মামলায় আসামি ৬৮ শিশু-কিশোর
- প্রকাশের সময় : ০২:৫৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩
- / ৪৩ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : শিশুটির বয়স তিন বছর তিন মাস। জীবন-জগৎ সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে মামলার আসামি। চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত ১৬ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ফেসবুকে প্রচারের কারণে করা মামলায় আট আসামির একজন শিশু আল নাইম (ছদ্মনাম)।
একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মফিজুল ইসলাম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাসানকে মূল আসামি করে মামলাটি করেন। শুধু আল নাইম নয়, এই আইনে বিভিন্ন স্থানে অনেক শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট, কমেন্ট ও শেয়ার দেওয়ার কারণে অধিকাংশ মামলা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা দৃক জানিয়েছে, ২০২০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ৬৮ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩৪টি মামলা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই জামিন পেয়েছে। কেউ কেউ আছে কিশোর সংশোধনাগারে। আসামিদের অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ১৭।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিজিএসের তথ্য অনুযায়ী, এর পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত ৩ হাজার ৬৬৮ জনের মধ্যে আটক হন ১ হাজার ১১৯ জন। অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদ চার শতাধিক, ৫১ জন শিক্ষক এবং ১০৬ জন শিক্ষার্থী। ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে ফেসবুক কার্যক্রম নিয়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকরের সাড়ে চার বছরে ১ হাজার ৩০০টির বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হয়েছেন অন্তত ৩ হাজার ৬৬৮ জন। এর মধ্যে আটক হন ১ হাজার ৪০০ জনের মতো। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অসংখ্য মামলা হচ্ছে। গুজব ছড়ানো, বিভ্রান্তি সৃষ্টি, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।
আরোও পড়ুন। বিএনপিকে রাজপথেই মোকাবিলার প্রস্তুতি
বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা বিচারাধীন মামলা বেশি। ঢাকায় মামলা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০। বাকি মামলাগুলো অন্য সাত বিভাগীয় শহরে বিচারাধীন। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ তিনটি ধারায় মামলা হয়েছে। মামলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভুক্তভোগী হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গত সাড়ে চার বছরে ১৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি তিন শতাধিক। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮৪ জন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা দিতে এ আইনে মামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।
আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাব অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, মন্ত্রী, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে নামে কটূক্তির অভিযোগে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মী, সম্পাদক পরিষদসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই এই আইন পাস হয়েছিল। এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। এই আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন করা হবে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, আইনটি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, এ আইনে প্রচুর মামলা হচ্ছে, কিন্তু বিচারে শাস্তি হয়েছে কম। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, এই আইনের অপব্যবহার দিন দিনই বাড়ছে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, নাগরিকের চিন্তা-বাক্স্বাধীনতা বন্ধ করতেই এই কালো আইন। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করা প্রয়োজন।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই আইনে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। তবে ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ছে না। তাই গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন জেল খাটছেন।
ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের পিপি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম সমকালকে বলেন, বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় বেশি, খারিজও হয় বেশি; কিন্তু গ্রহণ কম। সাজার হার শতকরা ৩৫ শতাংশ। বাকিগুলো আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। গত তিন মাসে দুই থেকে আড়াইশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশে ৮-১০টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অনেক মামলা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খারিজ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ২৫ ও ৩১ ধারা দুটি কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ২০২১ সালে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এ আইনের চারটি ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়। রিটকারীদের আইনজীবী শিশির মনির জানিয়েছেন, মামলা শুনানির জন্য শিগগিরই আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে এবং আদালত দিন ধার্য করলেই শুনানি হবে। সূত্র : সমকাল
সুমি/হককথা