৭৯% ভবনই মানেনি নকশা

- প্রকাশের সময় : ০৩:২৪:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩
- / ১০১ বার পঠিত
রাজধানীর ৬৪/১, শান্তিনগর এলাকায় ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন শিবপ্রসাদ চন্দ্র নামের এক ব্যক্তি। তিনি বিদ্যমান ইমারত আইন না মেনে অর্থাৎ নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাজ করে চলেছেন। তিনি ভবনের সেটব্যাক সামনে রেখেছেন ১ দশমিক ৬০ মিটার, পেছনে দশমিক ৭৮ মিটার, ডানে দশমিক ৮০ মিটার ও বামে দশমিক ৮০ মিটার। ভবনটির মালিকের জমি ছাড়ার বিষয়টি আইনসম্মত না হওয়ায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত ৯ সেপ্টেম্বর নোটিস দেয়। বনশ্রী এলাকার জে-ব্লকের ৩ নম্বর রোডে আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত আইনের ধার ধারছেন না। গত ১১ আগস্ট তাকে নোটিস দিয়েছে রাজউক। এর আগে এ ভবন মালিককে আরও চারটি নোটিস দেওয়া হয়েছে। রাজউকের মতে, এটি চূড়ান্ত নোটিস।
একইভাবে মোশারফ হোসেন শিকদার নামে এক ব্যক্তি সূত্রাপুরের ২১, প্যারীদাস রোডে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। তাকেও দুই দফা নোটিস দিয়েছে রাজউক। কিন্তু তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ইতিমধ্যে ভবনের আটতলার নির্মাণকাজ শেষ করেছেন। রাজউকের বিধান না মানার মতো এমন ঘটনা রাজধানীতে হাজারও আছে। গত নভেম্বরে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত রাজউকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থার আটটি জোনে ৩ হাজার ৪৬৮টি ভবনের নকশা পাস হয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন রয়েছে ২ হাজার ৫৬৯টি। এসব ভবনের মধ্যে ২ হাজার ২৩টি ভবন নির্মাণে অনুমোদিত নকশা মানা হয়নি। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ ভবনের ক্ষেত্রে নকশার ব্যত্যয় ঘটেছে। নকশার ব্যত্যয় করা ২ হাজার ২৩টি ভবনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৩৮১টি ভবনের। আর নির্মাণাধীন রয়েছে ১ হাজার ৬৪২টি। অনিয়ম করায় ১ হাজার ৫৮৮ ভবন মালিকের বিরুদ্ধে নোটিস দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ২২৯টি ভবনে। ব্যাপক অনিয়মের পরও উচ্ছেদ অভিযানের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ ভবনে। রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, নন্দীপাড়া ও আফতাবনগর এলাকা নিয়ে রাজউকের জোন-৬ গঠিত। এ জোনে গত নভেম্বর মাসে পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজউকের পরিদর্শক দল ৩২১টি ভবন পরিদর্শন করে নকশার ব্যত্যয় পেয়েছেন। এর মধ্যে ২৮৫টি ভবন মালিককে নোটিস দেওয়া হয়েছে। আর ৩৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ইমারত পরিদর্শকরা তাদের ইচ্ছেমতো দায়সারা প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে অনিয়মের আসল চিত্র উঠে আসে না। ইমারত পরিদর্শকের পরও প্রধান ইমারত পরিদর্শক, সহকারী অথরাইজড অফিসার, অথরাইজড অফিসার, জোনাল পরিচালক ও সর্বশেষ দুজন পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) রয়েছেন। এ বিশাল চেইন যদি নকশা ব্যত্যয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে এত অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজউক আগে বলত ৯২ শতাংশ মানুষ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশা মানছে না। এখন ৬০ বা ৫৮ শতাংশ নথিপত্রে দেখানো হচ্ছে। এসব আসলে রাজউকের মতো করেই তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাজউক বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ বা আইন পালনে নাগরিকদের বাধ্য করার বিষয়ে অনেকটাই অকার্যকর। তাদের সেই সক্ষমতা নেই।’ তিনি মনে করেন, নকশা না মানার ঘটনা ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারে। এখানে আইনের ফাঁক দিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে মদদ দেওয়ার একটা বিষয় আছে। আরেকটি বিষয় হলো, যে আইন রাজউক মানাতে চাচ্ছে তা বাস্তবায়ন যোগ্য কি না তাও পরীক্ষা করতে হবে। যারা অন্যায় করছে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল কথা হলো, রাজউককে গঠনতান্ত্রিকভাবে কারিগরি ও দক্ষ জনবলের সমাগম ঘটাতে হবে।’
জানা যায়, রাজউকের আওতাধীন ১ হাজার ৫০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ১৬টি জোন রয়েছে। এর মধ্যে আটটি জোনে পরিদর্শন করে নানা অনিয়মের চিত্র দেখতে পায় রাজউক। ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ও সেটব্যাক না মানা (ভবনের চারপাশে জায়গা ছাড় দেওয়া), অকুপেন্সি (ভবন ব্যবহার উপযোগী) সদন না দেওয়ার ঘটনা বেশি। এসব ঘটনায় রাজউকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভবন মালিককে চিঠি দেওয়া হয়। তবে তাদের বেশিরভাগই চিঠিকে পাত্তা না দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যান। পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় ক্লাসিক ডেভেলপার্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদিত নকশা না মেনে ভবন নির্মাণ করায় নোটিস দেয় রাজউক। ১০/বি, নওয়াব স্ট্রিটের এ প্লটে প্রথম নোটিসের পরও তা আমলে নেননি ভবন মালিক। এরপর একে একে তিনটি নোটিস দিয়ে সর্বশেষ চূড়ান্ত নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু এ নোটিস কার্যক্রম চলার মধ্যেও ১২ তলার নির্মাণের কাজ শেষ করেছেন তিনি। বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ইম্পেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রাজউকের বিধান না মেনে ভবন নির্মাণকাজ করে যাচ্ছে। এ ভবন মালিককেও পরপর তিনটি নোটিস দিয়েছে রাজউকের সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসার। রাজউকের এ নোটিস পাত্তা না দিয়ে ইতিমধ্যে আটতলা নির্মাণকাজ শেষ করেছেন ভবন মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজউকের অথরাইজড অফিসার যদি মনে করেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় এসব ভবনের নির্মাণকাজ আর করতে পারবে না; তবে তাই হবে। তারা আইন অনুযায়ী কাজ বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারেন। কিন্তু তা না করে ভবন মালিকদের সঙ্গে অদৃশ্য যোগাযোগ রেখে তাদের নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে নকশার ব্যত্যয় ঘটানোর বিষয়টি নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) তানজিলা খানম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নকশা না মেনে যেসব ভবন মালিক নির্মাণকাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে নোটিস দেওয়ার বিষয়টিও আইনি বাধ্যবাধকতা। যারা নোটিস না মেনে কাজ করছে তাদের স্থাপনা উচ্ছেদে রাজউক অভিযান করবে। রাজউক নিয়মিত এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’ সূত্র : দেশ রুপান্তর