নিউইয়র্ক ১০:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ইউরোপে শক্তি বাড়াচ্ছে চীন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:১০:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৩
  • / ৬৯ বার পঠিত

গুয়াংজুতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খোশগল্প করেন শি-ম্যাক্রোঁ। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক :  ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি চীনে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হলেও এ সফর পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথে চীনের অগ্রগতিকেই নির্দেশ করে। এর আগে কোনো পশ্চিমা দেশের এতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি চীন।

আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে এ সফরে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি বারবার আলোচিত হলেও এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতি। সফর শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, চীন ও ফ্রান্স ‘বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদার’। এ কথাটিই চীনের পরাশক্তি হওয়ার পথে অগ্রগতিকে নির্দেশ করে।

৫ এপ্রিল ম্যাক্রোঁ চীনে পৌঁছান। ৬ এপ্রিল রাতে একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নেন এবং ৭ এপ্রিল দুই নেতা দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গুয়াংজুতে যান। সেখানে শির পৈতৃক বাড়িতে তারা কিছুটা সময় কাটান। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শির প্রতি আহ্বান জানিয়ে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমি জানি, রাশিয়ার হুঁশ ফেরাতে এবং সবাইকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে আমি আপনার উপর নির্ভর করতে পারি। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় চীন ও ফ্রান্সের সামর্থ্য ও দায়িত্ব রয়েছে।’

বেসামরিক কাজে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উন্নয়ন, কার্বন-মুক্ত অর্থনীতিতে রূপান্তর, ইউরোপের এয়ারবাস বিমানের বিক্রয় এবং শূকরের মাংস আমদানির প্রতিশ্রুতির বাইরে এখানে রয়েছে ভূ-রাজনীতি। এমন এক সময়ে এ সফর হলো যখন চীন  ‍যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক তলানিতে, আবার ম্যাক্রোঁ একটি স্বাধীন ইউরোপীয় অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাইছেন। যেখানে তিনি বহুকেন্দ্র বিশিষ্ট বিশ্বব্যবস্থার কথা বলছেন। আর এখানেই মিল শি ও ম্যাক্রোঁর।

‍যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে একটি স্থিতিশীল বিশ্বের কথা ম্যাক্রোঁ অনেক আগে থেকেই বলছেন। এই সফরে সামগ্রিকভাবে ব্যাপক রপ্তানি বাণিজ্য এবং নতুন করে সাজানো সরবরাহ ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানোর উপায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তাইওয়ানের বিষয়ে নীরব অবস্থান দেখিয়েছে ফ্রান্স। সেই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাবের ১২ দফার বেশ কয়েকটির সঙ্গেও সহমত জানিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।

ইতিহাসের একটি নতুন পর্ব, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে, সেখানে ‍যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ম্যাক্রোঁ যখন চীনের বিশ্বব্যবস্থার অংশীদারিত্ব স্বীকার করে নেন, তা পশ্চিমাদের জন্য অস্বস্তিকরই বটে। ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সকে চীনা দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি দেখাতে বলেন, ‘বিশ্ব এখন এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা আগের ১০০ বছরেও দেখা যায়নি।’ শি গত মাসে মস্কোতে এক উষ্ণ রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। তবে এ নিয়ে ফরাসি নেতার অবস্থান মার্কিন নীতি থেকে ভিন্ন।

হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্য-পিয়েরে ক্যাবেস্তান বলেন, ‘চীনের সঙ্গে একটি গভীরতর শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ম্যাক্রোঁর এ সফর ভিন্ন বার্তা দেয়। ম্যাক্রোঁ চীনের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির দিকগুলোকে আলিঙ্গন করছেন।’ একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর ও টেকসই ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ব্লক দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শির মতোই অবস্থান ম্যাক্রোঁর। ইউরোপের বর্তমান প্রতিরক্ষা ন্যাটোকে ঘিরে আবৃত।

অথচ সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে ন্যাটো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। ভারসাম্য নষ্টের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটকেই দায়ী করে আসছে রাশিয়া ও চীন। চীনের শান্তি প্রস্তাবেও এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

চীনে ফ্রান্সের ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ২০২২ সালে দুই দেশের বাণিজ্য প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন ইউরো ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। যে কারণে ৬০ জনেরও বেশি শীর্ষস্থানীয় ফরাসি কোম্পানির প্রতিনিধিরা ম্যাক্রোঁর সফরসঙ্গী হয়েছেন, যাদের মধ্যে এয়ারবাস ও জ্বালানি জায়ান্ট ইডিএফের প্রধান নির্বাহীরাও রয়েছেন। ম্যাক্রোঁ চীনাদের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য।

তিনি কূটনীতিতে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন যেটা চীন পছন্দ করে। বেইজিং রওনা হওয়ার আগে ম্যাক্রোঁর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চীনই এখন একমাত্র দেশ যারা ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।’

ম্যাক্রোঁর এ সফরে তার সঙ্গেই ছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ফন ডার লেইন। তবে কোনো অনুষ্ঠানে বা সংবাদ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁর পাশে তাকে দেখা যায়নি। পৃথক সংবাদ সম্মেলনে উরসুলা বলেন, চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে তবে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এটি ইইউ ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি করবে।

তিনি আশা করেন যে বেইজিং এমন একটি ভূমিকা পালন করবে যা একটি ন্যায়সঙ্গত শান্তি প্রচার করে। তিনি ইউক্রেনের নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কির শান্তি পরিকল্পনার সমর্থনে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছেন, যাতে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। সুবিধামতো সময়ে এ আলোচনা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

চীন তার নিজস্ব শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে যা পশ্চিমা দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটি রাশিয়ার পক্ষে খুব বেশি সমর্থনমূলক। তবে জেলেনস্কি এতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং তিনি শির সঙ্গে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে এতে এখনো প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। গত নভেম্বরে বালিতে জি-২০ সম্মেলনে ‍যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে এই সফরটি পশ্চিমা কোনো নেতার সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ম্যাক্রোঁ বরাবরই নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে আগ্রহী। তিনি এই সফরের মাধ্যমে ইউক্রেন সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ নিশ্চিত করেন।

তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, ম্যাক্রোঁ জানেন যে গর্ব করার মতো বড় কোনো কূটনৈতিক অর্জন নিয়ে তার এই চীন সফর থেকে ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিষয়ে শির দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটছে না।

তবে এতে চীনের ভূমিকা ও ভূ-রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ম্যাক্রোঁ ছোট অগ্রগতি, পারস্পরিক মিল রয়েছে এমন ইস্যু এবং বাণিজ্য ও আলোচনার মাধ্যমে জড়িত থাকার সুবিধার উপর জোর দিয়েছেন। ফ্রান্স পশ্চিমা জোটের অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মানে এই নয় যে, এটি রাশিয়ার মিত্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে পারবে না।

ম্যাক্রোঁ সফরে ফরাসি ও চীনা কর্পোরেশন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে, যা তিনি এবং শি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার সফর সঙ্গীদের মধ্যে ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পী ও জাদুঘরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড় প্রতিনিধি দল ছিল।

চীন-ফ্রান্স সম্পর্ক যে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। গুয়াংজুতে যখন শির পৈতৃক নিবাসে দুই নেতা চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন, তখন শি ম্যাক্রোঁকে বলেন, ‘আপনি যদি আরও বেশি সময় ধরে এখানে থাকতে চান, তাহলে আপনাকে এখানে বসবাস করতে স্বাগত জানাই।’ মূলত এর মধ্য দিয়ে শি গোটা পশ্চিমাদেরই  ‍যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে চীনা নেতৃত্বাধীন নতুন বলয়ে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।- সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

 নাছরিন/হককথা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ইউরোপে শক্তি বাড়াচ্ছে চীন

প্রকাশের সময় : ০৫:১০:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক :  ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি চীনে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হলেও এ সফর পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথে চীনের অগ্রগতিকেই নির্দেশ করে। এর আগে কোনো পশ্চিমা দেশের এতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি চীন।

আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে এ সফরে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি বারবার আলোচিত হলেও এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতি। সফর শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, চীন ও ফ্রান্স ‘বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদার’। এ কথাটিই চীনের পরাশক্তি হওয়ার পথে অগ্রগতিকে নির্দেশ করে।

৫ এপ্রিল ম্যাক্রোঁ চীনে পৌঁছান। ৬ এপ্রিল রাতে একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে অংশ নেন এবং ৭ এপ্রিল দুই নেতা দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গুয়াংজুতে যান। সেখানে শির পৈতৃক বাড়িতে তারা কিছুটা সময় কাটান। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শির প্রতি আহ্বান জানিয়ে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমি জানি, রাশিয়ার হুঁশ ফেরাতে এবং সবাইকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে আমি আপনার উপর নির্ভর করতে পারি। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় চীন ও ফ্রান্সের সামর্থ্য ও দায়িত্ব রয়েছে।’

বেসামরিক কাজে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উন্নয়ন, কার্বন-মুক্ত অর্থনীতিতে রূপান্তর, ইউরোপের এয়ারবাস বিমানের বিক্রয় এবং শূকরের মাংস আমদানির প্রতিশ্রুতির বাইরে এখানে রয়েছে ভূ-রাজনীতি। এমন এক সময়ে এ সফর হলো যখন চীন  ‍যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক তলানিতে, আবার ম্যাক্রোঁ একটি স্বাধীন ইউরোপীয় অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাইছেন। যেখানে তিনি বহুকেন্দ্র বিশিষ্ট বিশ্বব্যবস্থার কথা বলছেন। আর এখানেই মিল শি ও ম্যাক্রোঁর।

‍যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে একটি স্থিতিশীল বিশ্বের কথা ম্যাক্রোঁ অনেক আগে থেকেই বলছেন। এই সফরে সামগ্রিকভাবে ব্যাপক রপ্তানি বাণিজ্য এবং নতুন করে সাজানো সরবরাহ ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানোর উপায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তাইওয়ানের বিষয়ে নীরব অবস্থান দেখিয়েছে ফ্রান্স। সেই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাবের ১২ দফার বেশ কয়েকটির সঙ্গেও সহমত জানিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।

ইতিহাসের একটি নতুন পর্ব, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নিয়েছে, সেখানে ‍যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ম্যাক্রোঁ যখন চীনের বিশ্বব্যবস্থার অংশীদারিত্ব স্বীকার করে নেন, তা পশ্চিমাদের জন্য অস্বস্তিকরই বটে। ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সকে চীনা দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি দেখাতে বলেন, ‘বিশ্ব এখন এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা আগের ১০০ বছরেও দেখা যায়নি।’ শি গত মাসে মস্কোতে এক উষ্ণ রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। তবে এ নিয়ে ফরাসি নেতার অবস্থান মার্কিন নীতি থেকে ভিন্ন।

হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্য-পিয়েরে ক্যাবেস্তান বলেন, ‘চীনের সঙ্গে একটি গভীরতর শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ম্যাক্রোঁর এ সফর ভিন্ন বার্তা দেয়। ম্যাক্রোঁ চীনের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির দিকগুলোকে আলিঙ্গন করছেন।’ একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর ও টেকসই ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ব্লক দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শির মতোই অবস্থান ম্যাক্রোঁর। ইউরোপের বর্তমান প্রতিরক্ষা ন্যাটোকে ঘিরে আবৃত।

অথচ সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে ন্যাটো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। ভারসাম্য নষ্টের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটকেই দায়ী করে আসছে রাশিয়া ও চীন। চীনের শান্তি প্রস্তাবেও এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

চীনে ফ্রান্সের ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ২০২২ সালে দুই দেশের বাণিজ্য প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন ইউরো ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। যে কারণে ৬০ জনেরও বেশি শীর্ষস্থানীয় ফরাসি কোম্পানির প্রতিনিধিরা ম্যাক্রোঁর সফরসঙ্গী হয়েছেন, যাদের মধ্যে এয়ারবাস ও জ্বালানি জায়ান্ট ইডিএফের প্রধান নির্বাহীরাও রয়েছেন। ম্যাক্রোঁ চীনাদের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য।

তিনি কূটনীতিতে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন যেটা চীন পছন্দ করে। বেইজিং রওনা হওয়ার আগে ম্যাক্রোঁর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চীনই এখন একমাত্র দেশ যারা ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।’

ম্যাক্রোঁর এ সফরে তার সঙ্গেই ছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ফন ডার লেইন। তবে কোনো অনুষ্ঠানে বা সংবাদ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁর পাশে তাকে দেখা যায়নি। পৃথক সংবাদ সম্মেলনে উরসুলা বলেন, চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে তবে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এটি ইইউ ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি করবে।

তিনি আশা করেন যে বেইজিং এমন একটি ভূমিকা পালন করবে যা একটি ন্যায়সঙ্গত শান্তি প্রচার করে। তিনি ইউক্রেনের নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কির শান্তি পরিকল্পনার সমর্থনে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছেন, যাতে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। সুবিধামতো সময়ে এ আলোচনা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

চীন তার নিজস্ব শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে যা পশ্চিমা দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটি রাশিয়ার পক্ষে খুব বেশি সমর্থনমূলক। তবে জেলেনস্কি এতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং তিনি শির সঙ্গে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে এতে এখনো প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। গত নভেম্বরে বালিতে জি-২০ সম্মেলনে ‍যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে এই সফরটি পশ্চিমা কোনো নেতার সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ম্যাক্রোঁ বরাবরই নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে আগ্রহী। তিনি এই সফরের মাধ্যমে ইউক্রেন সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ নিশ্চিত করেন।

তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, ম্যাক্রোঁ জানেন যে গর্ব করার মতো বড় কোনো কূটনৈতিক অর্জন নিয়ে তার এই চীন সফর থেকে ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিষয়ে শির দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটছে না।

তবে এতে চীনের ভূমিকা ও ভূ-রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ম্যাক্রোঁ ছোট অগ্রগতি, পারস্পরিক মিল রয়েছে এমন ইস্যু এবং বাণিজ্য ও আলোচনার মাধ্যমে জড়িত থাকার সুবিধার উপর জোর দিয়েছেন। ফ্রান্স পশ্চিমা জোটের অংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মানে এই নয় যে, এটি রাশিয়ার মিত্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে পারবে না।

ম্যাক্রোঁ সফরে ফরাসি ও চীনা কর্পোরেশন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে, যা তিনি এবং শি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার সফর সঙ্গীদের মধ্যে ব্যবসায়ী নেতা, শিল্পী ও জাদুঘরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড় প্রতিনিধি দল ছিল।

চীন-ফ্রান্স সম্পর্ক যে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। গুয়াংজুতে যখন শির পৈতৃক নিবাসে দুই নেতা চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন, তখন শি ম্যাক্রোঁকে বলেন, ‘আপনি যদি আরও বেশি সময় ধরে এখানে থাকতে চান, তাহলে আপনাকে এখানে বসবাস করতে স্বাগত জানাই।’ মূলত এর মধ্য দিয়ে শি গোটা পশ্চিমাদেরই  ‍যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে চীনা নেতৃত্বাধীন নতুন বলয়ে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।- সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

 নাছরিন/হককথা