নিউইয়র্ক ১২:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বেপরোয়া ছিনতাইকারী, প্রাণ গেছে পুলিশেরও ; আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:২৪:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জুলাই ২০২৩
  • / ৩৭ বার পঠিত

বাংলাদেশ ডেস্ক : ঈদুল আজহার ছুটিতে রাজধানীতে ভয়ংকর আকার ধারণ করে ছিনতাই। এই সময়ে ছিনতাইকারীদের হামলায় প্রাণ গেছে এক পুলিশ সদস্যের, আহত হয়ে ১০ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক সাংবাদিক।

ছিনতাইকারীদের হামলায় স্বয়ং পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ মানুষ কতটুকু নিরাপদ এই শহরে।

অবশ্য নিজেদের সদস্য প্রাণ হারানোর পর নড়েচড়ে বসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে পুলিশের বিশেষ অভিযান।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, জুলাইয়ের প্রথম ৭ দিনে রাজধানী থেকে মোট ৫০৫ জন ডাকাত ও ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ২০৮টি।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে চলা বিশেষ অভিযানে ১ জুলাই থেকে সাত জুলাই পর্যন্ত ৫০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশকে এখন ভাবনায় ফেলেছে রাজধানীজুড়ে গড়ে ওঠা ছিনতাইয়ের চিহ্নিত ও অচিহ্নিত হটস্পটগুলো।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে প্রায় ৩০টির ওপরে ছিনতাইয়ের হটস্পট রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ এলাকা হলো ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ। এ বিভাগের অধীনে ফার্মগেটে গত ১ জুলাই ছিনতাইকারীদের হামলায় পুলিশ সদস্য মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া একই বিভাগের হাতিরঝিল এলাকায় ঈদের দিন রাতে এক সাংবাদিক ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত হন।

এ ছাড়া হটস্পটের তালিকায় রয়েছে শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, কলাবাগান, রামপুরা, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, উত্তরা পশ্চিম ও পল্লবী। এর মধ্যে পান্থপথ, টিএসসি, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও রেলওয়ে-স্টেশন ছিনতাইয়ের অন্যতম হটস্পট।

রাজধানীর চুরি-ছিনতাই নিয়ে ডিএমপির পরিসংখ্যান যা বলছে
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে রাজধানীতে প্রায় ২০০টির মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ২০টির ওপরে। অন্যদিকে গত এক বছরে রাজধানীতে চুরির ঘটনা ঘটেছে দেড় হাজারেরও বেশি। এদিকে শুধু এ বছরের প্রথম ৪ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫০টির মতো।


গত ১ জুলাই রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মো. মনিরুজ্জামান নামে এক পুলিশ সদস্য।
যদিও এসব ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা ডিএমপির পরিসংখ্যানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কেননা অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাজধানীর থানাগুলোতে কোনো মামলা হয় না। অভিযোগ রয়েছে ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় থানায় মামলা নেওয়ার অনীহার কারণে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হন ভুক্তভোগীরা। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মামলা না নেওয়ার বিষয়টি একাধিকবার স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে গত ২৫ মে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অনেক থানার ওসি মনে করেন, চুরির মামলা করলে চোর খুঁজতে হবে, কষ্ট করতে হবে। এ কারণে অনেকে মামলা নিতে চান না। তবে আবার অনেকে (ওসি) কষ্টও করেছেন। তাই আমি বলব চুরি হলে জিডি না করে মামলা করতে। থানায় মামলা নিতে না চাইলে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এলে আমরা অভিযোগ নেব।

যে কারণে ছিনতাইকারীদের পছন্দ হাতিরঝিল ও কারওয়ান বাজার
রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, রাতের বেলায় কারওয়ান বাজার রেলগেট থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক পর্যন্ত অধিকাংশ জায়গা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। বিশেষ করে মধ্য রাতের পর পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকা একদম নীরব থাকে। এছাড়া কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতের বেলায় ওই এলাকায় চলাফেরায় ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অন্যদিকে মধ্যরাতের পর এসব এলাকায় পুলিশের টহল বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা থাকায় আগে থেকে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা মানুষজন দেখলেই হামলা করে বসে।

এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. হাবিব বলেন, ব্যবসার কাজ শেষ করে মধ্যরাতে বাসায় যাওয়ার সময় প্রতিদিনই এক শ্রেণির উঠতি বয়সের যুবককে পান্থকুঞ্জ পার্কের অন্ধকারে মাদক সেবন করতে দেখি। সুযোগ পেলে এরাই হয়ে যায় ছিনতাইকারী। রাতে এখন এই রাস্তা ধরে বাসায় যেতে ভয় লাগে। মধ্যরাতে পান্থকুঞ্জ এলাকায় পুলিশেরও তেমন উপস্থিতি থাকে না।

এদিকে হাতিরঝিল নিয়ে অভিযোগ অনেক পুরোনো। হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় শুধু ছিনতাই হয় বেশি এমন নয়, রাজধানীর সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে হাতিরঝিল অন্যতম। মাঝে মধ্যেই মরদেহ উদ্ধার নিয়ে হাতিরঝিল শিরোনামে থাকে। এত মরদেহ হাতিরঝিলে কোথা থেকে আসে, এখন পর্যন্ত এর সুষ্ঠু কোনো তদন্ত হয়নি। এছাড়া এমন কোনো মাস যায় না যে হাতিরঝিলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি।

হাতিরঝিল দিয়ে বাসায় ফিরতে সুবিধা হলেও ছিনতাইয়ের ভয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে রামপুরা হয়ে বাসায় ফিরি।
মধুবাগের বাসিন্দা মো. আনোয়ার
জানা গেছে, হাতিরঝিলে থাকা ৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে বর্তমানে অধিকাংশ অচল। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা উঠলেও সচল করা হচ্ছে না সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো। এর ফলে হত্যা থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেও পাওয়া যাচ্ছে না ফুটেজ। পুলিশ ও রাজউকের পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হয় সিসিটিভি ক্যামেরা সচল রয়েছে। কিন্তু মরদেহ উদ্ধার হলেই পুলিশ বলে ‘সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ নেই’। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য, অপরাধীরা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে। এ কারণে ফুটেজ পাওয়া যায় না।

ছিনতাই নিয়ে যা বলছে নগরবাসী
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, রাজধানীর এখন এমন অবস্থা যে দিনের বেলাতেও ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। উঠতি বয়সের মাদকাসক্ত এক শ্রেণির যুবক দিনের বেলায় বাস কিংবা রিকশায় বসে থাকা যাত্রীদের মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাতের ঢাকায় বের হতেই মানুষজন ভয় পাচ্ছে।

এ বিষয়ে রাজধানীর মধুবাগের বাসিন্দা মো. আনোয়ার বলেন, রাতের বেলায় অনেক সময় বাসায় ফিরতে দেরি হয় ব্যবসায়িক কারণে। হাতিরঝিল দিয়ে বাসায় ফিরতে সুবিধা হলেও ছিনতাইয়ের ভয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে রামপুরা হয়ে বাসায় ফিরি।

ছিনতাই হলে মামলা করা যায় না উল্লেখ করে অনেক ভুক্তভোগী জানান, ঈদের আগের কয়েক দিন মোবাইল ছিনতাইয়ের পর তারা সংশ্লিষ্ট থানায় যান মামলা করতে। মামলা করতে যাওয়ার পর পুলিশ সরাসরি বলে জিডি করতে। বার বার মামলার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের হয়রানিমূলক আচরণের কারণে জিডি করে ফিরতে হয়েছে তাদের।

নড়েচড়ে বসেছে ডিএমপি
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নড়েচড়ে বসেছে ডিএমপি। এ নিয়ে ডিএমপির সব ডিসি ও ওসিদের সঙ্গে আলাদা-আলাদা বৈঠক করেছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। বৈঠকে ডিএমপি কমিশনার সবাইকে নির্দেশ দেন যেকোনো মূল্যে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। রাতে পুলিশ টহল বাড়ানোর নির্দেশও দেন তিনি।

ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৫০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি
এ বিষয়ে ডিএমপির কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ঈদের বন্ধে রাজধানীতে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আমরা ঈদের আগেই অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। কিন্তু এরপরও দুঃখজনকভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছে। পুলিশ এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। রাজধানীকে ছিনতাইকারীমুক্ত না করা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। এর জন্য আমাদের যা করা লাগে, যত পরিশ্রম করা লাগে আমরা করব।

মধ্যরাতে ছিনতাই, চাপ বেড়েছে ওসিদের ওপর
রাতের ঢাকার শেষ ভাগের সময়টাকে বেছে নেয় ছিনতাইকারীরা। এমনিতেও রাতে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়। রাত ২টার পর রাস্তা আরও অনেক ফাঁকা হয়ে যায়। এই সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বেশি। তাই মধ্যেরাতে ছিনতাইয়ের ঘটনাসহ ঢাকায় ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিএমপির সকল থানার ওসিদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।

ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে বলা হয়েছে, কোনো এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব নির্দিষ্ট থানার ওসিকে নিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রয়োজনে ওসিদের শাস্তির ব্যবস্থাও করবে ডিএমপি।

কোরবানির ঈদের ছুটিতে শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে তা নয়, ঘটে গেছে দুর্ধর্ষ দুটি ডাকাতিও। এর মধ্যে একটি ঘটে বাড্ডা লিংক রোডের একটি বাসায়। ঈদের ছুটির প্রথম দিনে বাসাটির লোকজনের হাত-পা বেঁধে দিনের বেলায় ৬ ডাকাত ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১১ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

এ ছাড়া ঈদের আগের রাতে রাজধানীর আফতাবনগর হাটে গরু বিক্রি করে ফিরছিলেন জামালপুরের আট ব্যাপারী। পথে তাদের ২৮ লাখ টাকা ডাকাতি হয়। এ দুই ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করা গেলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

বাড্ডার ডাকাতিতে সবাই ছিল ২০-২৫ বছরের তরুণ

ঈদের ছুটিতে বাড্ডা লিংক রোডের যে বাসাটিতে ডাকাতি হয় সেই বাসার মালিকের নাম মীর ইশতিয়াক হোসেন। তিনি দুর্ধর্ষ এই ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৭ জুন বিকেল ৪টার দিকে অজ্ঞাত ৬-৭ জন ব্যক্তি তার বাসায় ঢুকে পড়ে সবাইকে জিম্মি করে বেঁধে ফেলে। তিনি বলেন, আমার মাকে একজন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা কিন্তু মা সরে যাওয়ায় ডাকাত দলের একজনের হাতে লেগে কেটে যায়। এই সময়ে আলমারির চাবি দিতে বলে। চাবি না দিলে শিশু সন্তানকে হত্যার হুমকি দেয়।

ইশতিয়াক হোসেন বলেন, ডাকাতদের হাতে দেশি চাপাতি ও চাইনিজ কুড়াল ছিল। পরে আমার বাবার রুমের কাঠের আলমারি খুলে ড্রয়ারে থাকা নগদ ১১ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ছোট বোনের স্টিলের আলমারিতে থাকা ত্রিশ লাখ টাকা মূল্যের ৩৯ ভরি স্বর্ণালংকার, ডায়মন্ডের আংটি, নাক ফুল ও নগদ ৭০ হাজার টাকা এবং দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ডাকাতদের একজনের বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, বাকিদের ২০ থেকে ২৫ এর মধ্যে। সবার পরনে প্যান্ট ও টি-শার্ট ছিল।- সূত্র : ঢাকা পোস্ট

নাসরিন /হককথা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বেপরোয়া ছিনতাইকারী, প্রাণ গেছে পুলিশেরও ; আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

প্রকাশের সময় : ০৮:২৪:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জুলাই ২০২৩

বাংলাদেশ ডেস্ক : ঈদুল আজহার ছুটিতে রাজধানীতে ভয়ংকর আকার ধারণ করে ছিনতাই। এই সময়ে ছিনতাইকারীদের হামলায় প্রাণ গেছে এক পুলিশ সদস্যের, আহত হয়ে ১০ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক সাংবাদিক।

ছিনতাইকারীদের হামলায় স্বয়ং পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ মানুষ কতটুকু নিরাপদ এই শহরে।

অবশ্য নিজেদের সদস্য প্রাণ হারানোর পর নড়েচড়ে বসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে পুলিশের বিশেষ অভিযান।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, জুলাইয়ের প্রথম ৭ দিনে রাজধানী থেকে মোট ৫০৫ জন ডাকাত ও ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ২০৮টি।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে চলা বিশেষ অভিযানে ১ জুলাই থেকে সাত জুলাই পর্যন্ত ৫০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশকে এখন ভাবনায় ফেলেছে রাজধানীজুড়ে গড়ে ওঠা ছিনতাইয়ের চিহ্নিত ও অচিহ্নিত হটস্পটগুলো।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে প্রায় ৩০টির ওপরে ছিনতাইয়ের হটস্পট রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ এলাকা হলো ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ। এ বিভাগের অধীনে ফার্মগেটে গত ১ জুলাই ছিনতাইকারীদের হামলায় পুলিশ সদস্য মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া একই বিভাগের হাতিরঝিল এলাকায় ঈদের দিন রাতে এক সাংবাদিক ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত হন।

এ ছাড়া হটস্পটের তালিকায় রয়েছে শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, ভাটারা, শেরেবাংলা নগর, কলাবাগান, রামপুরা, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, উত্তরা পশ্চিম ও পল্লবী। এর মধ্যে পান্থপথ, টিএসসি, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও রেলওয়ে-স্টেশন ছিনতাইয়ের অন্যতম হটস্পট।

রাজধানীর চুরি-ছিনতাই নিয়ে ডিএমপির পরিসংখ্যান যা বলছে
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে রাজধানীতে প্রায় ২০০টির মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ২০টির ওপরে। অন্যদিকে গত এক বছরে রাজধানীতে চুরির ঘটনা ঘটেছে দেড় হাজারেরও বেশি। এদিকে শুধু এ বছরের প্রথম ৪ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫০টির মতো।


গত ১ জুলাই রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মো. মনিরুজ্জামান নামে এক পুলিশ সদস্য।
যদিও এসব ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা ডিএমপির পরিসংখ্যানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কেননা অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাজধানীর থানাগুলোতে কোনো মামলা হয় না। অভিযোগ রয়েছে ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় থানায় মামলা নেওয়ার অনীহার কারণে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হন ভুক্তভোগীরা। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মামলা না নেওয়ার বিষয়টি একাধিকবার স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে গত ২৫ মে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অনেক থানার ওসি মনে করেন, চুরির মামলা করলে চোর খুঁজতে হবে, কষ্ট করতে হবে। এ কারণে অনেকে মামলা নিতে চান না। তবে আবার অনেকে (ওসি) কষ্টও করেছেন। তাই আমি বলব চুরি হলে জিডি না করে মামলা করতে। থানায় মামলা নিতে না চাইলে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এলে আমরা অভিযোগ নেব।

যে কারণে ছিনতাইকারীদের পছন্দ হাতিরঝিল ও কারওয়ান বাজার
রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, রাতের বেলায় কারওয়ান বাজার রেলগেট থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক পর্যন্ত অধিকাংশ জায়গা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। বিশেষ করে মধ্য রাতের পর পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকা একদম নীরব থাকে। এছাড়া কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতের বেলায় ওই এলাকায় চলাফেরায় ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অন্যদিকে মধ্যরাতের পর এসব এলাকায় পুলিশের টহল বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা থাকায় আগে থেকে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা মানুষজন দেখলেই হামলা করে বসে।

এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. হাবিব বলেন, ব্যবসার কাজ শেষ করে মধ্যরাতে বাসায় যাওয়ার সময় প্রতিদিনই এক শ্রেণির উঠতি বয়সের যুবককে পান্থকুঞ্জ পার্কের অন্ধকারে মাদক সেবন করতে দেখি। সুযোগ পেলে এরাই হয়ে যায় ছিনতাইকারী। রাতে এখন এই রাস্তা ধরে বাসায় যেতে ভয় লাগে। মধ্যরাতে পান্থকুঞ্জ এলাকায় পুলিশেরও তেমন উপস্থিতি থাকে না।

এদিকে হাতিরঝিল নিয়ে অভিযোগ অনেক পুরোনো। হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় শুধু ছিনতাই হয় বেশি এমন নয়, রাজধানীর সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে হাতিরঝিল অন্যতম। মাঝে মধ্যেই মরদেহ উদ্ধার নিয়ে হাতিরঝিল শিরোনামে থাকে। এত মরদেহ হাতিরঝিলে কোথা থেকে আসে, এখন পর্যন্ত এর সুষ্ঠু কোনো তদন্ত হয়নি। এছাড়া এমন কোনো মাস যায় না যে হাতিরঝিলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি।

হাতিরঝিল দিয়ে বাসায় ফিরতে সুবিধা হলেও ছিনতাইয়ের ভয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে রামপুরা হয়ে বাসায় ফিরি।
মধুবাগের বাসিন্দা মো. আনোয়ার
জানা গেছে, হাতিরঝিলে থাকা ৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে বর্তমানে অধিকাংশ অচল। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা উঠলেও সচল করা হচ্ছে না সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো। এর ফলে হত্যা থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেও পাওয়া যাচ্ছে না ফুটেজ। পুলিশ ও রাজউকের পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হয় সিসিটিভি ক্যামেরা সচল রয়েছে। কিন্তু মরদেহ উদ্ধার হলেই পুলিশ বলে ‘সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ নেই’। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য, অপরাধীরা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে। এ কারণে ফুটেজ পাওয়া যায় না।

ছিনতাই নিয়ে যা বলছে নগরবাসী
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, রাজধানীর এখন এমন অবস্থা যে দিনের বেলাতেও ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। উঠতি বয়সের মাদকাসক্ত এক শ্রেণির যুবক দিনের বেলায় বাস কিংবা রিকশায় বসে থাকা যাত্রীদের মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাতের ঢাকায় বের হতেই মানুষজন ভয় পাচ্ছে।

এ বিষয়ে রাজধানীর মধুবাগের বাসিন্দা মো. আনোয়ার বলেন, রাতের বেলায় অনেক সময় বাসায় ফিরতে দেরি হয় ব্যবসায়িক কারণে। হাতিরঝিল দিয়ে বাসায় ফিরতে সুবিধা হলেও ছিনতাইয়ের ভয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে রামপুরা হয়ে বাসায় ফিরি।

ছিনতাই হলে মামলা করা যায় না উল্লেখ করে অনেক ভুক্তভোগী জানান, ঈদের আগের কয়েক দিন মোবাইল ছিনতাইয়ের পর তারা সংশ্লিষ্ট থানায় যান মামলা করতে। মামলা করতে যাওয়ার পর পুলিশ সরাসরি বলে জিডি করতে। বার বার মামলার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের হয়রানিমূলক আচরণের কারণে জিডি করে ফিরতে হয়েছে তাদের।

নড়েচড়ে বসেছে ডিএমপি
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নড়েচড়ে বসেছে ডিএমপি। এ নিয়ে ডিএমপির সব ডিসি ও ওসিদের সঙ্গে আলাদা-আলাদা বৈঠক করেছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। বৈঠকে ডিএমপি কমিশনার সবাইকে নির্দেশ দেন যেকোনো মূল্যে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। রাতে পুলিশ টহল বাড়ানোর নির্দেশও দেন তিনি।

ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৫০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি
এ বিষয়ে ডিএমপির কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ঈদের বন্ধে রাজধানীতে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আমরা ঈদের আগেই অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। কিন্তু এরপরও দুঃখজনকভাবে ঘটনাগুলো ঘটেছে। পুলিশ এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। রাজধানীকে ছিনতাইকারীমুক্ত না করা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। এর জন্য আমাদের যা করা লাগে, যত পরিশ্রম করা লাগে আমরা করব।

মধ্যরাতে ছিনতাই, চাপ বেড়েছে ওসিদের ওপর
রাতের ঢাকার শেষ ভাগের সময়টাকে বেছে নেয় ছিনতাইকারীরা। এমনিতেও রাতে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়। রাত ২টার পর রাস্তা আরও অনেক ফাঁকা হয়ে যায়। এই সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বেশি। তাই মধ্যেরাতে ছিনতাইয়ের ঘটনাসহ ঢাকায় ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিএমপির সকল থানার ওসিদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।

ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে বলা হয়েছে, কোনো এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব নির্দিষ্ট থানার ওসিকে নিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রয়োজনে ওসিদের শাস্তির ব্যবস্থাও করবে ডিএমপি।

কোরবানির ঈদের ছুটিতে শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে তা নয়, ঘটে গেছে দুর্ধর্ষ দুটি ডাকাতিও। এর মধ্যে একটি ঘটে বাড্ডা লিংক রোডের একটি বাসায়। ঈদের ছুটির প্রথম দিনে বাসাটির লোকজনের হাত-পা বেঁধে দিনের বেলায় ৬ ডাকাত ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১১ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

এ ছাড়া ঈদের আগের রাতে রাজধানীর আফতাবনগর হাটে গরু বিক্রি করে ফিরছিলেন জামালপুরের আট ব্যাপারী। পথে তাদের ২৮ লাখ টাকা ডাকাতি হয়। এ দুই ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করা গেলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

বাড্ডার ডাকাতিতে সবাই ছিল ২০-২৫ বছরের তরুণ

ঈদের ছুটিতে বাড্ডা লিংক রোডের যে বাসাটিতে ডাকাতি হয় সেই বাসার মালিকের নাম মীর ইশতিয়াক হোসেন। তিনি দুর্ধর্ষ এই ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৭ জুন বিকেল ৪টার দিকে অজ্ঞাত ৬-৭ জন ব্যক্তি তার বাসায় ঢুকে পড়ে সবাইকে জিম্মি করে বেঁধে ফেলে। তিনি বলেন, আমার মাকে একজন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা কিন্তু মা সরে যাওয়ায় ডাকাত দলের একজনের হাতে লেগে কেটে যায়। এই সময়ে আলমারির চাবি দিতে বলে। চাবি না দিলে শিশু সন্তানকে হত্যার হুমকি দেয়।

ইশতিয়াক হোসেন বলেন, ডাকাতদের হাতে দেশি চাপাতি ও চাইনিজ কুড়াল ছিল। পরে আমার বাবার রুমের কাঠের আলমারি খুলে ড্রয়ারে থাকা নগদ ১১ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ছোট বোনের স্টিলের আলমারিতে থাকা ত্রিশ লাখ টাকা মূল্যের ৩৯ ভরি স্বর্ণালংকার, ডায়মন্ডের আংটি, নাক ফুল ও নগদ ৭০ হাজার টাকা এবং দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ডাকাতদের একজনের বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, বাকিদের ২০ থেকে ২৫ এর মধ্যে। সবার পরনে প্যান্ট ও টি-শার্ট ছিল।- সূত্র : ঢাকা পোস্ট

নাসরিন /হককথা