোনো খনি নেই তাই কেবলমাত্র কাঁচামাল আমদানির সহজ প্রক্রিয়াই এ শিল্পকে চাঙ্গা রাখতে পারে। তবে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষিতে অলংকারের কাঁচামাল আমদানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে দাবি করেন জুয়েলারি সংশ্লিষ্টরা। একসময় বাংলাদেশের স্বর্ণশিল্প ম্লান হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা করার মাধ্যমে সেটি রক্ষা করেছে। তবে এখন স্বর্ণশিল্পের উদ্যোক্তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। গোল্ড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও স্বর্ণশিল্পের জন্য স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৪৪ লাখ মানুষ।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে বাজুসের একাধিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ চেরাচালান বন্ধের জন্য স্বর্ণ নীতিমালা সংশোধন করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বাজুসের সভাপতি সায়েম সোবহান আনভীর। সরকার সঠিকভাবে সহায়তা করলে এই শিল্প দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পে পরিণত হবে বলে মনে করেন আনভীর। এছাড়াও তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দেশে একটি গোল্ড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি আয়োজিত রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটিতে ‘বাজুস ফেয়ার ২০২৩’উদ্বোধনকালে স্বর্ণ শিল্পের জন্য বিশেষায়িত অঞ্চল ও প্রয়োজনীয় নীতির আশ্বাস দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেন নিয়ন্ত্রক হিসেবে যা করণীয় সরকার তাই করবে,অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির মাধ্যমে পরিচালিত হবে এই শিল্প। সঠিকভাবে কাঁচামাল সরবারহ করে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করা গেলে স্বর্ণ শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে
‘বাজুস ফেয়ার-২০২৩’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।নৈপুণ্যে সুনাম কুড়িয়েছে আমাদের স্বর্ণশিল্পীরা
স্বর্ণশিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহ সভাপতি ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ বলেন, জুয়েলারি শিল্প বর্তমানে পোশাক শিল্পের মতোই একটি সম্ভাবনাময় খাত। কারণ আমাদের স্বর্ণ শিল্পীরা বিশ্বসেরা। হালকা ওজনের স্বর্ণলংকার তৈরিতে আমাদের শিল্পীদের সক্ষমতা ও দক্ষতা অনন্য। হালকা ওজনের অলংকারের চাহিদা সবসমই বেশি, কারণ ওজন হালকা হওয়ার কারণে এটি সকল শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকে। ইতোমধ্যে আমাদের শিল্পীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের কার্য নৈপুণ্যতার জন্য সুনাম কুড়িয়েছে। আমাদের দেশের মত স্বর্ণশিল্পী ভারত ও দুবাইয়েও নেই।
অলংকারের মান ও বিদেশি অলংকারের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ প্রসঙ্গে বাজুসের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মুক্তা ঘোষ বলেন, আমাদের অলংকারের মান এখন সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ভারতের চেয়েও অনেকাংশে মানসম্পন্ন। কিন্তু বিদেশি পণ্যের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ সবসময় বেশি। যার কারণে আমাদের অলংকার কতটা মানসম্পন্ন সেটি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার জন্যও উদ্যোগ নেয়া দরকার। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প যেমন বিদেশে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে তেমনি আবার বিদেশি নামকরা ব্রান্ডের বিভিন্ন পোশাক আমরা আমদানি করে থাকি। সুতরাং বিদেশি অলংকারের প্রতি আগ্রহ থাকা এ শিল্পের জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নয়।
কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতাই বড় প্রতিবন্ধকতা
হান্নান আজাদ বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বাজার দরে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছি না। বিদেশে দেশি স্বর্ণলংকার রপ্তানি করা স্বপ্ন ছিল। আমিই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রথম স্বর্ণালংকার রপ্তানি করি। বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্পটা আমার কাছে অনেকটা পোষাক শিল্পের মতো। আমি মনে করি শুধুমাত্র এয়ারপোর্টে যেটুকু স্বর্ণালংকার নিয়ে আমি বিদেশ যাচ্ছি সেটা ডিক্লারেশন দিয়ে বিদেশে সেটা বিক্রি করে সমপরিমান ওজনের সলিড গোল্ড নিয়ে আসতে পারি এরপর বাকিটা নগদ ডলারে যদি আনা যায় তাহলে দেশ লাভবান হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এই নিয়মে ব্যবসা করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। আমি বাংলাদেশ অর্নামেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ করেছি কিন্তু প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমোদনের অভাবে বিদেশে এক্সপোর্ট করতে পারছি না। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পে ২৮ লক্ষ লোক কাজ করছে।
বাজুসের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মুক্তা ঘোষ জানান, বাজুসের বর্তমান সভাপতি সায়েম সোবহান আনভীর কাঁচামাল আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা ও রপ্তানি জটিলতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দরকার ব্যাংক ঋণ
বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ জানতে চাইলে হান্নান আজাদ জানান, অনেকে মনে করেন জুয়েলারি শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে, কিন্তু আমি মনে করি জুয়েলারি শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশি বিনিয়োগই জুয়েলারি খাতে পর্যাপ্ত। এখানে এখন কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব জটিলতা দূর হলেই এ শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি থাকবে না। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতে জুয়েলারি এখন একটি বৃহত্তম শিল্প। তারা এ শিল্পের মাধ্যমে প্রচুর রাজস্ব পাচ্ছে।
তবে হান্নান আজাদের বক্তব্যে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করেন বাজুসের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মুক্তা। তিনি মনে করেন, আমাদের জুয়েলারি শিল্প এখনও এতটা উন্নত শিল্পে পরিণত হতে পারেনি। তবে সরকারের নীতিগত সহায়তা ও ব্যাংক ঋণের সুবিধা পেলে তৈরি পোশাক শিল্পের ন্যায় জুয়েলারিও দেশের বৃহত্তম শিল্পে পরিণত হবে। অন্যান্য সকল শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ প্রদান করলেও এ শিল্পে ব্যাংক কোন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে না। আমরা চাই ব্যাংক তাদের নীতিমালা অনুসরণ করেই আমাদের ঋণ প্রদান করুক, জামানতবিহীন ঋণ কিংবা দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়ে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরাও ঋণ নিতে চাই না।
জুয়েলারি শিল্পে দেশীয় বা বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন এ শিল্পে বিনিয়োগের ব্যপারে এখনও আমরা যথাযোগ্য ধারণা নিতে পারিনি। এ শিল্পের পরিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের আরো অধ্যয়ন করতে হবে। আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়েনের পর আমরা এ শিল্পের বিনিয়োগের ব্যাপারে সঠিক ধারণা নিতে পারবো।
ভ্যাটের জটিলতাই রপ্তানির জন্য বাধা
অলংকার রপ্তানির প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাজুস সহ সভাপতি হান্নান আজাদ বলেন, আমাদের দেশীয় অলংকার বিদেশে রপ্তানির চেষ্টা করতে আমরা কোন রকম কার্পণ্য করছি না। এখানে রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে। আমরা সরকারকে বার বার অনুরোধ করছি। রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব সংক্রান্ত এ জটিলতা যদি উঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে আমারা অলংকার রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আরোহণ করতে পারবো। গত দু’বছরের আমাদের জুয়েলারি মেলায় অনেক বিদেশি দর্শনার্থী এসেছে। তারাও আমাদের উদ্যাগের প্রশংসা করেছে।
হান্নান আজাদের বক্তব্যে একমত পোষণ করে বাজুসের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মুক্তা ঘোষ বলেন, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সুবিধা ও ভ্যাটের জটিলতা দূর করতে পারলেই আমরা পুরোদমে বিশ্বব্যাপি আমাদের অলংকারকে ছড়িয়ে দিতে পারবো।
২০২৩ সালে ভালো কিছু হবে জুয়েলারি শিল্পে
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বর অফ কমার্স ইন্ডাস্টি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে জুয়েলারি শিল্পে চলমান অবস্থা ও সমস্যা গুলো নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়ালার সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন কাচাঁমাল আমদানি ব্যতিত এ শিল্পে অন্য কোন সমস্যা নেই। করোনা মহামারীর পর শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রির্জাভ সংকট দেখা দিয়েছে। যার কারণে আমরা এলসি করে পর্যাপ্ত কাঁচামাল আমদানি করতে পারছি না। তবে ২০২৩ সালে জুয়েলারি শিল্পে ভালো কিছু হবে বলে আমি আশাবাদী।
রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন জটিলতা আছে কিনা জানতে চাইলে বাজুস সাধারণ সম্পাদক বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের কোন জটিলতা নেই। যেহেতু আমাদের কোন খনি নেই তাই আমদানি করতে পারলেই অটোমেটিক রপ্তানি হবে। শুধুমাত্র স্বর্ণ নয়, যেকোন পণ্যই রপ্তানির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সবসময় উৎসাহ দেয়া হয়। এমনকি রপ্তানিতে উৎসাহ দেয়ার জন্য সরকারের প্রণোদনা সুবিধাও রয়েছে।
ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে আগারওয়ালা বলেন, আমি নিজেও একটি ব্যাংকের পরিচালক, সুতারাং আমি বলবো ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে কোন প্রতিবদ্ধকতা নেই। অনেকে হয়ত বিষয়টি ভালোভাবে না জানার কারণে এমনটা বলে থাকে। ব্যাংকে আমাদের যথেষ্ঠ সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে দেশীয় অলংকারের বাজার নিয়ে বাজুস সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটি মানুষের আগ্রহ ও দেশপ্রেমের ব্যাপার। সাধারণ ক্রেতারা যদি নিজের দেশের পণ্যের প্রতি আগ্রহী না হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের কিছু করার থাকবে না। তবে এতে সচেতনতার একটি ব্যাপার তো অবশ্যই আছে। তবে আমাদের দেশে দিন দিন বিদেশি পণ্যের আমদানি কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই আমদানি নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রে জোর দিয়েছে।- সূত্র : বাংলাদেশ জার্নাল
নাসরিন /হককথা