দুখু মিয়ার বিদ্রোহী আবির্ভাব
- প্রকাশের সময় : ১১:১৩:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ মে ২০২৩
- / ৪৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : সবারই জন্ম হয়। তবে কারও কারও জন্ম আবির্ভাব বলে মনে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বাংলা ভাষার তীব্র প্রতিভাময় কবি, অসাধারণ কথাসাহিত্যিক এবং জাদুকরি গীতিকার ও সুরকার কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম আবির্ভাব দিবস আজ। ধূমকেতুর মতোই ছিল তাঁর আবির্ভাব। মৃত্যু ছিল অবশ, অবলার মতো ট্র্যাজিক। তাঁর অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনার শতবর্ষ পরে বোঝা কঠিন যে, পরাধীন ভারতবর্ষে কী রকম জাগরণের তরঙ্গ তুলেছিল এই কবিতা। মার্কিন লোকসাহিত্যবিশারদ হেনরি গ্লাসি সঠিকভাবেই মনে করতেন, বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতার একটি হলো কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। অন্যটি হলো আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘সেকেন্ড কামিং’। দেশকে স্বাধীন করবেন বলে নজরুল অস্ত্র চালানো শিখতে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হয়ে পুরুলিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন করাচি। ব্রিটিশ শাসনে তিনিই একমাত্র বাঙালি কবি, যিনি কখনও কোনো সময় ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে ছিলেন না। এমনকি কবিতা লেখার জন্য, সাহসী সাংবাদিকতার জন্য জেলে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। অল্প বয়সে এ রকম তীব্র সৃষ্টি-সুখের উল্লাস যাঁর বুকে, তাঁর জীবন হয়েছিল বাঁধনহারা; পরিণতি হয়েছিল নীড়হারা পাখির মতো।
তাঁর অনেক নাম : দুখু মিয়া, নজর আলি, নাজির আলি। নামগুলো আসলে নামহীন-গোত্রহীন এক তরুণের দুর্দশার কথা বলে। শেষে এসে স্থায়ী হন ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামে। নামের বিবর্তন থেকে বোঝা যায়, দিনে দিনে তিনি অনামা থেকে ‘নাম-করা’ সারিতে উঠে আসছেন। কিন্তু দুঃখের দহনে পোড়া ‘দুখু মিয়া’র জীবন আগের মতো দুঃখেরই থেকে গেছে। রুটির দোকানের কর্মী, দারোগার বাড়ির ফরমাশ-খাটা বালক থেকে হাবিলদার হয়েছেন সেনাবাহিনীর। হয়েছেন লেটোর গানের দলের স্যাঙাত, দূরদেশের রণাঙ্গনের সৈনিক। হয়েছেন সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং কারাভোগী বিপ্লবী। নজরুলের জীবন তাঁর সাহিত্যের মতোই চমক লাগানো।
আরোও পড়ুন । ঢাকায় পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ
সেই যুগে যখন বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে জাতীয় লেখক হওয়ার চিন্তা বিলাসিতা, তখন ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামটি হাজারো তরুণকে লেখক হওয়ার সাহস জুগিয়েছিল। শুধু কি লেখক? তাদের প্রেরণা দিয়েছিল দেশের সামনে উঠে দাঁড়াতে। তাঁর আবির্ভাব ছাড়া বিশ শতকের গোড়ার মুসলমান বাঙালির সাহিত্য সাধনার আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং ভেতর-বাহিরের বাধা দূর করা অনেক পিছিয়ে যেত। কারণ, পলাশীর পরাজয়ের পর ইংরেজরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চলন-বলনটাই শুধু বদলে দেয়নি; তারা সর্বতোভাবে বাংলার মুসলিম বিদ্বজ্জনের জীবন ও সাহিত্যচর্চা কঠিন করে তুলেছিল। পলাশী যুদ্ধের পরের দেড়শ বছর বাঙালি মুসলমানদের দিশাহারা দশার পর নজরুলের উদয় তাই যুগান্তকারী ঘটনা।
বাঙালি সংস্কৃতির দুই ধারা কোথাও যদি মেলে, সেটা নজরুলের জীবন, সংস্কৃতি এবং সৃষ্টির মধ্যেই। ধর্মান্তর না করেই দোলন ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে, চেতনার মধ্যে হিন্দু-মুসলিমের যুগল ভাব এবং অপরকে আপন করার লালনীয় উদারতা এবং ভারত ও পারস্য দুনিয়ার ভাবকে এক জায়গায় মেলানোর বিশ্বজনীনতা সত্যিই বিরল। তিনি চিন্তাকে আবেগায়িত করেছেন; আবেগকে করেছেন চিন্তাধর। একই কথা খাটে তাঁর রাজনীতির বেলায়ও। রাজনীতিকে আবেগায়িত আর আবেগকে রাজনীতি-জারিত করায় তিনি এক ব্যতিক্রমী পুরুষ।
নজরুল কেবল বাঙালি মুসলমান বা বাঙালি জাতির জন্যই নয়; ভারতীয় মাপেই মুক্তিকামী চিত্তজাগরণের পথিকৃৎ। আরেকটি দিক থেকেও নজরুল মুক্ত মানবের প্রতিনিধি। আর সব বিদগ্ধ ও কর্মীপুরুষ যেখানে কোনো না কোনোভাবে উপনিবেশবাদী পশ্চিমের বশ্যতা বা মুগ্ধতা লালন করেছেন; জীবনের কোনো পর্যায়েই নজরুল তা মানেননি। মনকে তিনি মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি ইংরেজের নির্যাতন বরণ করেছেন; স্বধর্মীয়দের গালমন্দ শুনেছেন; পরধর্মী স্বজাতির উপেক্ষা সয়েছেন। কোনোভাবেই তিনি কায়েমি রাজনৈতিক ও সম্পত্তি ব্যবস্থার অংশ ছিলেন না। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে তেজস্ক্রিয় মুক্ত ‘আমি’র জয় দেখি; তার কাছাকাছি অচলায়তন ভাঙা অস্মিতা ভারতবর্ষে কেন, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল।
এত পরিচয় সত্ত্বেও বাঙালির মনে দুখু মিয়া অতি চেনা কবিয়ালের রূপে স্থায়ী হয়েছেন। বুকের একপাশে চাদর জড়ানো, সুদর্শন গোঁফ ও বাবরি চুলের নজরুলের যে বাহার, তা বাংলার কবিয়ালের চিরায়ত ছবিকেই মনে জাগিয়ে তোলে। তাঁর স্বভাবের গীতল উচ্ছ্বাস কবিয়াল ছাড়া আর কার? বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিতে আর কোনো পুরুষ কি জাতির হৃদয়ে এমন প্রিয় স্থান নিতে পেরেছেন? নজরুলের মধ্যে আমরা দেখি বাংলার লোককবিদের মর্মজ্বালা। একেবারে কৃষক আবহ থেকে উঠে এসে তিনি উচ্চবর্গের মহলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিয়াল নজরুল। সর্বজনের সারি থেকে উঠে আসা নজরুলের মনে এক চির-দুখু মিয়ার বসবাস। নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অবসান ঘটে মাত্র ৪১ বছর বয়সে। এর পর তিনি নির্বাক হয়ে যান। জার্মান দার্শনিক নিৎসে লিখেছিলেন, বীর ও মহাপুরুষেরা যখন সাধারণের চাইতে অনেক ওপরে ওঠেন, তখন তাঁরা এমন কিছু দর্শন করেন, যাকে আর বর্ণনা করা যায় না। তখন তাঁরা বোবা হয়ে যান। কাজী নজরুলের ট্র্যাজিক নীরবতা হয়তো সে রকম কোনো সত্যদর্শনেরই অভিঘাত বা আঘাত। ফুলের জলসায় কবি নীরব, কিন্তু বাংলা কবিতা ও গানে তিনি এখনও কথা বলে চলেছেন। সূত্র : সমকাল
বেলী/হককথা