৪০ বিশ্বনেতার বিজ্ঞাপন-বিবৃতি ও রাজনীতির দড়ি
- প্রকাশের সময় : ১১:৪৮:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ মার্চ ২০২৩
- / ১১৩ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ‘সরকার পতনের আর বেশি দেরি নেই’, ‘আর একটা ধাক্কা দিলেই সরকার পড়ে যাবে’ কিংবা ‘একটু জোরে ফুঁ দিলে’ বা ‘কাতুকুতু’ দিলেই সরকার পড়ে যাবে—বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে এমন কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। বিশেষ করে সরকারের বিরোধী পক্ষ যারা, তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকার পতনের ‘ডাক দেওয়া হবে’—এমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু ওই যে বাউলসম্রাটের গানে আছে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’—ঠিক সে রকম সময় চলে যাচ্ছে, সাধন হচ্ছে না। কারণ যোগে মিলছে না। কিন্তু তা বলে মুখ বুজে তো আর বসে থাকা যায় না। কথা বলতে হবে। বিশেষ করে বিরোধী দলের রাজনীতিতে কোনো কাজ না থাকলে বা জনগণের কাছে যাওয়ার কোনো উপলক্ষ কিংবা কর্মসূচি না থাকলে গলাবাজি করে হলেও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়। সেই কাজটি এ দেশের বিরোধী পক্ষ নিয়মিতই করে থাকে। ‘অতি পুরাতন ভাব নব আবিষ্কার’-এর মতো ১০ দফা থেকে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ এবং শেষ পর্যন্ত সরকারকে চলে যেতে হবে—এই এক দফায় দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি ও তার সমমনারা।
বিএনপি কখন কী বলে বা কখন কী বলতে পারে, এ নিয়ে আগাম কোনো আভাস দেওয়ার সুযোগ নেই। পাঠকদের মনে থাকার কথা, বিএনপির দুই নেতা (কখনো ক্ষমতায় গেলে) দেশের সংবিধান পরিবর্তন করা হবে এমন কথা বলেছিলেন। কারণ তাঁদের মতে, তখন ‘যাঁরা সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের উপযুক্ত লোক ছিলেন না, দুই-একজন ছাড়া। তাঁদের নাকি কেউ ভোট দিয়ে এই কনস্টিটিউশন বানানোর জন্য অথরিটিও দেয় নাই।’ এবার বিএনপি মহাসচিব ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল, সেটিকে ‘কাটাছেঁড়া’ করায় আক্ষেপ করেছেন। তাঁর মতে, ‘যে সংবিধান ১৯৭২ সালে এই দেশের মানুষ রচনা করেছিল, সেটা সবাই মেনে নিয়েছিল।’ তিনি স্বীকার করেছেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধানে যে মৌলিক বিষয় ছিল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটা জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা।’
আরোও পড়ুন । সম্পাদকীয় : রোহিঙ্গা প্রশ্নে ত্রিদেশীয় বৈঠক
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি আবার বলেছেন, ‘‘সংসদ বিলুপ্ত না করলে ‘সরকারের ফায়সালা’ রাজপথে করা হবে।” দড়ি ধরে টান মারার সময় এসেছে, এমন কথাও বলেছেন তিনি। বিএনপি মহাসচিবের মুখে এর আগে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার কথা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু দড়ি ধরে টান মারার কথা এই প্রথম উচ্চারিত হলো। এর আগে একাধিকবার ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার কথা বললেও ধাক্কাটা মারবে কে, সে কথা কখনো বলেননি তিনি। ধাক্কাটা মারবে কে, এ প্রশ্ন করার অধিকার তো যে কারো আছে। আর এই প্রথম তিনি দড়ি ধরে টান মারার কথা উচ্চারণ করলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারের কোমরে দড়িটা বাঁধল কে? টানই বা মারবে কে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি সূত্রের সন্ধান করা যাক। সেদিন জানা গেল, কোনো একটি বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতা গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় পূর্ণ পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ এমনই গুরুত্বপূর্ণ সেই চিঠি যে সেটা সংবাদমূল্য বিবেচনায় নয়, এই আক্রার বাজারে ডলার খরচ করে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করতে হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করে তাঁরা লিখছেন যে ‘বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তাঁরা এই দেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করেন। তাঁদের মধ্যে সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সুধীসমাজের নেতা ও সমাজসেবক আছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো তাঁরাও বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও সারা বিশ্বে গৃহীত উদ্ভাবনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত।’ এতে তো আমাদের আহ্লাদিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতা যখন বলেন, ‘বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো তাঁরাও বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও সারা বিশ্বে গৃহীত উদ্ভাবনগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত।’ তখন আমাদের অবস্থা ‘দারোগায় বলেছে চাচি…’—অনেকটা সে রকম হওয়ার কথা! কিন্তু আমরা তো ঘর পোড়া গরু। স্বাভাবিকভাবেই সিঁদুরে মেঘে আমাদের ভয়। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের ‘নাক গলানোর’ ইতিহাস আছে।
তো রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতা যখন বিজ্ঞাপন দিয়ে হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন, তখন তো ধরে নিতেই হবে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার পুরো চিঠিটি পড়লে এমন সন্দেহও হয় যে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’ এই খোলা চিঠিতে ৪০ বিশ্বনেতা তাঁদের একটি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, ‘সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে চিরায়ত ও সামাজিক উদ্যোক্তারা প্রস্ফুটিত হতে পারেন।’ তাঁদের মতে, ‘টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিতে কিভাবে একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে লালন করা যেতে পারে সে বিষয়ে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে বাংলাদেশ তার ভূমিকায় ফিরে আসবে।’ এ ক্ষেত্রে প্রথম একটি ভালো উদ্যোগ কী হওয়া উচিত, সেটা উল্লেখ করতেও ভুল করেননি তাঁরা।
আরোও পড়ুন । সম্পাদকীয় : বিদায় ম্যারাডোনা
আর এখানেই মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে লেখা ৪০ বিশ্বনেতার এই খোলা চিঠি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কোনো রূপরেখা তাঁদের এই চিঠিতে নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। রিজার্ভের ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে। ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো’ বাংলাদেশের ওপর চেপে বসে আছে রোহিঙ্গা সংকট। সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা সংকট থেকে বিশ্বের মনোযোগ সরে গেছে, যা রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক নয়। মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া না দিলেও বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে ফিরে যাক। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতার এই খোলা চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তাহলে আমরা কী করে বিশ্বাস করব যে তাঁরা বাংলাদেশের বন্ধু? তাঁরা বাংলাদেশের জনগণের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা করেন—এ কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? নাকি উল্টো সন্দেহটাই সামনে এসে পড়ে? কী সেই সন্দেহ? কী আবার, সেই ‘অতি পুরাতন ভাব নব আবিষ্কার’। আবার কি ওয়ান-ইলেভেন? আবার কি অনির্বাচিত সরকার? আবার কি নির্বাসনে সংবিধান? নাকি নির্বাচনেই বেছে নেওয়া হবে আগামী দিনের সরকার?
আচ্ছা, কারো মনে কি এমন সন্দেহ দেখা দিচ্ছে না যে ৪০ বিশ্বনেতার নামে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি পুরোটাই ভুয়া। হয়তো কোনো লবিস্ট ফার্ম এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। এই ৪০ বিশ্বনেতা তো নিজেরাই একেকটি প্রতিষ্ঠান। তাঁরা চাইলে তো সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করতে পারেন। সরাসরি চিঠিও লিখতে পারেন। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁরা চিঠি প্রকাশ করতে যাবেন কেন? শুনতে পাচ্ছি, বিজ্ঞাপনটি নাকি ওয়াশিংটন পোস্টের অনলাইন থেকে তুলেও নেওয়া হয়েছে। সত্যি কি? তাহলে তো বলতে হবে এটা একটা ‘ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট’। অবশ্য সব বিনিয়োগ সব সময় লাভজনক হয় না। লাভ-ক্ষতি মেনেই তো বাণিজ্য করতে হয়। তার মানে বিএনপি টান মারার দড়িটা হারিয়ে ফেলেছে। সূত্র : কালের কন্ঠ
সাথী / হককথা