নিউইয়র্ক ০৪:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ঢাবি ক্যাম্পাস যতটা না শিক্ষার্থীদের, তার বেশি বহিরাগতদের

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / ৩৮ বার পঠিত

বাংলাদেশ ডেস্ক : মোহাম্মদ সায়েম উদ্দীন (ছদ্মনাম) পরিবারসহ ঘুরতে এসেছেন। সর্বসাকুল্যে পাঁচজন। ঘুরছেন, ছবি তুলছেন, ওয়ানটাইম কাপে করে চা খাচ্ছেন। চা খেয়ে রাস্তায় কাপ ফেলে অন্যদিকে যাচ্ছেন। নগরীর বাসাবো এলাকা থেকে এসেছেন তারা। বোনের পরিবার ঢাকা এসেছে বলে ঘুরতে বের হয়েছেন। মুখে মাস্ক নেই কেন জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনা নেই।’
শুনে মনে হতে পারে কোনো পার্কের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে এটি শুক্রবার সন্ধ্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির চিত্র। সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা জানায়, শুধু শুক্রবার না, যে কোনো ছুটির দিনেই বহিরাগতদের আনাগোনায় বিশ্ববিদ্যালয় একটি পার্কে পরিণত হয়। তাদের ‌অভিযোগ, বহিরাগতদের কেন্দ্র করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
বিগত সময়ের কিছু নজির দেখলে বিষয়টির ভালো ধারণা পাওয়া যায়। গত ২০২১ সালের ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ সংলগ্ন এলাকা থেকে মদসহ চার যুবককে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে নারী উত্যক্তকরণের অভিযোগও ছিল। একই বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম টিএসসিতে হাঁটার সময় এক ভবঘুরের দ্বারা তার পিঠে ও কাঁধে হাত দিয়ে হয়রানির অভিযোগ তোলেন।
একই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাথে নিয়ে অভিযান চালিয়ে বহিরাগতর আনাগোনা ও ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে ভারী যানবাহনের চলাচল অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ ডিসেম্বর ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্রিয় থাকার কারণে বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাসে দিবসটি উদযাপন করতে পারে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে নিজেদের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন অনেক শিক্ষার্থী।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আবারও খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে গত ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আবাসিক ভবন শেখ রাসেল টাওয়ারের বিপরীতে ডাস্টবিন থেকে একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আবার আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় পরিত্যক্ত একটি বাক্স থেকে কাপড়ে মোড়ানো দুই নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ধরণের ঘটনাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূলত বহিরাগতদের আনাগোনা ও প্রশাসনের গাফেলতিকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি করোনার সংক্রমণের বিষয়টিও তুলে ধরেন তারা। তাদের অভিযোগগুলো হলো, ক্যাম্পাসের সর্বত্র ময়লার ভাগাড় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ভারী যানবাহন, অনাকাঙ্খিত গাড়িঘোড়া ও ভ্যান দোকানের ফলে সৃষ্ট যানজট এবং লাইব্রেরিতে হর্নের আওয়াজে পড়তে না পারা।
ক্যাম্পাসের সর্বত্র আবর্জনার ভাগাড়
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসের সর্বত্র অনাকাঙ্খিত ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এর জন্য তারা মূলত বহিরাগতদের দায়ী করছেন। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নেছার উদ্দীন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন একটা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তুপ ও দুর্গন্ধ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশ। এর সিংহভাগই বহিরাগত দর্শনার্থীদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ধরণের কাজ করতে পারে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিএসসির ‘মেলা’ দেখতে এসে দর্শনার্থীরা খাবারের উচ্ছিষ্ট, বাচ্চার ডায়াপারসহ সব ধরণের ময়লা রাস্তায় কিংবা বসার স্থানে ফেলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। টিএসসি ছাড়া পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই এমন চিত্র দেখা যায়। অথচ এসবে চোখ পড়ে না প্রশাসনের।’
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে নেই পড়ার পরিবেশ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গাড়ির হর্নের আওয়াজে পড়তে না পারার অভিযোগ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বীন মো. শরীফ বলেন, ‘আমি হলে থাকি। হলের রিডিংরুমগুলোর খোঁজ নিলে দেখবেন সিট কম থাকার কারণে ওখানে পড়ার সুযোগ থাকে না। তাই এত দূর হেঁটে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পড়তে আসি। কিন্তু এখানে এসেও যে ভালোভাবে পড়ব তার সুযোগ থাকে না। লাইব্রেরি রাস্তার পাশে হওয়ায় যে কোনো ধরণের বড় আওয়াজ কানে আসে। ইদানিং ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে বাস, ভারী যানবাহন ও বিশেষ করে প্রাইভেটকারের চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়িগুলোর হর্নের আওয়াজে লাইব্রেরিতে বসা যায় না।’
একই বিভাগের মো. রেদওয়ান রিয়াদ বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ এই হর্নের আওয়াজ শুনতে শুনতে একঘেঁয়েমি চলে আসে। এই এলাকার রাস্তাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিরই বিকল্প রাস্তা আছে। কিন্তু শর্টকাট নেয়ার জন্য গাড়িগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যায়। হর্নের আওয়াজে পড়ায় মন বসানো যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কার-বাস যদি বন্ধ করা যেত তবে এতটা সমস্যা হতো না। রিকশার মতো ছোট বাহনের আওয়াজ লাইব্রেরির ভেতর পর্যন্ত আসে না। প্রশাসন চাইলেই এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জনগণ এভাবে ব্যবহার করতে পারে না।’
অনাকাঙ্খিত যানজট
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাকাঙ্খিত গাড়ি চলাচল ও যানজটসহ নিরাপত্তাহীনতার কথাও বলছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবার পলাশী মোড়ে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় ইয়াসিন (৩০) নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তিনি রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র মো. আরমান বলেন, ‘বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চেয়ে বহিরাগতদের সংখ্যা সবসময় বেশি থাকে। মানুষের ভিড় এবং ভ্যানগাড়ির দোকান ক্যাম্পাসকে রীতিমতো পার্কে পরিণত করেছে। তাছাড়া ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে উন্মুক্তভাবে বহিরাগত ভারী গাড়ির চলাচল রীতিমতো শহরের ব্যস্ততম সড়কেই রূপান্তরিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কগুলোকে। ক্যাম্পাসে এভাবে সদর্পে গাড়ির চলাচল ও যানজট শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তিতে রেখেছে।’
তিনি বলেন, ‘নিজেদের ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীরা নির্ভিঘ্নে চলাচল করতে পারে না। নিয়মিত দুর্ঘটনা তো আছেই। পাশাপাশি মানুষের চাহিদানুযায়ী ভ্যানগাড়ির অস্থায়ী দোকানও আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এসব ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা কিংবা পদক্ষেপ আদৌ চোখে পড়েনি।’
পাশাপাশি একাধিক শিক্ষার্থীই করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে ক্যাম্পাস খোলা রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা জানান, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পাস ঠিকই খোলা। খোঁজ নিলে দেখবেন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীর চাইতে বহিরাগতই বেশি। ছুটির দিনে টিএসসি-কার্জনে বসার জায়গা থাকে না।
তারা আরও বলেন, ‘করোনা শুধু ক্লাসরুমেই থাকে। বহিরাগতদের জন্য ক্যাম্পাস মুক্ত করে দিলে তখন করোনা ছড়ায় না! এ ধরণের বিষয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন না।’
কী করছে/বলছে প্রশাসন
অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের উদ্যোগ ‘অনুরোধ ও আহ্বান’ পর্যন্তই। নেই কোনো নিয়মতান্ত্রিক ও শক্ত পদক্ষেপ। বস্তুত এতে আদৌ কোনো সমাধান হবে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।
বহিরাগতদের ‌অবাধ আগমনের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘মুক্ত ক্যাম্পাস হওয়ার কারণে এ ধরণের সমস্যা হচ্ছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি বহিরাগত কমানোর। তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে যাতে তারা বিনা কারণে ক্যাম্পাসে না আসেন। আমরাও যাতে তাদেরকে কেম্পাসে আসতে অনুপ্রাণিত না করি। আমরা যেহেতু ক্যাম্পাসটা বন্ধ করে দিইনি, এই সুযোগটাই বহিরাগতরা নেয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে অবৈধ দোকানপাট বসে। আমরা সবকিছু সীমিত করার ব্যবস্থা নেব।’
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘লাইব্রেরি ও রাস্তা সেখানে আগে থেকেই ছিলো, নতুন করে বানানো হয়নি। আমরা এটাকে সাইলেন্ট জোন হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। আমরা তাদের অনুরোধ করতে পারি যে আপনারা অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজাবেন না। ক্যাম্পাস ‌অতিক্রম করার সময় যাতে আমরা সতর্কতা ‌‌অবলম্বন করি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাঘাট ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমরা তো আর তাদের বলতে পারি না যে, যারা ময়লা ফেলবেন তাদের ব্যাগে আমরা ময়লা পুরে দেব! সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আমরা নিজের ঘরকে যেমন পরিষ্কার রাখি, ঠিক অন্যের ঘরে যখন যাব তখন যাতে সেটাও পরিষ্কার রাখি।’
বহিগতদের করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানও অনেকটাই একই মতামত দেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ঘুরতে আসে। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যাম্পাসে আসে।’
করোনাকালে বহিরাগতদের থামানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না জানতে চাওয়া হলে উপাচার্য বলেন, ‘উন্মুক্ত ক্যাম্পাস হওয়ার ফলেই বাহিরের মানুষজন ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ পায়। তারা শিক্ষার্থী হোক বা অন্য কেউ হোক, সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’ খবর বাংলাদেশ জার্নাল
হককথা/এমউএ

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ঢাবি ক্যাম্পাস যতটা না শিক্ষার্থীদের, তার বেশি বহিরাগতদের

প্রকাশের সময় : ০৮:১৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২

বাংলাদেশ ডেস্ক : মোহাম্মদ সায়েম উদ্দীন (ছদ্মনাম) পরিবারসহ ঘুরতে এসেছেন। সর্বসাকুল্যে পাঁচজন। ঘুরছেন, ছবি তুলছেন, ওয়ানটাইম কাপে করে চা খাচ্ছেন। চা খেয়ে রাস্তায় কাপ ফেলে অন্যদিকে যাচ্ছেন। নগরীর বাসাবো এলাকা থেকে এসেছেন তারা। বোনের পরিবার ঢাকা এসেছে বলে ঘুরতে বের হয়েছেন। মুখে মাস্ক নেই কেন জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনা নেই।’
শুনে মনে হতে পারে কোনো পার্কের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে এটি শুক্রবার সন্ধ্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির চিত্র। সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা জানায়, শুধু শুক্রবার না, যে কোনো ছুটির দিনেই বহিরাগতদের আনাগোনায় বিশ্ববিদ্যালয় একটি পার্কে পরিণত হয়। তাদের ‌অভিযোগ, বহিরাগতদের কেন্দ্র করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং ঘটছে নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
বিগত সময়ের কিছু নজির দেখলে বিষয়টির ভালো ধারণা পাওয়া যায়। গত ২০২১ সালের ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ সংলগ্ন এলাকা থেকে মদসহ চার যুবককে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে নারী উত্যক্তকরণের অভিযোগও ছিল। একই বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম টিএসসিতে হাঁটার সময় এক ভবঘুরের দ্বারা তার পিঠে ও কাঁধে হাত দিয়ে হয়রানির অভিযোগ তোলেন।
একই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাথে নিয়ে অভিযান চালিয়ে বহিরাগতর আনাগোনা ও ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে ভারী যানবাহনের চলাচল অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ ডিসেম্বর ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ উদযাপনের সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্রিয় থাকার কারণে বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাসে দিবসটি উদযাপন করতে পারে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে নিজেদের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন অনেক শিক্ষার্থী।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আবারও খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে গত ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আবাসিক ভবন শেখ রাসেল টাওয়ারের বিপরীতে ডাস্টবিন থেকে একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আবার আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় পরিত্যক্ত একটি বাক্স থেকে কাপড়ে মোড়ানো দুই নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ধরণের ঘটনাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূলত বহিরাগতদের আনাগোনা ও প্রশাসনের গাফেলতিকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি করোনার সংক্রমণের বিষয়টিও তুলে ধরেন তারা। তাদের অভিযোগগুলো হলো, ক্যাম্পাসের সর্বত্র ময়লার ভাগাড় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ভারী যানবাহন, অনাকাঙ্খিত গাড়িঘোড়া ও ভ্যান দোকানের ফলে সৃষ্ট যানজট এবং লাইব্রেরিতে হর্নের আওয়াজে পড়তে না পারা।
ক্যাম্পাসের সর্বত্র আবর্জনার ভাগাড়
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসের সর্বত্র অনাকাঙ্খিত ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এর জন্য তারা মূলত বহিরাগতদের দায়ী করছেন। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নেছার উদ্দীন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন একটা ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনার স্তুপ ও দুর্গন্ধ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশ। এর সিংহভাগই বহিরাগত দর্শনার্থীদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ধরণের কাজ করতে পারে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিএসসির ‘মেলা’ দেখতে এসে দর্শনার্থীরা খাবারের উচ্ছিষ্ট, বাচ্চার ডায়াপারসহ সব ধরণের ময়লা রাস্তায় কিংবা বসার স্থানে ফেলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। টিএসসি ছাড়া পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই এমন চিত্র দেখা যায়। অথচ এসবে চোখ পড়ে না প্রশাসনের।’
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে নেই পড়ার পরিবেশ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গাড়ির হর্নের আওয়াজে পড়তে না পারার অভিযোগ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বীন মো. শরীফ বলেন, ‘আমি হলে থাকি। হলের রিডিংরুমগুলোর খোঁজ নিলে দেখবেন সিট কম থাকার কারণে ওখানে পড়ার সুযোগ থাকে না। তাই এত দূর হেঁটে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পড়তে আসি। কিন্তু এখানে এসেও যে ভালোভাবে পড়ব তার সুযোগ থাকে না। লাইব্রেরি রাস্তার পাশে হওয়ায় যে কোনো ধরণের বড় আওয়াজ কানে আসে। ইদানিং ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে বাস, ভারী যানবাহন ও বিশেষ করে প্রাইভেটকারের চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়িগুলোর হর্নের আওয়াজে লাইব্রেরিতে বসা যায় না।’
একই বিভাগের মো. রেদওয়ান রিয়াদ বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ এই হর্নের আওয়াজ শুনতে শুনতে একঘেঁয়েমি চলে আসে। এই এলাকার রাস্তাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিরই বিকল্প রাস্তা আছে। কিন্তু শর্টকাট নেয়ার জন্য গাড়িগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যায়। হর্নের আওয়াজে পড়ায় মন বসানো যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কার-বাস যদি বন্ধ করা যেত তবে এতটা সমস্যা হতো না। রিকশার মতো ছোট বাহনের আওয়াজ লাইব্রেরির ভেতর পর্যন্ত আসে না। প্রশাসন চাইলেই এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জনগণ এভাবে ব্যবহার করতে পারে না।’
অনাকাঙ্খিত যানজট
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাকাঙ্খিত গাড়ি চলাচল ও যানজটসহ নিরাপত্তাহীনতার কথাও বলছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি গত বৃহস্পতিবার পলাশী মোড়ে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় ইয়াসিন (৩০) নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তিনি রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র মো. আরমান বলেন, ‘বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চেয়ে বহিরাগতদের সংখ্যা সবসময় বেশি থাকে। মানুষের ভিড় এবং ভ্যানগাড়ির দোকান ক্যাম্পাসকে রীতিমতো পার্কে পরিণত করেছে। তাছাড়া ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে উন্মুক্তভাবে বহিরাগত ভারী গাড়ির চলাচল রীতিমতো শহরের ব্যস্ততম সড়কেই রূপান্তরিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কগুলোকে। ক্যাম্পাসে এভাবে সদর্পে গাড়ির চলাচল ও যানজট শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তিতে রেখেছে।’
তিনি বলেন, ‘নিজেদের ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীরা নির্ভিঘ্নে চলাচল করতে পারে না। নিয়মিত দুর্ঘটনা তো আছেই। পাশাপাশি মানুষের চাহিদানুযায়ী ভ্যানগাড়ির অস্থায়ী দোকানও আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এসব ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা কিংবা পদক্ষেপ আদৌ চোখে পড়েনি।’
পাশাপাশি একাধিক শিক্ষার্থীই করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে ক্যাম্পাস খোলা রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা জানান, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পাস ঠিকই খোলা। খোঁজ নিলে দেখবেন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীর চাইতে বহিরাগতই বেশি। ছুটির দিনে টিএসসি-কার্জনে বসার জায়গা থাকে না।
তারা আরও বলেন, ‘করোনা শুধু ক্লাসরুমেই থাকে। বহিরাগতদের জন্য ক্যাম্পাস মুক্ত করে দিলে তখন করোনা ছড়ায় না! এ ধরণের বিষয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন না।’
কী করছে/বলছে প্রশাসন
অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের উদ্যোগ ‘অনুরোধ ও আহ্বান’ পর্যন্তই। নেই কোনো নিয়মতান্ত্রিক ও শক্ত পদক্ষেপ। বস্তুত এতে আদৌ কোনো সমাধান হবে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।
বহিরাগতদের ‌অবাধ আগমনের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘মুক্ত ক্যাম্পাস হওয়ার কারণে এ ধরণের সমস্যা হচ্ছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি বহিরাগত কমানোর। তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে যাতে তারা বিনা কারণে ক্যাম্পাসে না আসেন। আমরাও যাতে তাদেরকে কেম্পাসে আসতে অনুপ্রাণিত না করি। আমরা যেহেতু ক্যাম্পাসটা বন্ধ করে দিইনি, এই সুযোগটাই বহিরাগতরা নেয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে অবৈধ দোকানপাট বসে। আমরা সবকিছু সীমিত করার ব্যবস্থা নেব।’
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘লাইব্রেরি ও রাস্তা সেখানে আগে থেকেই ছিলো, নতুন করে বানানো হয়নি। আমরা এটাকে সাইলেন্ট জোন হিসেবে ঘোষণা করতে পারি। আমরা তাদের অনুরোধ করতে পারি যে আপনারা অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজাবেন না। ক্যাম্পাস ‌অতিক্রম করার সময় যাতে আমরা সতর্কতা ‌‌অবলম্বন করি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাঘাট ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমরা তো আর তাদের বলতে পারি না যে, যারা ময়লা ফেলবেন তাদের ব্যাগে আমরা ময়লা পুরে দেব! সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আমরা নিজের ঘরকে যেমন পরিষ্কার রাখি, ঠিক অন্যের ঘরে যখন যাব তখন যাতে সেটাও পরিষ্কার রাখি।’
বহিগতদের করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানও অনেকটাই একই মতামত দেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ঘুরতে আসে। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যাম্পাসে আসে।’
করোনাকালে বহিরাগতদের থামানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না জানতে চাওয়া হলে উপাচার্য বলেন, ‘উন্মুক্ত ক্যাম্পাস হওয়ার ফলেই বাহিরের মানুষজন ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ পায়। তারা শিক্ষার্থী হোক বা অন্য কেউ হোক, সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’ খবর বাংলাদেশ জার্নাল
হককথা/এমউএ