নিউইয়র্ক ০৭:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বাংলা ভাষা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:০৩:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • / ৫২ বার পঠিত

বাংলাদেশ  ডেস্কঃ পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা সাত হাজারের মতো। এই ভাষাগুলোর মধ্যে কথা বলা মানুষের দিক থেকে বাংলার স্থান পঞ্চম। এটা উইকিপিডিয়ার তথ্য। অন্য এক তথ্য অনুসারে সপ্তম। সপ্তম বা পঞ্চম যা-ই হোক, উইকিপিডিয়া বলছে বাংলা ভাষায় কথা বলে ৩০ কোটি মানুষ। এটি তাদের মাতৃভাষা। এ ছাড়া আরো তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ আছে, যাদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। এই হিসাবটা বছর দুই আগের। এর মধ্যে আরো বেড়েছে নিঃসন্দেহে। জনসংখ্যার দিক থেকে কথা বলা জনগোষ্ঠীর ক্রমটা এ রকম : ম্যান্ডারিন (চীনা), স্প্যানিশ, ইংরেজি ও হিন্দি।

বাংলা ভাষার জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশের সরকারি ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ত্রিপুরায়ও বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। বড় একটা অংশ আছে মধ্যপ্রাচ্যে। তারা কর্মসূত্রে সেখানে বসবাস করছে। আরো অনেক বাংলাভাষী আছে, যারা ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে আছে; আছে উত্তর আমেরিকা, অর্থাৎ আমেরিকা ও কানাডায়, আছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়ায়ও আছে বাংলাভাষী কিছু মানুষ। ফলে দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে বাংলাভাষীরা। কিন্তু সেই তুলনায় আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা এখনো উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি। এই স্থান করে নেওয়া বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, সেটা বললেই বোঝা যাবে বাংলা কেন প্রভাবশালী ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি।

যেকোনো ভাষাকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে গেলে বিশ্বজনীন হতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা এখনো বিশ্বজনীন হয়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের অভাব। ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে দেশগুলো বাণিজ্যিক দিক থেকে এগিয়ে সেই দেশগুলোর ভাষা একসময় এই বাণিজ্যিক কারণেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিক লেনদেনের সুবিধার্থে যারা এই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রয়োজনীয় ভাষাটা শিখে নিয়েছে, তাদের শিখতে হয়েছে। এটি ঘটে মূলত যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য। বাংলা এ দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এটি এখনো পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষের কাছে প্রয়োজনের ভাষা হয়ে ওঠেনি। যোগাযোগের ভাষাও নয়। কারণটা খুব সহজ। বাংলাদেশের পণ্য—কি রপ্তানিতে, কি আমদানিতে—বিশ্ববাণিজ্যের মানচিত্রে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। আমরা যে পণ্যটি মূলত রপ্তানি করি সেটা হচ্ছে গার্মেন্ট। পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশে তৈরি এই পণ্যটি নেয়। সেসব পণ্যে বাংলাদেশের নামটা প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে লেখা থাকে। কিন্তু ওইটুকুই। যে দেশগুলো আমাদের গার্মেন্ট পণ্য নেয়, তারা শুরু থেকেই ইংরেজিতে যোগাযোগ করে আসছে। বাংলা ভাষা শেখার বা বাংলায় যোগাযোগ করার প্রয়োজন তাদের হয় না। অদূর ভবিষ্যতে এ অবস্থার যে কোনো পরিবর্তন ঘটবে, সে সম্ভাবনাও নেই।

বাংলা ভাষা দ্বিতীয় যে কারণে বিশ্বভাষা হয়ে উঠতে পারেনি সেটা হলো বাংলা শিক্ষার ভাষা নয়। বাংলাদেশের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, কিন্তু অন্য দেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে বাংলা ভাষা কোনো কাজে আসে না। কিন্তু ইংরেজির কথা যদি বলি, ইংরেজিতে পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষা লাভ করা যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি (বাংলা বিষয়টি ছাড়া)। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্য তিনটি ভাষায় উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার সুযোগ আছে। ফ্রান্সে ফরাসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম। এ ছাড়া সাবেক ফরাসি কলোনিগুলোতে, যে দেশগুলো পরে স্বাধীন হয়েছে সেখানে উপনিবেশের ভাষা অর্থাৎ ফরাসির প্রাধান্য। আফ্রিকার এ রকম বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের শিক্ষার মাধ্যম ফরাসি।

তবে ফরাসির তুলনায় আরো বেশি প্রসার ঘটেছে আরেকটি ভাষার। সেটি স্প্যানিশ। এর প্রধান কারণ, লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের মানুষের প্রধান ভাষা স্প্যানিশ। এটি একটি মহাদেশ। মোট দেশের সংখ্যা ৩৩। লাতিন আমেরিকার একমাত্র দেশ ব্রাজিল, যার ভাষা পর্তুগিজ। জনসংখ্যার দিক থেকে স্প্যানিশের অবস্থান আমেরিকায় দ্বিতীয়। স্প্যানিশ ভাষাটি তাই আমেরিকার শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম। আমেরিকায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে স্প্যানিশ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা যায়। দেশটির গা ঘেঁষে লাতিন দেশগুলোর অবস্থান বলে আমেরিকায় স্প্যানিশ ভাষার এতটা রমরমা। সেই সঙ্গে স্প্যানিশভাষী স্পেনের প্রভাবও আমেরিকায় কম নয়। স্পেন ও লাতিন আমেরিকা থেকে বহু মানুষ বহুকাল ধরে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছে। ফলে এই ভাষাটা একদিকে স্পেন, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার কারণে আমেরিকার দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পেয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে স্প্যানিশভাষী মানুষ।

স্প্যানিশ অঞ্চলে স্প্যানিশ ছাড়া অন্য ভাষার প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিকভাবেও এই ভাষাটি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আরেকটি কারণে স্প্যানিশ ভাষার প্রভাব বিশ্বব্যাপী আমরা লক্ষ করব। সেটা হলো এই ভাষার সাহিত্য। লাতিন সাহিত্য এতটাই সমৃদ্ধ যে যাঁরা এই সাহিত্য মূল স্প্যানিশ ভাষায় পড়তে চান তাঁরা ভাষাটি শিখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশেই যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রে জানি, মূল ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পড়ার জন্য অনেকেই এই ভাষাটা শিখেছেন ও শিখছেন। অন্য দেশেও এটি ঘটছে। সে তুলনায় আমাদের সাহিত্য এখনো বিশ্বপরিসরে পরিচিতি পায়নি। এই পরিচিতিটা অর্জন করলে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মানুষ আগ্রহী হতে পারতেন।

সমস্যাটা হচ্ছে অনুবাদের। অনুবাদের অভাব। আমাদের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ নেই বললেই চলে। ইংরেজি ভাষায় যদি প্রথমে অনূদিত হতো, তাহলে আমাদের সাহিত্য বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে পড়ত। এখানে বলা প্রয়োজন, বাঙালি অনুবাদক নয়, আমাদের দরকার নেটিভ ইংরেজিভাষী অনুবাদক। বাংলা ভাষার দক্ষ একজন লেখক-কবির সঙ্গে একজন নেটিভ ইংরেজিভাষী যৌথভাবে অনুবাদের কাজটি করলে সেই অনুবাদ মানসম্পন্ন হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে কোথায়। ফলে সাহিত্যের মাধ্যমে যে আমরা বিশ্ব জয় করব, সেটা ঘটছে না। বাংলা ভাষার প্রভাবও আমরা লক্ষ করছি না।

শিক্ষার কথা বলি এবার। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব পর্যায়ে আমাদের কোনো অবস্থানই নেই। এটা থাকলে আমরা যদি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দান করে বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশেই অন্য অনেক দেশের শিক্ষার্থী পড়তে আসত। আর তারা তখন বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলে বাংলা ভাষার প্রসার বাড়তই। যেমনটা দেখি জাপানে, চীনে, জার্মানিতে, ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, কানাডায়। এসব দেশে বিশ্বের অন্য দেশের বহু শিক্ষার্থী পড়তে যায়, তারা শিক্ষা লাভ করে চীনা, জাপানি, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ভাষায়। এই ভাষা মাধ্যমগুলো একেবারেই আবশ্যকীয় করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। কিন্তু ভাবুন তো বাংলাদেশের কথা, কে আসবে আমাদের দেশে পড়তে? কেনই বা আসবে? আমরা তো বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারিনি। পারিনি গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে। আমাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো নড়বড়ে হয়ে আছে। কিন্তু আমরা যদি বিশ্বমানের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারতাম, কল্পনা করতে দোষ কি, বিদেশি শিক্ষার্থীরা হয়তো বাংলাদেশে আসত। বাংলা মাধ্যম তারা পড়ত। বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রভাব বিশ্বজনীন হয়ে উঠত। কিন্তু হায়, এটা এখন আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। অথচ ছোট্ট সিঙ্গাপুরের দিকে তাকান, একটিমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ওদের; এশিয়ার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ঠিকই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।

এবার উপসংহার টানি। আমাদের ভাষাপ্রেম অবিস্মরণীয়। ভাষা আন্দোলনই তার প্রমাণ। আমি এই লেখাটা শুরুর আগে একটু ইন্টারনেটে ঢু মারছিলাম। এমন কোনো লেখা পাই কি না, যেখানে ভাষার বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার কথা বলা আছে। সে রকম কোনো লেখা পাইনি, সময়ের অভাবেই বলতে পারি। কিন্তু একটা লেখায় আমার চোখ আটকে গেল। সেই লেখাটায় বাংলা ভাষা এখনো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। লেখাটি ইংরেজিতে, লিখেছেন একজন বিদেশি। সেখানে তিনি বলছেন, বাংলা ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাষা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ মাতৃভাষার সচেতনতার বিষয়টি বাঙালিরাই বুঝিয়ে দিতে পেরেছে।

আরোও পড়ুন। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ভাষা কী আধিপত্যের শিকার?

বাঙালিরা তাদের ভাষাকে খুবই ভালোবাসে। এই ভাষার সূত্র ধরেই তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ভাষা, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার ভাষার সূত্রেই যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এর সবই ভাষা আন্দোলনের অবদান। কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের এই ভাষাপ্রেম বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎস হতে পারায়। এ সবই আমাদের গৌরবের দিক। কিন্তু বাংলা ভাষা এখনো বিশ্বভাষার স্তরে উন্নীত হতে পারেনি মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো অবস্থান নেই বলে। শিক্ষা ও সাহিত্যের দিক থেকেও আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম হয়ে উঠবে। বাংলা ভাষাও বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে। পাবে বিশ্বের প্রধান একটি ভাষার মর্যাদা। না, জনসংখ্যার দিক থেকে শুধু নয়, সেটা তো আমরা অর্জন করে ফেলেছিই, এখন প্রয়োজন একটি প্রভাবশালী বিশ্বভাষা হয়ে ওঠা। আপাতত পরিস্থিতিটা যদিও আশানুরূপ নয়, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? সূত্রঃ কালের কন্ঠ

হককথা/সুমি

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বাংলা ভাষা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান

প্রকাশের সময় : ০২:০৩:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

বাংলাদেশ  ডেস্কঃ পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা সাত হাজারের মতো। এই ভাষাগুলোর মধ্যে কথা বলা মানুষের দিক থেকে বাংলার স্থান পঞ্চম। এটা উইকিপিডিয়ার তথ্য। অন্য এক তথ্য অনুসারে সপ্তম। সপ্তম বা পঞ্চম যা-ই হোক, উইকিপিডিয়া বলছে বাংলা ভাষায় কথা বলে ৩০ কোটি মানুষ। এটি তাদের মাতৃভাষা। এ ছাড়া আরো তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ আছে, যাদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। এই হিসাবটা বছর দুই আগের। এর মধ্যে আরো বেড়েছে নিঃসন্দেহে। জনসংখ্যার দিক থেকে কথা বলা জনগোষ্ঠীর ক্রমটা এ রকম : ম্যান্ডারিন (চীনা), স্প্যানিশ, ইংরেজি ও হিন্দি।

বাংলা ভাষার জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। বাংলাদেশের সরকারি ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ত্রিপুরায়ও বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। বড় একটা অংশ আছে মধ্যপ্রাচ্যে। তারা কর্মসূত্রে সেখানে বসবাস করছে। আরো অনেক বাংলাভাষী আছে, যারা ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে আছে; আছে উত্তর আমেরিকা, অর্থাৎ আমেরিকা ও কানাডায়, আছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়ায়ও আছে বাংলাভাষী কিছু মানুষ। ফলে দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে বাংলাভাষীরা। কিন্তু সেই তুলনায় আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা এখনো উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি। এই স্থান করে নেওয়া বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, সেটা বললেই বোঝা যাবে বাংলা কেন প্রভাবশালী ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি।

যেকোনো ভাষাকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে গেলে বিশ্বজনীন হতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা এখনো বিশ্বজনীন হয়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের অভাব। ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে দেশগুলো বাণিজ্যিক দিক থেকে এগিয়ে সেই দেশগুলোর ভাষা একসময় এই বাণিজ্যিক কারণেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিক লেনদেনের সুবিধার্থে যারা এই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রয়োজনীয় ভাষাটা শিখে নিয়েছে, তাদের শিখতে হয়েছে। এটি ঘটে মূলত যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য। বাংলা এ দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এটি এখনো পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষের কাছে প্রয়োজনের ভাষা হয়ে ওঠেনি। যোগাযোগের ভাষাও নয়। কারণটা খুব সহজ। বাংলাদেশের পণ্য—কি রপ্তানিতে, কি আমদানিতে—বিশ্ববাণিজ্যের মানচিত্রে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। আমরা যে পণ্যটি মূলত রপ্তানি করি সেটা হচ্ছে গার্মেন্ট। পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশে তৈরি এই পণ্যটি নেয়। সেসব পণ্যে বাংলাদেশের নামটা প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে লেখা থাকে। কিন্তু ওইটুকুই। যে দেশগুলো আমাদের গার্মেন্ট পণ্য নেয়, তারা শুরু থেকেই ইংরেজিতে যোগাযোগ করে আসছে। বাংলা ভাষা শেখার বা বাংলায় যোগাযোগ করার প্রয়োজন তাদের হয় না। অদূর ভবিষ্যতে এ অবস্থার যে কোনো পরিবর্তন ঘটবে, সে সম্ভাবনাও নেই।

বাংলা ভাষা দ্বিতীয় যে কারণে বিশ্বভাষা হয়ে উঠতে পারেনি সেটা হলো বাংলা শিক্ষার ভাষা নয়। বাংলাদেশের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, কিন্তু অন্য দেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে বাংলা ভাষা কোনো কাজে আসে না। কিন্তু ইংরেজির কথা যদি বলি, ইংরেজিতে পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষা লাভ করা যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি (বাংলা বিষয়টি ছাড়া)। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্য তিনটি ভাষায় উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার সুযোগ আছে। ফ্রান্সে ফরাসি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম। এ ছাড়া সাবেক ফরাসি কলোনিগুলোতে, যে দেশগুলো পরে স্বাধীন হয়েছে সেখানে উপনিবেশের ভাষা অর্থাৎ ফরাসির প্রাধান্য। আফ্রিকার এ রকম বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের শিক্ষার মাধ্যম ফরাসি।

তবে ফরাসির তুলনায় আরো বেশি প্রসার ঘটেছে আরেকটি ভাষার। সেটি স্প্যানিশ। এর প্রধান কারণ, লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের মানুষের প্রধান ভাষা স্প্যানিশ। এটি একটি মহাদেশ। মোট দেশের সংখ্যা ৩৩। লাতিন আমেরিকার একমাত্র দেশ ব্রাজিল, যার ভাষা পর্তুগিজ। জনসংখ্যার দিক থেকে স্প্যানিশের অবস্থান আমেরিকায় দ্বিতীয়। স্প্যানিশ ভাষাটি তাই আমেরিকার শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম। আমেরিকায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে স্প্যানিশ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা যায়। দেশটির গা ঘেঁষে লাতিন দেশগুলোর অবস্থান বলে আমেরিকায় স্প্যানিশ ভাষার এতটা রমরমা। সেই সঙ্গে স্প্যানিশভাষী স্পেনের প্রভাবও আমেরিকায় কম নয়। স্পেন ও লাতিন আমেরিকা থেকে বহু মানুষ বহুকাল ধরে আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ী হয়েছে। ফলে এই ভাষাটা একদিকে স্পেন, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার কারণে আমেরিকার দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পেয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে স্প্যানিশভাষী মানুষ।

স্প্যানিশ অঞ্চলে স্প্যানিশ ছাড়া অন্য ভাষার প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিকভাবেও এই ভাষাটি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আরেকটি কারণে স্প্যানিশ ভাষার প্রভাব বিশ্বব্যাপী আমরা লক্ষ করব। সেটা হলো এই ভাষার সাহিত্য। লাতিন সাহিত্য এতটাই সমৃদ্ধ যে যাঁরা এই সাহিত্য মূল স্প্যানিশ ভাষায় পড়তে চান তাঁরা ভাষাটি শিখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশেই যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রে জানি, মূল ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পড়ার জন্য অনেকেই এই ভাষাটা শিখেছেন ও শিখছেন। অন্য দেশেও এটি ঘটছে। সে তুলনায় আমাদের সাহিত্য এখনো বিশ্বপরিসরে পরিচিতি পায়নি। এই পরিচিতিটা অর্জন করলে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মানুষ আগ্রহী হতে পারতেন।

সমস্যাটা হচ্ছে অনুবাদের। অনুবাদের অভাব। আমাদের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ নেই বললেই চলে। ইংরেজি ভাষায় যদি প্রথমে অনূদিত হতো, তাহলে আমাদের সাহিত্য বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে পড়ত। এখানে বলা প্রয়োজন, বাঙালি অনুবাদক নয়, আমাদের দরকার নেটিভ ইংরেজিভাষী অনুবাদক। বাংলা ভাষার দক্ষ একজন লেখক-কবির সঙ্গে একজন নেটিভ ইংরেজিভাষী যৌথভাবে অনুবাদের কাজটি করলে সেই অনুবাদ মানসম্পন্ন হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে কোথায়। ফলে সাহিত্যের মাধ্যমে যে আমরা বিশ্ব জয় করব, সেটা ঘটছে না। বাংলা ভাষার প্রভাবও আমরা লক্ষ করছি না।

শিক্ষার কথা বলি এবার। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব পর্যায়ে আমাদের কোনো অবস্থানই নেই। এটা থাকলে আমরা যদি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দান করে বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশেই অন্য অনেক দেশের শিক্ষার্থী পড়তে আসত। আর তারা তখন বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলে বাংলা ভাষার প্রসার বাড়তই। যেমনটা দেখি জাপানে, চীনে, জার্মানিতে, ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, কানাডায়। এসব দেশে বিশ্বের অন্য দেশের বহু শিক্ষার্থী পড়তে যায়, তারা শিক্ষা লাভ করে চীনা, জাপানি, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ভাষায়। এই ভাষা মাধ্যমগুলো একেবারেই আবশ্যকীয় করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। কিন্তু ভাবুন তো বাংলাদেশের কথা, কে আসবে আমাদের দেশে পড়তে? কেনই বা আসবে? আমরা তো বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারিনি। পারিনি গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে। আমাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো নড়বড়ে হয়ে আছে। কিন্তু আমরা যদি বিশ্বমানের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারতাম, কল্পনা করতে দোষ কি, বিদেশি শিক্ষার্থীরা হয়তো বাংলাদেশে আসত। বাংলা মাধ্যম তারা পড়ত। বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রভাব বিশ্বজনীন হয়ে উঠত। কিন্তু হায়, এটা এখন আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। অথচ ছোট্ট সিঙ্গাপুরের দিকে তাকান, একটিমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ওদের; এশিয়ার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ঠিকই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।

এবার উপসংহার টানি। আমাদের ভাষাপ্রেম অবিস্মরণীয়। ভাষা আন্দোলনই তার প্রমাণ। আমি এই লেখাটা শুরুর আগে একটু ইন্টারনেটে ঢু মারছিলাম। এমন কোনো লেখা পাই কি না, যেখানে ভাষার বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার কথা বলা আছে। সে রকম কোনো লেখা পাইনি, সময়ের অভাবেই বলতে পারি। কিন্তু একটা লেখায় আমার চোখ আটকে গেল। সেই লেখাটায় বাংলা ভাষা এখনো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। লেখাটি ইংরেজিতে, লিখেছেন একজন বিদেশি। সেখানে তিনি বলছেন, বাংলা ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাষা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ মাতৃভাষার সচেতনতার বিষয়টি বাঙালিরাই বুঝিয়ে দিতে পেরেছে।

আরোও পড়ুন। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ভাষা কী আধিপত্যের শিকার?

বাঙালিরা তাদের ভাষাকে খুবই ভালোবাসে। এই ভাষার সূত্র ধরেই তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ভাষা, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার ভাষার সূত্রেই যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এর সবই ভাষা আন্দোলনের অবদান। কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের এই ভাষাপ্রেম বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উৎস হতে পারায়। এ সবই আমাদের গৌরবের দিক। কিন্তু বাংলা ভাষা এখনো বিশ্বভাষার স্তরে উন্নীত হতে পারেনি মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো অবস্থান নেই বলে। শিক্ষা ও সাহিত্যের দিক থেকেও আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম হয়ে উঠবে। বাংলা ভাষাও বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে। পাবে বিশ্বের প্রধান একটি ভাষার মর্যাদা। না, জনসংখ্যার দিক থেকে শুধু নয়, সেটা তো আমরা অর্জন করে ফেলেছিই, এখন প্রয়োজন একটি প্রভাবশালী বিশ্বভাষা হয়ে ওঠা। আপাতত পরিস্থিতিটা যদিও আশানুরূপ নয়, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? সূত্রঃ কালের কন্ঠ

হককথা/সুমি