ভেতরে সার্ভার ডাউন, বাইরে বলে ‘টাকা দিলেই হবে’

- প্রকাশের সময় : ০৮:০৮:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ জুন ২০২৩
- / ১৭৩ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : সার্ভার জটিলতার কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসগুলোতে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারছেন না বিদেশগামীরা। প্রায় ২০ দিন ধরে এ সমস্যা চলছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, সার্ভার ডাউন থাকায় প্রতিদিন যে পরিমাণ ফিঙ্গার প্রিন্ট করার কথা তার অর্ধেকও করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ঢাকার জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্য। তারা ১৫-২০ গুণ বেশি টাকার বিনিময়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছেন।
সরকারিভাবে নিবন্ধিত হয়ে বিদেশ যেতে হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে নিবন্ধন করতে হয়। এজন্য বিদেশগামীদের সেখানে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়।
ঈদের দুই দিন পর সৌদি আরব যাওয়ার ফ্লাইট বুকিং দিয়ে রাখা কেরানীগঞ্জের সাথী আকতার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে ঢাকায় এসে টানা দুই দিন (সোম ও মঙ্গলবার) ফেরত গেছেন। তাকে বলা হয়েছে, সার্ভারের জটিলতার কারণে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, সাভারের বাসিন্দা মামুন প্রথম দিন এসেই ফিঙ্গার প্রিন্টের নিশ্চয়তা পেয়ে যান। বিনিময়ে তাকে খরচ করতে হয় নির্ধারিত ফির প্রায় ১৫-২০ গুণ অর্থ। ফিঙ্গার প্রিন্টের সরকারি খরচ এমআরপি পাসপোর্টের জন্য ২০০ টাকা আর ই-পাসপোর্টের জন্য ২২০ টাকা। ‘অন্যভাবে’ করতে গেলে এ খরচ লাগছে ৩-৪ হাজার টাকা।
সার্ভার ডাউন থাকায় প্রতিদিন যে পরিমাণ ফিঙ্গার প্রিন্ট করার কথা তার অর্ধেকও করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে ঢাকার জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্য। তারা বেশি টাকার বিনিময়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছেন
গত মঙ্গলবার (২০ জুন) বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস ঘুরে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে আসা বিদেশগামীদের ভোগান্তির চিত্র প্রত্যক্ষ করে ঢাকা পোস্ট।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় একশ’র মতো বিদেশগামী মঙ্গলবার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে আসেন। তাদের বেশিরভাগ সকাল ৮টা থেকে অপেক্ষা করছেন ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার জন্য। দুপুর ২টার পর কর্তৃপক্ষ হাতেগোনা কিছু বিদেশগামীর কাগজপত্র রেখে অন্যদের ফিরিয়ে দেয়। তাদের সবাইকে পরদিন আবার আসতে বলা হয়।
ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে না পেরে অনেক বিদেশগামী বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। আবার কেউ কেউ চেষ্টা করতে থাকেন যদি কোনো উপায়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়।
কেরানীগঞ্জ থেকে আসা সাথী আকতার বলেন, ‘সকাল ৭টায় এসে কাগজপত্র জমা দিছি। এখন ২টা বাজে, বলছে আজকে হবে না, কাল ১টার দিকে আসেন। কেরানীগঞ্জ থেকে এখানে আসা-যাওয়ার ভাড়া, খাওয়ার খরচ আছে। কালকে আসলে যে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারব, তারও কোনো গ্যারান্টি নাই।’
সার্ভার জটিলতা কোনো সমস্যা নয়, টাকা দিলেই ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলবে বলে আশ্বাস দেন দুই আনসার সদস্য। বিনিময়ে তারা তিন থেকে চার হাজার টাকা করে দাবি করেন। শুধু তাই নয়, পাসপোর্ট কিংবা কাগজপত্রে গরমিল থাকা প্রবাসীদেরও ফিঙ্গার প্রিন্ট করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন তারা
কর্মকর্তাদের কাছে সার্ভার ডাউনের অজুহাত হজম করে অনেকে ফিরে গেছেন। তবে মামুন হোসেন নামে একজন অন্যভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান।
মন্ত্রণালয়ের নিচ তলায় যেখানে বিদেশগামীদের ফিঙ্গার প্রিন্টসহ রেজিস্ট্রেশন করা হয় তার মূল ফটকে দায়িত্ব পালন করছিলেন আনসার সদস্য সাদেকুল ও রুবেল। মামুনসহ কিছু বিদেশগামী তখন তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কী নিয়ে কথা বলছেন, তা বোঝার জন্য জটলায় মিশে যান ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক।
বিদেশগামীদের সঙ্গে সাদেকুল ও রুবেলের আলাপের বিষয়বস্তু হলো ফিঙ্গার প্রিন্ট। সার্ভার জটিলতা কোনো সমস্যা নয়, টাকা দিলেই ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলবে বলে আশ্বাস দেন দুই আনসার সদস্য। বিনিময়ে তারা তিন থেকে চার হাজার টাকা করে দাবি করেন। শুধু তাই নয়, পাসপোর্ট কিংবা কাগজপত্রে গরমিল থাকা প্রবাসীদেরও ফিঙ্গার প্রিন্ট করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন তারা।
উপায় না পেয়ে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য আনসার সদস্যদের চার হাজার টাকা দেন মামুন হোসেন। তিনি আশা করেন এভাবে তার ফিঙ্গার প্রিন্ট হয়ে যাবে।
জটলা ভেঙে যাওয়ার পর মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যাংক ড্রাফট করতে পারছি না। কর্মকর্তারা বলছেন, সার্ভার ডাউন। এটা আসলে তাদের কারসাজি। ভেতরে বলল হবে না, বাইরে আনসারদের টাকা দিলাম। তারা বলল করে দেবে। এটা কীভাবে সম্ভব?’
পাসপোর্ট নম্বর দেন। দেখে তারপর বলছি কত টাকা লাগবে। যদি ব্যাংক ড্রাফট করা না থাকে তাহলে অন্য এক জায়গায় গিয়ে সার্ভার থেকে করাতে হবে। বাকিটা এখানকার সার্ভার থেকে করে দিতে পারব
আনসার সদস্য রুবেল
বিদেশগামী মোহাম্মদ সোহাগের কাছে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য তিন হাজার টাকা দাবি করেন আনসার সাদেকুল ও রুবেল। বিদেশগামী পরিচয় দিয়ে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে চাইলে রুবেল বলেন, পাসপোর্ট নম্বর দেন। দেখে তারপর বলছি কত টাকা লাগবে। যদি ব্যাংক ড্রাফট করা না থাকে তাহলে অন্য এক জায়গায় গিয়ে সার্ভার থেকে করাতে হবে। বাকিটা এখানকার সার্ভার থেকে করে দিতে পারব।
ভেতরে তো বলছে সার্ভার ডাউন, তাহলে আপনি কীভাবে করে দিতে পারবেন। এমন প্রশ্ন করলে রুবেল বলেন, ‘আপনার কাজটা হলেই তো হয়, এত কথা জানার তো দরকার নাই।’
শুধু এ দুই আনসার সদস্য নয়, বাকি আনসার সদস্য এবং কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও বিদেশগামীদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে দেখা যায়। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তা এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কিছু কর্মকর্তার কারণে অন্যদের বদনাম হয়। তাদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সম্পর্ক আছে। তারা সরাসরি না করে আনসারদের মাধ্যমে অনিয়ম করান।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তিনি ফোন করতে বলেন। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি
সার্ভার সমস্যার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা অফিসের এক কর্মকর্তার ভাষ্য, ঢাকায় এক সপ্তাহ ধরে একটু বেশি ঝামেলা করছে। রোববার ও সোমবার কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে, মঙ্গলবার থেকে অনেকটা স্বাভাবিক। দু-একদিনের মধ্যে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। মূলত, সার্ভারটা পুরোনো এবং নেটের সমস্যার কারণে এটা হচ্ছে। তাছাড়া ঝড়-বৃষ্টির দিনে একটু ঝামেলা তো হয়।
কয়েকটা সমস্যার কারণে সার্ভার প্রায়ই ডাউন হচ্ছে। প্রথমত, সার্ভারের লোড ক্যাপাসিটি কম। দ্বিতীয়ত, সার্ভারের ধারণক্ষমতা কম। ইন্টারনেট সংযোগও ঠিক মতো পাওয়া যায় না
নাম প্রকাশ না করে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তিনি ফোন করতে বলেন। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটা সমস্যার কারণে সার্ভার প্রায়ই ডাউন হচ্ছে। প্রথমত, সার্ভারের লোড ক্যাপাসিটি কম। দ্বিতীয়ত, সার্ভারের ধারণক্ষমতা কম। ইন্টারনেট সংযোগও ঠিক মতো পাওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্ভারের বর্তমান যে অবস্থা এ থেকে উত্তরণে আরও তিন থেকে চার বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি ছিল। কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের বিদেশগামীদের ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য যেসব মেশিন চালানো হয় সেগুলো মান্ধাতার আমলের কম্পিউটার। এগুলোতে উইন্ডোজ ১০ নেওয়ার সক্ষমতা নেই। ফিঙ্গার প্রিন্টের মেশিনগুলো আপডেট কম্পিউটারে সাপোর্টও করছে না।
সার্ভার জটিলতা ঢাকার বাইরেও
দেশের কয়েকটি জেলা শহরে অবস্থিত কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরের কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সার্ভার জটিলতার কারণে বিদেশগামীরা ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারছেন না। প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে এ সমস্যা চলছে। সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নোয়াখালী কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্ভারের ধারণক্ষমতা অনেক আগে থেকেই কম। বর্তমানে যে সার্ভারে বিদেশগামীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট বা রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে এটি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের সার্ভার। কোনো আপডেট নেই। সার্ভারে লোড ক্যাপাসিটি নেই। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে, কিন্তু সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু শুনে আসছি, ‘আইটি শাখা চেষ্টা করছে’। তাদের চেষ্টা চলছেই!
কুমিল্লা অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্ভার আপডেট থাকে না বলে প্রায়ই এ সমস্যায় পড়তে হয়। আমরা যারা মাঠে আছি, পাবলিকের গালাগালি খাই। বাবা-মাকে নিয়েও গালি শুনতে হয়। নিশ্চিত করে বিদেশগামীদের বলতেও পারি না, আপনি কাল আসুন। কাল যে সার্ভার ঠিক হবে, সে গ্যারান্টিও আমরা তাদের দিতে পারি না।
সবশেষ চিত্র : বৃহস্পতিবার (২২ জুন) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় আগের চেয়ে কিছুটা সচল হয়েছে সার্ভার, তবে এখনো কাজের গতি কম। ফলে ভোগান্তি রয়েছে এখনো। তবে জেলা পর্যায়ে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সেখানে ভোগান্তি আরও বেড়েছে বলে জানা গেছে।- সূত্র : ঢাকা পোস্ট
নাসরিন /হককথা