সাইবার যুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো

- প্রকাশের সময় : ১২:২৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২
- / ৩০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : করোনা মহামারির কারণে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে রয়েছে বিধিনিষেধ। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিশ্লেষকরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রচার প্রচারণার কৌশল পাল্টাচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনৈতিক মাঠের বিকল্প হিসাবে দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে অনলাইন প্রচার প্রচারনার দিকে। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার-প্রচারণায় শক্তিশালী করছে তথ্যপ্রযুক্তির টিম। এরই মধ্যে সাইবার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এ কাজে তথ্য-প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞদের বেতন দিয়ে নিয়োগও দিয়েছে দলগুলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। এ কারণে বিকল্প পথ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছে মানুষ। তাছাড়া বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে নির্বাচনি প্রচারণা এবং খবর আদান-প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই আগামী নির্বাচনে অনলাইন বিশেষ করে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অনিয়ম, ব্যর্থতা নিয়ে বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরি করছে বিএনপি। এতে দেশ এবং দেশের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে সরকারের উন্নয়ন ও অঙ্গীকার প্রচারণাকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। একইসঙ্গে অন্য কোনো গোষ্ঠী সরকারের নেতিবাচক প্রচারণা চালালে, তা এখন থেকে জবাব দিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশ রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘সাইবার যুদ্ধ’ প্রথমবারের মতো ব্যাপক আকার ধারণ করে ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়। সাইবার দুনিয়ায় সরকারবিরোধী দলগুলোর চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ও রাজপথে শক্ত অবস্থানে থাকলেও, অতীতে বেশ কিছু ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধিপত্য দেখাতে পারেনি। কোটা সংস্কার বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অনলাইন প্রচার প্রচারণায় সরকার-বিরোধীদের দাপট ছিল বলেই দলটিতে মূল্যায়ন রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলনের সময় গুজব ও অপপ্রচার হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তাছাড়া মহামারি করোনা শুরুর পর থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম হয়ে পড়ে অনলাইন নির্ভর। সে সময়ে মানবিক কার্যক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দলের কর্মকাণ্ড ভার্চুয়াল মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। অনলাইন দুনিয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, বিরোধী পক্ষের ছড়ানো গুজব, নেতিবাচক প্রচারণার বিপরীতে শক্তিশালী কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। যে কারণে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে লাখো কর্মী নিয়ে দলের শক্তিশালী সাইবার টিম গঠনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।
এ দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোতে। তৃণমূলে দল গুছিয়ে দলকে সংগঠিত করতে কাজ করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। প্রধান এ রাজনৈতিক দল দুটি এরই মধ্যে ইশতেহারের প্রণয়নের প্রস্তুতি নিয়েছে। আর এ নির্বাচনকে কেন্দ্রকরে নতুন করে দানা বাঁধতে পারে গুজব, অপপ্রচার। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রচার প্রচারণা ও গুজব রোধে প্রস্তুতিমূলক কাজ করছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের নীতিমালা প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার। দলটি টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল হওয়ার পথে অনেকদূর এগিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার জবাবের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে চায় দলটি। আর এজন্য দেশের নানা প্রান্তে কর্মীদের অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে নিয়মিত কনটেন্ট আপলোডের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো। তবে গুজব, অপপ্রচার রোধ ও সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরায় কেন্দ্রীয়ভাবে দক্ষজনবল থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এর হার অনেক কম। যার কারণে জেলাভিত্তিক মাস্টার ট্রেইনার তৈরিতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে দক্ষ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উপজেলা পর্যায় পর্যন্তও বিস্তৃত করা হবে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার রোধে লক্ষাধিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির এ কাজটি করছে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপ-কমিটি। ইতিমধ্যে সারা দেশের দক্ষ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির জন্য প্রায় ৭১টি প্রশিক্ষণ কর্মশালা করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনারতৈরি করে তাদের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি দক্ষ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি করতে কাজ করছে সংগঠনটি। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী যেন কোনো প্রকার গুজব অপপ্রচারের মাধ্যমে দলের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করবে এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করেন, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বেশি সক্রিয় এবং সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচারে লিপ্ত। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা গুজব প্রতিরোধে ততটা তৎপর নয়। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে শুরু হয় আলোচনা, সমালোচনা। মাঠে না থাকলেও সাইবার দুনিয়ায় সক্রিয় রয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিপরীত সেন্টিমেন্ট তৈরি করে প্রচারণা চালায় তারা। বিরোধীপক্ষের কর্মী বাহিনী সাইবার জগতে সক্রিয় থাকায় নিজেদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলে তারা। অনেক সময় সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে নিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ছড়ানো হয় নানা গুজব।
এসব অপপ্রচার রোধে প্রয়োজন পাল্টা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন। আর এজন্য প্রয়োজন দক্ষজনশক্তি। আর তাই দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার চিন্তা থেকে দেশব্যাপী অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার কৌশল শীর্ষক এসব কর্মশালায় সার্বিক সহযোগিতা করছে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)।
এদিকে বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব মানুষের কাছে অনলাইন প্রচারণা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক জীবনে এক নতুনবাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাই আগামী নির্বাচনে অনলাইনে প্রচারণায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিশেষ টিম। পাচ্ছেন অভিজ্ঞরা চাকরিও। আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা থাকবে সরকারবিরোধী প্রচারণা জোরদার করা।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই তথ্যপ্রযুক্তিকে বাংলাদেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আজ দেশের সকল শ্রেণি- পেশার মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে ও নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্র সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরা এবং প্রচার-প্রচারণার জন্য প্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে আওয়ামী লীগ আরও গুরুত্ব দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের মাঝে আওয়ামী লীগ ও সরকারের উন্নয়নবিরোধী ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। এসব গুজন রোধ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তথ্যপ্রযুক্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং সতর্ক থাকা হবে।
বিএনপির গবেষণা সেল বিএনআরসির এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার ফারজানা শারমিন পুতুল বলেন, সরকার যেভাবে সব কিছুতে ব্যারিয়ার দিয়ে রেখেছে, সেখানে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য দলের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা কাজ করছে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্স মাহমুদ বলেন, সরকার ও তার দলের লোকজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মানুষ এসব প্রচারণায় কান দিচ্ছে না। সত্যটা এ দেশের মানুষ জানে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আগামী নির্বাচনে অনলাইন বিশেষ করে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে নির্বাচনি প্রচারণা এবং খবর আদান-প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের একাংশ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আরেকটি অংশ সরকারের বিভিন্ন কালাকানুনের ভয়ে স্বাধীন মতো সাংবাদিকতা করতে পারছে না। বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করার জায়গা চরমভাবে সংকুচিত হওয়ার কারণে বিকল্প মাধ্যম হিসেবে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছে।খবর সাম্প্রতিক দেশকাল
হককথা/এমউএ