নিউইয়র্ক ০৪:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতদূর?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:১১:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / ৩৯ বার পঠিত

বাংলাদেশ ডেস্ক : মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন দেশের গলার কাঁটা। তাদের ফেরত পাঠাতে দফায় দফায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তা কোনো কাজে আসেনি। সংকট নিরসনে খুব একটা তৎপরতা নেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের। ফলে আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি-না, তা নিয়ে ধুয়াশার মধ্যে আছে সরকার।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক চাপে প্রয়োগেই মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে। তবে সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানও মুখ খুলেছে। দেশটি বলেছে, দেশটির ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা রোহিঙ্গা সংকট। এখন চীন, রাশিয়া ও ভারত এই ইস্যুতে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আর কঠিন কোনো বিষয় হয়ে থাকবে না।
তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তৈরি হওয়া গুরুতর চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এ সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা উৎসাহিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি মিয়ানমারে অবিলম্বে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধের তাগিদ দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ।
এ দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় পর গত ২৭ জানুয়ারি মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথম কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমারের দিক থেকে ধীরগতির বিষয়ে গভীর হতাশা জানিয়েছে বাংলাদেশ। দ্রুততার সঙ্গে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই দেশের মধ্যে সই করা তিনটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছে এমন সংস্থার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গত জানুয়ারিতে যে বৈঠক করেছে, তাতে নতুন আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে মিয়ানমারের কাছে; কিন্তু মিয়ানমার প্রায় সাড়ে ৪ বছরে মাত্র ৪২ হাজার জনকে ভেরিফিকেশন করেছে। বাকিদের চূড়ান্ত ভেরিফিকেশন করতে কত দিন লাগাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউই।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা কৌশল বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছে, যে পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের মাধ্যমে দেশান্তরী করা হয়েছে, সেটি তাদের সরকারের বহু আগের পরিকল্পনা। তাই তারা আদৌ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে কি-না, আবার নিলেও এর সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের হাতে। আর চাপে পড়লেই মিয়ানমার কথা শোনে। তাই বিশ্বের উচিত দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করা। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক মহল প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখছে না এমন অভিযোগ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু ও মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে কথা বলছে না উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে পুঁজি করে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনার রেজওয়ান হায়াত বলেন, আটকে থাকা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে জটিলতা ও ঘাটতি দূর করতে পারলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। এ ক্ষেত্রে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং বাস্তুচ্যুত মানুষদের মাঝে আস্থা ফেরানো দরকার।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গত জানুয়ারির আকস্মিক এই বৈঠককে ছলচাতুরির কূটকৌশল বলেও মনে করছেন অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এটাই প্রথম বৈঠক। যদিও ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দু’দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সে দেশের এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় সব কিছু থমকে যায়।
এ দিকে এর মধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপে রয়েছে মিয়ানমার। দিন দিন সে চাপ বাড়ছে। অপরদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের রোহিঙ্গাদের মতো আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমন নিপীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ অবস্থায় গত প্রায় সাড়ে চার বছর রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ প্রত্যাবাসন বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকার রীতিমতো নীরবতাই পালন করে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব দরবারে বার বার রোহিঙ্গা বিষয়টি উত্থাপন করে এর একটি সমাধান কামনা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে, কূটনৈতিক পর্যায়ের সর্বোচ্চ তৎপরতাও।
এ ছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হওয়ার পর গণহত্যা নিয়ে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন দফায় শুনানি শুরু হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে অং সান সু চি প্রথম গণশুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ার তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবু বক্কর তাম্বাদু ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে এ মামলার শুনানি হয়। শুনানিতে মিয়ানমার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য সাফাই বক্তব্য দেয়। এরপর জাতিসংঘের তদন্ত দল যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে বলা হয় গণহত্যার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছিল।
গত বছরের আগস্ট মাসে আর্জেন্টিনা কেন্দ্রীয় অপরাধ আপিল আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে ৫ নারীসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সাক্ষ্যদানকারী নারীরা মিয়ানমার সেনাদের যৌন নির্যাতনের শিকার। ভার্চুয়ালি কক্সবাজার থেকে তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করেন। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়।
অপরদিকে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের থার্ড কমিটি সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস করে। এতে ১০৭ দেশের পূর্ণ সমর্থন মিলে, যা ছিল একটি বিরল ঘটনা। এ দিকে বাংলাদেশের পক্ষে এ পর্যন্ত এদেশে আশ্রিত ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ তালিকার মধ্যে ৪২ হাজারকে মিয়ানমার ঠিক বলে সম্মতি দিয়েছে। বাকিদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। চীনের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে ৮৪০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা দেয়; কিন্তু তা আর এগোয়নি। এরপর থেকে পুরো বিষয়টি থমকে রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সরকার এখন নানা সমস্যার সম্মুখীন। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল বিপর্যস্ত। ফলে বাধ্য হয়ে এক লাখেরও সামান্য বেশি রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাস উপযোগী করতে জাতিসংঘের সব নির্দেশনা মানতে হয়েছে। আর এ জন্য প্রকল্পটি গড়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করে। এ ছাড়া ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে রোহিঙ্গারা রয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়। একটি গ্রুপ যেতে চাইলেও আরেক গ্রুপ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটছে। ফিরে যাওয়ার পক্ষে আগ্রহীদের নেতৃত্বদানকারী নেতা মহিবুল্লাহকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন ক্যাম্পের বহু কক্ষ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের নেপথ্যে মিয়ানমারের হাত রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গ্রুপ যারা নিজেদের স্বাধীনতাকামী মনে করে এ গ্রুপটির নাম আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)। গত চার বছরেরও বেশি সময়ে আরসার একটি গ্রুপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে। অপর গ্রুপটি মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে থেকে প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি ৩৪ আশ্রয় শিবিরে খুন-দাঙ্গা এবং মাদকের চোরাচালান তৎপরতায় লিপ্ত। এ পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটছে। ইয়াবা এবং আইস নামের মরণ নেশার মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার রুট তৈরি হয়েছে এসব রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪৭টি কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। কি পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে আর কি পরিমাণ বাংলাদেশে আসছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বেসরকারি কোনো মহলে নেই।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনা অভিযান শুরু হলে রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। ওই সময় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল লক্ষাধিক। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। গত চার বছরে আরও দুই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। খবর সাম্প্রতিক দেশকাল
হককথা/এমউএ

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতদূর?

প্রকাশের সময় : ০১:১১:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২২

বাংলাদেশ ডেস্ক : মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন দেশের গলার কাঁটা। তাদের ফেরত পাঠাতে দফায় দফায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তা কোনো কাজে আসেনি। সংকট নিরসনে খুব একটা তৎপরতা নেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের। ফলে আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি-না, তা নিয়ে ধুয়াশার মধ্যে আছে সরকার।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক চাপে প্রয়োগেই মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে। তবে সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানও মুখ খুলেছে। দেশটি বলেছে, দেশটির ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা রোহিঙ্গা সংকট। এখন চীন, রাশিয়া ও ভারত এই ইস্যুতে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আর কঠিন কোনো বিষয় হয়ে থাকবে না।
তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তৈরি হওয়া গুরুতর চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এ সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা উৎসাহিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি মিয়ানমারে অবিলম্বে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধের তাগিদ দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ।
এ দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় পর গত ২৭ জানুয়ারি মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথম কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ে মিয়ানমারের দিক থেকে ধীরগতির বিষয়ে গভীর হতাশা জানিয়েছে বাংলাদেশ। দ্রুততার সঙ্গে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই দেশের মধ্যে সই করা তিনটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছে এমন সংস্থার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গত জানুয়ারিতে যে বৈঠক করেছে, তাতে নতুন আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে মিয়ানমারের কাছে; কিন্তু মিয়ানমার প্রায় সাড়ে ৪ বছরে মাত্র ৪২ হাজার জনকে ভেরিফিকেশন করেছে। বাকিদের চূড়ান্ত ভেরিফিকেশন করতে কত দিন লাগাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউই।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা কৌশল বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছে, যে পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের মাধ্যমে দেশান্তরী করা হয়েছে, সেটি তাদের সরকারের বহু আগের পরিকল্পনা। তাই তারা আদৌ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে কি-না, আবার নিলেও এর সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের হাতে। আর চাপে পড়লেই মিয়ানমার কথা শোনে। তাই বিশ্বের উচিত দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করা। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক মহল প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখছে না এমন অভিযোগ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু ও মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে কথা বলছে না উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে পুঁজি করে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনার রেজওয়ান হায়াত বলেন, আটকে থাকা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে জটিলতা ও ঘাটতি দূর করতে পারলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। এ ক্ষেত্রে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং বাস্তুচ্যুত মানুষদের মাঝে আস্থা ফেরানো দরকার।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে গত জানুয়ারির আকস্মিক এই বৈঠককে ছলচাতুরির কূটকৌশল বলেও মনে করছেন অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এটাই প্রথম বৈঠক। যদিও ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দু’দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সে দেশের এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় সব কিছু থমকে যায়।
এ দিকে এর মধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপে রয়েছে মিয়ানমার। দিন দিন সে চাপ বাড়ছে। অপরদিকে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে দেশের রোহিঙ্গাদের মতো আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমন নিপীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ অবস্থায় গত প্রায় সাড়ে চার বছর রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ প্রত্যাবাসন বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকার রীতিমতো নীরবতাই পালন করে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব দরবারে বার বার রোহিঙ্গা বিষয়টি উত্থাপন করে এর একটি সমাধান কামনা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে, কূটনৈতিক পর্যায়ের সর্বোচ্চ তৎপরতাও।
এ ছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হওয়ার পর গণহত্যা নিয়ে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন দফায় শুনানি শুরু হতে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে অং সান সু চি প্রথম গণশুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ার তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবু বক্কর তাম্বাদু ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে এ মামলার শুনানি হয়। শুনানিতে মিয়ানমার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য সাফাই বক্তব্য দেয়। এরপর জাতিসংঘের তদন্ত দল যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে বলা হয় গণহত্যার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছিল।
গত বছরের আগস্ট মাসে আর্জেন্টিনা কেন্দ্রীয় অপরাধ আপিল আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে ৫ নারীসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সাক্ষ্যদানকারী নারীরা মিয়ানমার সেনাদের যৌন নির্যাতনের শিকার। ভার্চুয়ালি কক্সবাজার থেকে তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করেন। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়।
অপরদিকে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের থার্ড কমিটি সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস করে। এতে ১০৭ দেশের পূর্ণ সমর্থন মিলে, যা ছিল একটি বিরল ঘটনা। এ দিকে বাংলাদেশের পক্ষে এ পর্যন্ত এদেশে আশ্রিত ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ তালিকার মধ্যে ৪২ হাজারকে মিয়ানমার ঠিক বলে সম্মতি দিয়েছে। বাকিদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। চীনের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে ৮৪০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা দেয়; কিন্তু তা আর এগোয়নি। এরপর থেকে পুরো বিষয়টি থমকে রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সরকার এখন নানা সমস্যার সম্মুখীন। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চল বিপর্যস্ত। ফলে বাধ্য হয়ে এক লাখেরও সামান্য বেশি রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ভাসানচরকে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাস উপযোগী করতে জাতিসংঘের সব নির্দেশনা মানতে হয়েছে। আর এ জন্য প্রকল্পটি গড়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করে। এ ছাড়া ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে রোহিঙ্গারা রয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়। একটি গ্রুপ যেতে চাইলেও আরেক গ্রুপ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটছে। ফিরে যাওয়ার পক্ষে আগ্রহীদের নেতৃত্বদানকারী নেতা মহিবুল্লাহকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন ক্যাম্পের বহু কক্ষ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের নেপথ্যে মিয়ানমারের হাত রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গ্রুপ যারা নিজেদের স্বাধীনতাকামী মনে করে এ গ্রুপটির নাম আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)। গত চার বছরেরও বেশি সময়ে আরসার একটি গ্রুপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে। অপর গ্রুপটি মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে থেকে প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি ৩৪ আশ্রয় শিবিরে খুন-দাঙ্গা এবং মাদকের চোরাচালান তৎপরতায় লিপ্ত। এ পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটছে। ইয়াবা এবং আইস নামের মরণ নেশার মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার রুট তৈরি হয়েছে এসব রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪৭টি কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। কি পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে আর কি পরিমাণ বাংলাদেশে আসছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বেসরকারি কোনো মহলে নেই।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনা অভিযান শুরু হলে রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। ওই সময় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল লক্ষাধিক। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। গত চার বছরে আরও দুই লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। খবর সাম্প্রতিক দেশকাল
হককথা/এমউএ