চিরতারুণ্যের অমিতাভ
- প্রকাশের সময় : ০৬:৫৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ অক্টোবর ২০২২
- / ৮৪ বার পঠিত
‘বুড্ডাঢা হোগা তেরা বাপ’। ২০১১ সালে এই নামের ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। এরপর কেটে গেছে আরও এগারো বছর। গত মঙ্গলবার অমিতাভ বচ্চন পা দিলেন আশি বছরে। তবে কে বলবে তাঁর বয়স হয়েছে আশি! নিন্দুকদের ‘বুড্ডাঢা হোগা তেরা বাপ’ বলে এখনও রুপালি পর্দায় ম্যাজিক ছড়াচ্ছেন তিনি। বলিউডে তাঁর হাঁটুর বয়সী নায়কদের দিকে প্রতিনিয়ত ছুড়ে দিচ্ছেন চ্যালেঞ্জ। আজও যেন ‘বুড্ডাঢা’ হতে তীব্র আপত্তি বিগ বি’র, যা তাঁর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা ছবিগুলো মনে করিয়ে দেয় বয়স একটা সংখ্যা মাত্র।
অমিতাভের মতো করে বয়স জয় করতে ক’জনইবা পারেন। গত শতকের সত্তরের দশকে সেই যে বলিউডে রাজ্যপাট বিস্তার করেছেন, আজও বহাল তবিয়তে রয়েছেন অমিতাভ। তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরকে এখনও টেক্কা দিতে পারেননি কেউই। অভিনয় থেকে অভিব্যক্তি। নিজের ক্যারিশমায় ভারতীয় সিনেমায় অমিতাভ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বচ্চন যুগ’। মহাতারকারা হয়তো এমনই হয়। সব সময়ই যেন নিজের উচ্চতাকেই ছাপিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে।
আশিতে এসেও তাঁর পদচারণায় মুখর বলিউড। বলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের তালিকায় তাঁর নাম অবশ্যই থাকবে। ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ থেকে বলিউডের শাহেনশাহ হয়ে ওঠার মাঝে অমিতাভ হরিবংশ বচ্চন পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের এক হিন্দু-শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অমিতাভ। তাঁর বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন ছিলেন নামকরা কবি এবং মা তেজি বচ্চন ছিলেন ফয়সালাবাদের শিখ-পাঞ্জাবি নারী। শৈশবে এলাহাবাদ, এরপর নৈনিতালের বোর্ডিং স্কুল, শেরউড কলেজ হয়ে তরুণ অমিতাভ উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন দিল্লির কিরোরি মাল কলেজে এবং অবশেষে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সময় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তখনই অভিনয়ের ভুবনে পা বাড়াননি।
পড়াশোনা শেষে জীবিকার জন্য যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার ‘শ ওয়ালেস অ্যান্ড কোম্পানি’তে। এরপর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজও করেন। কিন্তু গৎবাঁধা চাকরি আর মাস শেষে পাওয়া বেতনে সন্তুষ্ট ছিলেন না তরুণ অমিতাভ। সে কারণেই ১৯৬৮ সালে চাকরি ছেড়ে পাড়ি জমান স্বপ্নের শহর বোম্বেতে [বর্তমান মুম্বাই]। সেই সময় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বার অমিতাভকে বোম্বে সাদর আলিঙ্গন করেনি। শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উচ্চতা। অনেক পরিচালক-প্রযোজক মনে করতেন, এত লম্বা একজন পুরুষ গতানুগতিক নায়ক হতে পারবে না। এরপর অমিতাভ তাঁর কণ্ঠস্বর দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করলেন, সেখানেও ব্যর্থ। অল ইন্ডিয়া রেডিওর অডিশনে বাদ পড়েন তিনি।
এরপর ১৯৬৯ সালে খাজা আব্বাস পরিচালিত ‘সাত হিন্দুস্তানি’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এ ছবির জন্য নবাগত হিসেবে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান অমিতাভ। প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পরও বলিউডের পথ তাঁর জন্য সুগম হয়নি। অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। এরপর তিনি অভিনয় করেন বলিউডের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘আনন্দ’তে। তখনকার সময়ের বলিউডের সবচেয়ে খ্যাতনামা তারকা রাজেশ খান্নার সঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করেন। তবে অমিতাভের ক্যারিয়ারের ব্যবসায়িক সফলতা আসে ‘জঞ্জির’ [১৯৭৩] সিনেমার মাধ্যমে। অমিতাভের ভাষায়, ”জঞ্জির’ আমার ক্যারিয়ারে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। তখনই সফলতা আমার কাছে ধরা দিয়েছিল।” ‘জঞ্জির’ সিনেমার সেটেই অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ির সঙ্গে পরিচয় হয় অমিতাভের। পরিচয় থেকে প্রেম এবং প্রেম থেকে পরিণয়।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে অমিতাভ বচ্চন নিজেকে বলিউডের সবচেয়ে প্রতাপশালী একজন অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় অমিতাভ অভিনীত ‘শোলে’, যা ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি অমিতাভ বচ্চনকে। সেসময় যে কোনো প্রযোজক জানতেন, অমিতাভকে ছবিতে নেওয়া মানেই তা হিট! সেই সময় হিন্দি সিনেমা পায় একজন ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’। অমিতাভ মানেই বক্স অফিস সুপারহিট। বলিউডের নতুন ইতিহাস তৈরি করতে শুরু করেন ‘বিগ বি’। ‘মুকদ্দর কা সিকন্দর’, ‘শরাবি’, ‘নমকহালাল’, ‘ইয়ারানা’, ‘মর্দ’- একের পর এক কালজয়ী সিনেমার মাধ্যমে।
নব্বইয়ের দশকে বলিউডের এই শাহেনশাহর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। একের পর এক ছবি ফ্লপ করে। সিনেমা প্রযোজনায় নেমে ক্ষতির মুখ দেখতে হয়। চূড়ান্তভাবে অর্থাভাবের মধ্যে পড়তে হয় তাঁকে। কিন্তু লড়াকু স্বভাবের অমিতাভ আবার ঘুরে দাঁড়ান। অনেকটা তাঁর বিখ্যাত সব সিনেমার মতোই প্রত্যাবর্তন ঘটান নিজের বাস্তব জীবনে। নিজেকে নিয়ে শুরু করেন নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। নিজের চিরচেনা ইমেজ ভেঙে হাজির হন ভিন্ন চরিত্রে। ‘ব্ল্যাক’, ‘পা’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’, ‘মহব্বাতে’র মতো নানা ধরনের ছবিতে অভিনয় করে অমিতাভ নিজেকে বদলাতে শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলাতে থাকেন। ধারণা, ভাবনা বদলে ফেলে সময়ের উপযোগী হয়ে ওঠেন। টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেন। হয়তো তাঁর বদলে যাওয়ার গুণই তাঁকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য।
সিনেমা থেকে টেলিভিশন- এখনও তাঁর হাতের মুঠোয়। বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি এখনও সাবলীল। কণ্ঠের জাদুতে আর তাঁর ব্যক্তিত্বে একেকটা চরিত্রে ছাপ ফেলে যান তিনি। তাইতো আশি বছরে পা দিয়েও তিনি ঠিক আশি বছরের মতো নন। বরং সদা রঙিন। সদা উজ্জ্বল। সদা বহমান। চিরতরুণ।