অর্থ সংকটে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ স্থবির
- প্রকাশের সময় : ০২:৪৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ৫৭ বার পঠিত
চলমান অর্থ সংকটে শুধু বেসরকরি খাত নয়, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নানা কারণে সরকারের বেশির ভাগ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়। সাধারণত মেয়াদ বাড়লে প্রকল্পের খরচও বাড়ে। তবে এবার অর্থ সংকট প্রবল হওয়ায় সরকারের প্রকল্প ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। কারণ, সময়মতো অর্থছাড় করতে না পারলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে, আর মেয়াদ বাড়লে ব্যয়ও বাড়বে। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত এক সভায় বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের সভাপতিত্বে ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বেশির ভাগ সিনিয়র সচিব ও সচিব এ সভায় যোগ দেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার কথা। সাধারণত এ ধরনের সভায় টাকা খরচ করতে না পারার কারণে তোপের মুখে পড়েন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবার দেখা গেছে উলটো চিত্র। অর্থাৎ সভায় অংশ নেওয়া সিনিয়র সচিব ও সচিবরা জানিয়েছেন, তাদের সক্ষমতা থাকলেও টাকা পাচ্ছেন না। এ কারণে প্রকল্পে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় অনেক প্রকল্পই যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। এমন পরিস্থিতিতে মেয়াদ এবং ব্যয় দুটিই বাড়তে পারে। কিন্তু সভায় এই সমস্যার কোনো সুরহা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, সংকটকালীন প্রকল্পের ক্যাটাগরি ভাগ করায় অনেক প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃচ্ছ সাধনের কারণেও কিছু কিছু প্রকল্প প্রয়োজনমতো বরাদ্দ পাচ্ছে না। তবে মেগা প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দের কোনো সংকট নেই। কিন্তু এ কথা সত্য যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে মেয়াদ বাড়লে অবশ্যই ব্যয়ও বাড়বে। এর কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে সভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক কল্যাণে এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) অনুসরণ করা উচিত ছিল। বর্তমানে যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী তিন অর্থবছর নতুন প্রকল্প গ্রহণের সুযোগ সীমিত। কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। তাই আমাদের উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পের ঋণ আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
সূত্র আরও জানায়, ওইদিন সভায় ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে জানানো হয়, এর আগে ১৩ ডিসেম্বর এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকে অর্থ সংকটের বিষয়টি উঠে আসে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় চলমান প্রকল্পগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণের সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। তাই যেসব প্রকল্প জুনের মধ্যে সমাপ্ত হবে-সেসব প্রকল্পও ‘সি’ ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে।
সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমিন জানান, চলতি অর্থবছরে এডিপিতে তার মন্ত্রণালয়ের মোট ৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্প বিদেশি মিশনে বাস্তবায়নাধীন। এ অর্থবছরে চলমান সব প্রকল্পই ‘বি’ ক্যাটাগরির। ফলে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তিনি আরও জানান, কয়েকটি দেশ কোভিডের কারণে অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এ কারণে কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। আবার বৈদেশিক ভ্রমণে বিধিনিষেধ থাকায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ওইসব মিশনে যেতে পারছে না। তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দরপত্র মূল্যায়নের জন্য টিম পাঠানোর প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে মূল্যায়নের সমুদয় কাগজপত্র দেশে এনে কার্যক্রম সম্পন্ন করা অথবা জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মন্ত্রণালয় ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে চারটি প্রকল্পে সমস্যা আছে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প (৩য় পর্যায়), গ্রামীণ মাটির রাস্তাগুলো টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিংবন্ড এইচবিবিকরণ (২য় পর্যায়) এবং মুজিব কিল্লা নির্মাণ-সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প ৩টি সমস্যার কারণে নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হবে না। এছাড়া ইমার্জেন্সি মাল্টি সেক্টর রেহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স প্রজেক্টটির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক থেকে যথাসময়ে অর্থ পেলে তবেই নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাবে।’
সভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৩টি প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে ২০টি প্রকল্প জুনের মধ্যে শেষ করার জন্য নির্ধারিত। কিন্তু এসব প্রকল্পের অধিকাংশই ‘বি’ ক্যাটাগরির। ফলে এ অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া অর্থের বেশির ভাগই অব্যয়িত রয়েছে।
ওই সভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহসানে এলাহী বলেন, প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ৫০ শতাংশ কমানোর কারণে প্রশিক্ষণধর্মী প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে আছে। এছাড়া অনেক ‘সি’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পে আইবাস কোড ব্লক করা হয়েছে। ফলে সক্ষমতা থাকার পরও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে। ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোয় অর্থছাড় না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া হলেও মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক সংকটের শুরুতেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এগুলো কোনোটিতে বরাদ্দ স্থগিত, কোনোটির ৭৫ শতাংশ ব্যয় করার সুবিধা এবং কোনোটি শতভাগ ব্যয়ের সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়া পরবর্তী সময়ে সব প্রকল্পেই বিভিন্ন খাতে ব্যয় সীমিত করা হয়। ফলে দেখা দেয় স্থবিরতা। সূত্রঃ যুগান্তর