সাত বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৩
- / ৬৬ বার পঠিত
ক্রীড়া ডেস্ক : ‘দুর্নীতিতেই ডুবেছে ফুটবল’-এই শিরোনামে ২০১৬ সালে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। সেই সময় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে আজ হয়তো বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লজ্জার মুখে পড়তে হতো না। আর্থিক অনিয়মের কারণে বাফুফের বেতনভোগী সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা।
জাতীয় দলের সাবেক দুই প্রখ্যাত ফুটবলার শামসুল আলম মঞ্জু ও প্রয়াত বাদল রায় বাফুফের অনিয়ম তুলে ধরে ফিফার কাছে অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ ও ২ এপ্রিল শামসুল আলম মঞ্জুর স্বাক্ষর করা দুটি অভিযোগপত্র ফিফার সভাপতি ও এএফসির সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই অভিযোগপত্রের সঙ্গে ৩৮০ পৃষ্ঠার বাফুফের অনিয়মের বিভিন্ন নথি পাঠিয়েছিলেন মঞ্জু। ওই বছরের ৬ এপ্রিল ফিফার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মার্কুস কার্টনার মঞ্জুর অভিযোগ প্রাপ্তি স্বীকার করে লিখেছিলেন, ফিফা এ ব্যাপারে পর্যালোচনা করবে স্বাধীনভাবে। পরে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাফুফের বর্তমান সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগ করেছিলেন। তারই সূত্র ধরে ১৭ সেপ্টেম্বর বাফুফের প্রয়াত সহসভাপতি বাদল রায় সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সরাসরি অনিয়মের অভিযোগ এনেছিলেন।
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক ফরিদ আহমেদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই চিঠির সঙ্গে ছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন। বাফুফের ব্যাপক দুর্নীতি, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং ফুটবলকে আবার টেনে তোলার ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ সংবলিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আজ পর্যন্ত ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একসময় ফুটবল ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আজ বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ফুটবলের এ রুগ্ণ অবস্থার জন্য বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন দায়ী। বর্তমানে ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অথচ ফুটবলাঙ্গন বাংলাদেশের জন্য অপমান বয়ে আনছে। যার কোনো কারণ থাকা উচিত নয়।
প্রতিবেদনে ফুটবলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য বেশকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের চারিত্রিক দুর্বলতা, সভাপতির অদূরদর্শিতায় বাংলাদেশের জরিমানা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের প্রাইজমানি এবং প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সরাসরি সম্প্র্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়া করার নামে দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ভাঙিয়ে ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টের টিকিট দুর্নীতি, বাফুফের সভাপতি ও মাহফুজা আক্তার কিরনের যৌথ দুর্নীতি, সভার কার্যবিবরণী নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি, বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম, সিলেট বিকেএসপি ক্যাম্পাসে ফুটবল একাডেমির নামে দুর্নীতি, ফিফার প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক আস্ফালন উল্লেখযোগ্য।
এসব দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার চরম পর্যায়ে উপনীত কাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে শিগগিরই প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকারের ভাবমূর্তি ও ফুটবলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। সেই সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটন করে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের অর্জিত সম্পদের সঠিক হিসাব নির্ণয় করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সমাজের নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি কাজী সালাউদ্দিনের দুর্নিবার আসক্তি রয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। বিষয়গুলো একান্ত ব্যক্তিগত হলেও তার এ নৈতিক স্খলন বাফুফেকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে বলে অনেকেই মনে করেন। বাফুফের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায়ই বড় অঙ্কের টাকা উঠিয়ে কাজী সালাউদ্দিন বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে সময় কাটান বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।
আর এ অপকর্মে তাকে সহযোগিতা করেন বাফুফের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার আবু হোসেন। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সুযোগ না পাওয়া দলগুলো নিয়ে সলিডারিটি কাপের আয়োজন করে এএফসি। কিন্তু নিশ্চিত ভরাডুবি জেনে কাজী সালাউদ্দিন ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলকে না খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার এ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে এএফসি বাংলাদেশকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া ওই বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে নেপাল চ্যাম্পিয়ন হলেও তাদের প্রাইজমানির ৫০ হাজার ডলার আজও পরিশোধ করা হয়নি। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাঈম সোহাগের যোগসাজশে বাফুফের সাধারণ সভায় আয়-ব্যয়ের হিসাব অডিট রিপোর্টে ওই প্রাইজমানিসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে প্রাইজমানির প্রতীকী চেক নেপাল দলকে দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়ার নামে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের প্রচার স্বত্ব কিনেছিল চ্যানেল নাইন। চুক্তি অনুযায়ী চ্যানেল নাইনের কাছ থেকে পাওয়া টাকা কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি বিশেষমহল আত্মসাৎ করেছে। শুধু তাই নয়, টুর্নামেন্টের টেলিকাস্টিং যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় একটি কোম্পানির (রিয়েল ইমপেক্ট প্রাইভেট লি.) সহযোগিতায় ওই টাকা আত্মসাৎ করে বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ইউরো-২০১৬ ফুটবলের খেলা দেখার কথা বলে ওই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচের দুটি করে চারটি টিকিট সংগ্রহ করে বাফুফে।
সূত্রে জানা যায়, ৪টি টিকিটের প্রতিটি ১০ হাজার ডলার করে ৪০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেন কাজী সালাউদ্দিন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন মিলে একটি দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছেন। তাদের দুজনের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী বাফুফের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মো. আবু হোসেন। কাজী সালাউদ্দিনের সহযোগী হিসাবে মাহফুজা আক্তার কিরনের মতো আবু হোসেনও বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
ইস্টার্ন ব্যাংক লি. (মতিঝিল শাখা, অ্যাকাউন্ট নং ১০২১০৫০০০০৪৭৮৭) এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক লি. (মতিঝিল শাখা, অ্যাকাউন্ট নং-১০৮১১১০০০১৬৯৪৮)-এ থাকা আবু হোসেনের অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক পরিমাণ আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। এসব লেনদেন মূলত কাজী সালাউদ্দিনের কাছ থেকে পাওয়া দুর্নীতির অর্থের অংশবিশেষ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি মানিলন্ডারিংয়ের আরও অনেক আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। বাফুফের বিভিন্ন সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যবিবরণী সংশ্লিষ্ট সবার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হলেও পরে বাফুফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যোগসাজশে গোপনে পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত কার্যবিবরণীর আলোকে প্রচুর টাকা লুটপাট করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়।
বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা জমা ও উত্তোলন নগদে হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চেকের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি বাফুফের লেনদেনে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে ইঙ্গিত করে। এ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নগদ জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে কাজী সালাউদ্দিন গং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিলেটে বিকেএসপি’কে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ফুটবল একাডেমিতে পরিণত করা হয়। মূলত একাডেমির যাবতীয় উন্নয়ন কাজ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। অথচ গোপন সূত্র জানা যায়, ওই ফুটবল একাডেমির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বাফুফের নিজস্ব বলপ্রদর্শনের মাধ্যমে কাজী সালাউদ্দিন গং ব্যাপক দুর্নীতি করছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাফুফের অডিট রিপোর্ট সম্পর্কে বলা হয়, বাফুফের ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। ফিফার সভাপতির একদিনের খরচ দেখানো হয়েছিল ৯০ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৪ টাকা। জানা যায়, বাংলাদেশ সফরে সভাপতির যাবতীয় খরচ ফিফাই বহন করে। বাফুফের দেখানো খরচের তথ্য সঠিক নয়। কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা করেননি বা করতে সক্ষম নন। বরং তিনি নানাবিধ স্ট্যান্টবাজি করেন। ২০১১ সালে তিনি আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসিকে বাংলাদেশে আনেন এবং বাংলাদেশের ফুটবল একটি গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করছে এমন একটি আবহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন।
অথচ ভুটানের মতো দেশের কাছে হারা বাংলাদেশ ফুটবলের মৃতপ্রায় অবস্থাকেই এখন জানান দেয়। কাজী সালাউদ্দিনের স্ট্যান্টবাজি বাংলাদেশ ফুটবলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থা এবং জাতীয় লজ্জাকে লাঘব করতে পারেননি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের কারও কোনো মতামত গ্রহণ না করে এককভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে তিনি রাজনৈতিক আস্ফালন প্রকাশ করেন। সূত্র : যুগান্তর
বেলী / হককথা