জাকাত জরিমানা নয়, সম্পদ পরিশুদ্ধতার মাধ্যম
- প্রকাশের সময় : ০১:৫৫:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৩
- / ৩৯ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক সুবিচার এবং মানবসমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার যেমন ব্যবস্থা করেছে, তেমনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি, সম্পদের সুষম বণ্টন উপহার দিয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, কোনও মানুষের পা কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া ব্যতিরেকে এক বিন্দুও নড়তে পারবে না। এগুলো হলো—১. জীবন কোন পথে ব্যয় করেছো, ২. যৌবন কোন পথে ব্যয় করেছো, ৩. আয় কোন পথে করেছো, ৪. ব্যয় কোন পথে করেছো এবং ৫. ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছো তা কতটা বাস্তবায়ন করেছো।
এখানে দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দু’টিই অর্থনীতি বিষয়ক। কেউ যেন অবৈধভাবে সম্পদ সংগ্রহ করে ধনের পাহাড় গড়তে না পারে সে জন্য উপার্জিত অর্থের হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আবার কেউ যেন অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে ব্যয় করতে না পারে তার জন্য ব্যয়ের হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। সম্পদের আয়-ব্যয়ের হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা করে এক্ষেত্রে অন্যায় পথ থেকে দূরে থাকতে সতর্ক করা হয়েছে। ধনীরা অর্থ উপার্জন করে পুঁজিপতি, আর গরিবরা আরও গরীব হওয়া থেকে রক্ষার জন্য ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ইসলাম জাকাতের ব্যবস্থা করেছে।
ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ‘জাকাত’-এর অবস্থান ঈমান ও নামাজের পরই। ইসলামের অন্যান্য মূল স্তম্ভের মতোই ‘জাকাত’ আদায় করাও ফরজ। আভিধানিক অর্থে যাকাতের অর্থ হলো— বৃদ্ধি, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ হয় এবং মালের পবিত্রতা ও বরকত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ’র অসন্তুষ্টি ও গজব হতে সমাজ মুক্ত ও পবিত্র হয়। অপরদিকে শরয়ি পরিভাষায় জীবনযাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মিটানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর কাল সঞ্চিত থাকলে, শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ অংশ শরীয়ত নির্ধারিত খাতে কোনও প্রকার বিনিময় ছাড়া মালিকানা হস্তান্তরকে জাকাত বলে।
ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে চলার নামই ইবাদত। প্রাথমিকভাবে ইবাদতকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত দৈহিক ও দ্বিতীয়ত আর্থিক। জাকাত হলো আর্থিক ইবাদত। আর্থিক ইবাদতের মধ্যে জাকাতের গুরুত্ব সর্বাধিক। নামাজের মতোই এটি ফরজ। কোরআন ও হাদিসে যথাযথভাবে জাকাত প্রদানের জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “নামাজ কায়েম করো, জাকাত দান করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়”। (সূরা বাক্বারাহ-৪৩)। আরও বর্ণিত হয়েছে- “নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও”। (সূরা নূর- ৫৬)। “নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে, এটাই সঠিক ধর্ম”। (সূরা বাইয়্যিনাহ-৫)।
হজরত রাসুলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তাআলা ধনীদের উপর জাকাত ফরজ করেছেন। যাতে ধনীদের কাছ হতে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হয়”। (বুখারি শরিফ)। অতএব, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে জাকাত আদায় করা ফরজ। মহানবী (সা.)-এর পূর্বে যেসব নবী-রাসুল এসেছেন তাদের শরিয়ত ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ও জাকাতের বিধান ছিল। বর্ণিত হয়েছে, “এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা স্মরণ করুন, তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসুল, নবী। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে নামাজ ও জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি তার পালনকর্তার কাছে পছন্দনীয় ছিলেন।” (সূরা মরিয়াম-৫৪, ৫৫)।
জাকাত প্রদানের বিধান পূর্ববর্তী নবীগণের জামানায়ও ছিল এবং বর্তমানেও আছে। জাকাত প্রদান না করার জন্য পরকালে কঠোর ও ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। পার্থিব জীবনেও নানান বালা-মুসীবত নেমে আসে। কিয়ামতের দিন নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে গাফেল ব্যক্তিদেরকে জবাবদিহি হতে হবে। “তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত করেছে? তারা বলবে- আমরা নামাজ পড়তাম না, অভাবগ্রস্তকে আহার্য দিতাম না”। (সূরা মুদ্দাসসির- ৪২-৪৪)।
আর যারা সোনা ও রূপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দান করুন। সেদিন ওইসব (সোনা-রূপা) দোজখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তদ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ এবং তাদের পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। (এবং বলা হবে) এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ করো”। (সূরা তাওবাহ-৩৪, ৩৫)। হাদিসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “আল্লাহ যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন ওই ধন-সম্পদ তার জন্য একটি টাক মাথাওয়ালা বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে, যার (চোখ দু’টোর উপর) দু’টি কালো বিন্দু থাকবে এবং ওই সাপ তার গলদেশে পেঁচানো হবে। অতঃপর সাপটি ওই ব্যক্তির উভয় অধর প্রান্ত (কামড়ে) ধরে বলবে, আমি তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ভাণ্ডার”। (বুখারি শরিফ)।
উপরে বর্ণিত কোরআন ও হাদিসের আলোকে জানা যায়, ইসলামের জাকাতের বিধান পালন করা অপরিহার্য। বিধান অনুযায়ী জাকাত প্রদান করলে যেমন মালের পবিত্রতা হাসিল হয়, বরকত হয় এবং সাওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি এ বিধান অমান্য বা মালের জাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠোর ও ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সম্পদ গুনাহের বোঝায় পরিণত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য পেরেশানির কারণ হবে। তথাপি এক শ্রেণির মুসলমান জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত থাকে বা জাকাত প্রদান করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কেউ আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে সামান্য কিছু গরিব-দুঃখী মানুষকে জাকাত প্রদান করে থাকে। এটি যে লোক দেখানো বা সমাজের মানুষের কাছে দানবীর বা দাতা হিসেবে পরিচিতি লাভের আশায় করা হয়ে থাকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গচ্ছিত মালের শরিয়তের বিধান অনুযায়ী যত টাকা জাকাত প্রদান করা দরকার তা তারা করে না। যদি সঠিক হিসেব-নিকেশ করে জাকাত প্রদান করা হয়, তবে সমাজের অনেক অসহায়, গরিব, মিসকিন উপকৃত হবে।
এটা সকলেরই মনে রাখা চাই, ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। আর জাকাতের হকদার হলো—দুঃস্থ, গরিব, মিসকিন-অসহায় মানুষ। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতি ধনীদের এটা অনুগ্রহ নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা জাকাত ফরজ করার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলতে গেলে ধনীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, যারা জাকাতের হকদার তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের এই হক পৌঁছে দেওয়া। কাজেই জাকাত হলো, ধনীদের সম্পদের গরিবদের একটি হিস্যা, যা আদায় করা তাদের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য। কাজেই জাকাত ধনীদের পক্ষ হতে গরিবদের প্রতি কোনরূপ দয়া প্রদর্শন বা কৃপা করা নয়, অথবা জাকাত আদায় করা জরিমানাও নয়, বরং এটা নিরন্ন মানুষের ন্যায্য হিস্যা বা হক। ইসলামি জীবন ব্যবস্থার মূলভিত্তি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান। জাকাত আদায়ে জাকাত দাতার সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায় এবং তার অন্তর কৃপণতার কলুষ হতে মুক্তি লাভ করে। লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।
সুমি/হককথা