বাংলাদেশের অর্থনীতি : ৫০ বছরে কোথায়?
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৬:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩
- / ৫৪ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : আমাদের প্রজন্মের যাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল তাদের জন্য ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় ছিল একটি মহান বিজয়। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে এতো তাড়াতাড়ি আমরা স্বাধীন হতে পারবো। সেই সময়টাতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক দুর্ভাবনা শোনা যাচ্ছিলো। মূলত এসব দুর্ভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশ যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটি একটা টেকসই রাষ্ট্র হবে না। মূলত এই ধারণা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে একটি ভিক্ষার ঝুলি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিসিঞ্জারের পর সেই সময়ের অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও অনেকেই তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিক তত্ত্বের একটি অগ্নিপরীক্ষা বা টেস্ট কেইস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর অবশ্য আমাদের পুনর্গঠনের জন্য লেগেছে। পাকিস্তানি সেনারা অত্যন্ত নির্মমভাবে আমাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোকে ধ্বংস করেছিল। ধ্বংস করেছিল আমাদের অবকাঠামোকে কিন্তু তা সত্ত্বেও পুনর্গঠনের পর্যায় অতিক্রম করার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দ্রুত হয় নব্বুইয়ের এর দশক থেকে। তখন শুরু করে এখন পর্যন্ত গত ৩ দশকে বাংলাদেশে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে গেছে এবং আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। মানবসম্পদের দিক থেকেও বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেছে। আগের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য আমরা উৎপাদন করতে পারছি। শুধু তাই নয় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়েছে। এসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ কখনোই ভিক্ষার ঝুলি ছিল না। তবে এই অগ্রগতির দুটো দিক আমি বিশেষভাবে তুলে ধরতে চাই। প্রথম দিকটি হল বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন চলেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে তারচেয়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে গনতান্ত্রিক শাসনামলে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই প্রমাণ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি ত্বরান্বিত হয় এবং মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়।
আরোও পড়ুন । বিশ্ব জুড়ে ব্যাংকের শেয়ারে ধস, সুইস ব্যাংকের শেয়ারের ব্যাপক দরপতন
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আরেকটি বিশেষত্ব হল আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা এবং সুশাসনের ঘাটতি থাকার পরেও অনেক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সরকারের সাফল্য নয়, এটা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের সাফল্য। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ আর অশিক্ষিত কৃষকেরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে গত পাঁচ দশকে। বাংলাদেশের মহিলারা পোশাকশিল্পের সাথে যুক্ত হয়ে এবং ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমের কুটির শিল্পের কাজ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশে কাজ করে দেশে টাকা পাঠিয়েছে, সেটিও আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে অনেক। দরিদ্র মানুষের সাফল্য আমাদের প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এসব অর্জনের জন্য আমাদের যেমন গর্ব করার প্রয়োজন রয়েছে, সাথে সাথে আমাদের সতর্কও থাকা প্রয়োজন রয়েছে। এই সতর্কতার দিকগুলোকে তুলে ধরার আগে আমি আমাদের প্রবৃদ্ধির পথে তিনটি বড় অন্তরায়ের কথা তুলে ধরতে চাই। প্রথমত বাংলাদেশের জনসংখ্যা। আমাদের এখানে ১৬ কোটির বেশি লোক বাস করে।বাংলাদেশের উন্নোয়নের ধারাগুলোকে টেকসই করতে জনসংখ্যাকে বিবেচনায় রাখা খুব জরুরী। আমাদের দ্বিতীয় অন্তরায় পরিবেশ দূষণ। এটি একটি মারাত্মক সমস্যা এবং এই সমস্যার এখন পর্যন্ত কোন স্থায়ী সমাধান আমরা করতে পারিনি। তৃতীয়ত আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী দরিদ্রসীমার বাইরে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এখনো আমাদের দারিদ্রসীমা বিভিন্ন কারণে বেড়ে যেতে পারে। যেমন কোভিডের সময় অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। আবার আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা দারিদ্রের সীমা নির্ধারণ করি সত্তুরের দশকের অতিনিম্ন মাথাপিছু আয়ের সাথে তুলনা করে। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছে এবং পৃথিবীরর সাথে তুলনামূলকভাবে বিবেচনা করলে আমরা দেখবো এখনো আমাদের দেশে অনেক দরিদ্র মানুষ রয়েছে।
দারিদ্রের যেসব মাপকাঠি রয়েছে, সেসবেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন যদি কেউ দারিদ্রসীমা অতিক্রম করে তাহলে আশা করা হবে তার সুপেয় পানি পান করার সুযোগ আছে। নব্বুয়ের দশকে আমাদের দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পান করত বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কারণে এখন মাত্র ৫০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পান করে। যে মানুষ সুপেয় পানি পায় না তাকে দারিদ্রসীমার উপরের মানুষ বলে গণ্য করা যায় না। এরকম অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নাজুক অবস্থায় আছি। এই প্রবৃদ্ধিকে সুসংহত করার জন্য আমাদের আরও কমপক্ষে এক দশক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি তা হল এখনো আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
আরোও পড়ুন । জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছে: কাদের
সুশাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা কেবল একটি কাজই করেছি, তা হল ডিজিটালাইজেশন। কিন্তু শুধু কম্পিউটার দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবশ্যই সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এছাড়া আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন সম্পর্কে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয়ে তেমন কোন উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না। আমাদের দেশে উন্নোয়ন বলতে বোঝা হয় বড় বড় প্রজেক্ট। অবকাঠামোতে আমাদের অনেক ঘাটতি আছে সত্য। ফলে মেগা প্রজেক্ট আমাদের দরকার আছে। যেমন আমাদের পদ্মা ও যমুনা সেতুর দরকার আছে। তবে এর বাইরে যেসব মেগা প্রজেক্ট আছে সেগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়েছে কি-না তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। সঠিকভাবে মূল্যায়ন হলেও এতো বেশি পরিমাণ মেগা প্রজেক্ট একসাথে সম্পাদনা করার সক্ষমতা আমাদের নাই। যদি সম্পাদনা ক্ষমতা না থাকার পরেও আমরা এতগুল মেগাপ্রজেক্ট একসাথে চালাতে চাই তাহলে দিনশেষে আমাদের চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অশুভ প্রবণতা হল বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের বেশিরভাগ ধনীদের মাঝে পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু আয় কমছে। আমরা যদি ধনীদের ক্রমাগত ধনী হওয়া আর গরীবদের গরীব হওয়ার এই প্রবণতাকে ঠেকাতে না পারি, তাহলে এটি বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি ও উন্নোয়নের পথে বিরাট অন্তরায় হতে পারে। আমরা আশা করবো যে আমরা একদিন না একদিন অবশ্যই আরও সফল হব এবং দুনিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাথাউচু করে দাঁড়াতে পারবো। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। সূত্র : একাত্তর
সাথী / হককথা