ইউক্রেন: রাশিয়াকে মোকাবেলা বাইডেনের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ

- প্রকাশের সময় : ০৬:৫৮:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২
- / ২৭ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : ওয়াশিংটনে ১৯৮০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাস নিয়ে যা হয়েছিল- সে কাহিনী যে কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসের প্লটকেও হার মানাবে।
দূতাবাসে বসে রাশিয়ানরা কি করছে, কি বলছে- তা আড়ি পেতে শোনার জন্য ভবনের নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। সে কথা অবশ্য একজন ডাবল এজেন্টের কারণে ফাঁস হয়ে যায়।
সেই অবিশ্বাস্য মাত্রার রেষারেষি যদিও এখন আর নেই। কিন্তু রুশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে উত্তেজনা এখন আবারও বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে।
সেই পুরানো শত্রুর সাথে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কীভাবে সামাল দেন, সেটাই এখন সংকটের সময় নেতা হিসেবে যোগ্যতা প্রমাণে তার সামনে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি করে একনায়ক স্বৈরাচারী শাসকদের চ্যালেঞ্জ করার যে নীতি তিনি নিয়েছেন- তার সাফল্য-ব্যর্থতাও অনেকটাই নির্ধারিত হবে ইউক্রেন পরিস্থিতির কী পরিণতি হয়, তার ওপর।
‘ইউক্রেনের ওপর থেকে হাত সরাও’- ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনা সমাবেশের পর থেকে এই বার্তা ওয়াশিংটন থেকে জোরেশোরে ক্রমাগত পুতিনকে পাঠানো হচ্ছে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে রুশ দূতাবাসের সামনে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীর কণ্ঠে স্লোগানও ছিল সেটাই।
যুক্তরাষ্ট্রে অনেক রাজনীতিক এবং বৈদেশিক নীতির গবেষক এখন বলছেন, ইউক্রেনে আরও অস্ত্র পাঠাতে হবে এবং তাহলেই পুতিনের কানে পানি যাবে।
তাদের কথা, রুশ প্রেসিডেন্ট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে যেসব সিগন্যাল পাচ্ছিলেন, তা ছিল মিশ্র। সেই সিগন্যাল এখন স্পষ্ট করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুগ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য জটিলতা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ সামলাতে যখন এফবিআই গলদঘর্ম হচ্ছিল, সে সময় ট্রাম্প পুতিনের গুণগানে ব্যস্ত ছিলেন এবং একইসাথে নেটোকে অবজ্ঞা করছিলেন।
কিন্তু জো বাইডেন নির্বাচনের আগে এবং পরে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তার পূর্বসূরির ওই নীতি তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন এবং পুতিনের ‘আগ্রাসী’ আচরণকে চ্যালেঞ্জ করবেন।
কিন্তু একই সাথে বাইডেন রাশিয়ার সাথে ‘একটি স্থিতিশীল ও স্পষ্ট’ সম্পর্ক গড়তে চাইছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত চ্যালেঞ্জ যে দেশটির কাছ থেকে আসছে, সেই চীনকে মোকাবেলার প্রতি তিনি মনোনিবেশ করতে পারেন।
ফলে, রাশিয়ার সীমান্তে নেটো জোটের সম্প্রসারণ বন্ধের দাবিতে পুতিন যখন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন বাইডেন একটা হোঁচট খান।
কিন্তু প্রাথমিক সেই ধাক্কা সামলে বাইডেন সেই চ্যালেঞ্জকে এমন গুরুত্ব দিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা শুরু করেছেন, যার নজির দেখা যায় শীতল যুদ্ধের সময়ে তৈরি হওয়া বড় বড় সংকটের সময়।
বাইডেন প্রশাসন এখন রাশিয়ার প্রশ্নে ইউরোপে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
কারণ, বাইডেন জানেন যে, ইউক্রেনে রুশ হামলার বদলা হিসাবে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি তিনি পুতিনকে দিচ্ছেন, তা কার্যকর করতে ইউরোপকে এক নৌকায় আনতে হবে।
প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ন্যাটো দেশগুলোকে সাথে রাখছেন। যদিও এটি তার ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতি, তারপরও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে পশ্চিমা মিত্রদের সাথে যে দূরত্ব তার তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বাইডেন শিক্ষা নিয়েছেন।
আফগান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পশ্চিমা মিত্রদের মতবিরোধ ক্রেমলিনের নজর এড়ায়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর রাশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর সাবেক যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক ড্যানিয়েল ফ্রাইড বলেন, ‘আমার মনে হয় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে সৃষ্ট ঘটনাবলী নিয়ে পুতিন হিসাব-নিকাশ করেছেন। তিনি মনে করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা পড়তির দিকে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ইউরোপের প্রতিরক্ষা আর আফগানিস্তানে ভঙ্গুর অবস্থান ধরে রাখার মধ্যে সবসময়ই একটি পার্থক্য ছিল। এটা অনেকটা ভিয়েতনাম পরিস্থিতির মত। ভিয়েতনামে আমাদের ব্যর্থতা, সর্বনেশে পরিণতির কারণে পশ্চিমা ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সক্ষমতা এবং প্রত্যয় যে ভেঙ্গে পড়েছিল তা নয়। সেটা কখনই হয়নি। সুতরাং আমার মনে হয় পুতিন বেশি আশা করেছিলেন।’
তবে, এখনও ক্রেমলিনই মূলত ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে। পুতিনের শক্ত অবস্থানের কারণেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আসছে। আগামীতে তিনি কী করবেন, তার মনে কী রয়েছে- সেই ভাবনায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।
‘আমাদের বুঝতে হবে যে প্রেসিডেন্ট পুতিন একজন পোকার (তাসের জুয়া) খেলোয়াড়,’ বলছেন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য অমি বেরা, যিনি সম্প্রতি ইউক্রেনের সমর্থনে দুই দলের কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে কিয়েভ সফরে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আপনি জানেন না যে তার হাতে কী তাস রয়েছে। সেই তাস সত্যিই শক্ত, নাকি তিনি ব্লাফ (ধাপ্পা) দিচ্ছেন?’
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ।
জো বাইডেন সোজা-সাপ্টা কথা বলার মানুষ। তিনি জুয়াড়িদের মত ধাপ্পায় অভ্যস্ত নন। কিন্তু তার হাতেও খেলার মত তুরুপের তাস রয়েছে। কিন্তু সেই তাস কি?
তিনি ইউক্রেন এবং নেটোর সম্প্রসারণ ইস্যুতে পশ্চিম ইউরোপের সাথে এমন একটি ঐক্য তৈরি করেছেন, যা হয়তো ক্রেমলিন ধারণা করতে পারেনি। পশ্চিমা জোটের কাছ থেকে এ শক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে পুতিনকে হয়তো একটু রয়ে-সয়ে এগুনোর কথা ভাবতে হচ্ছে।
পুতিনের নীতিও বাইডেনকে এ ঐক্য তৈরিতে সাহায্য করেছে। তার ক্রমাগত সেনা সমাবেশ এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো তৎপরতা হ্রাসের দাবির কারণে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির পক্ষে মিত্রদের রাজী করানো সহজ হয়েছে। তারা হয়তো নতুন করে ভাবছে যে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো জোট এখনও প্রাসঙ্গিক, এখনো প্রয়োজন।
তবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কখন সেই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে এবং তার আওতায় কতটা বিস্তৃত হবে, তা নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশই দ্বিধাগ্রস্ত। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের পথ না গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে চাপ তৈরির কৌশল নেয়, তাহলে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ইউরোপে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরি কঠিন হবে।
রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া খুব সহজ নয় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য। অনেক ঝুঁকি রয়েছে।
বাইডেন তা জানেন এবং সে কারণে তার প্রশাসন ন্যাটোতে ইউক্রেনকে নিষিদ্ধ করার দাবি না মানলেও ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে মস্কোর সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, যদিও সেই প্রস্তাবের সাথে পুতিনের দাবির বিস্তর ফারাক।
তবে নেটো জোটে ইউক্রেনকে কখনই নেয়া চলবে না বলে যে দাবি প্রেসিডেন্ট পুতিন করেছেন, সে ব্যাপারে কোনো একটি প্রতিশ্রুতি ছাড়া তিনি ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে আনবেন এমন সম্ভাবনা কম।
তবে নেটোর ‘মুক্ত দুয়ার’ নীতি, অর্থাৎ শর্ত পূরণে সক্ষম যে কোনো ইউরোপীয় দেশ চাইলে জোটের সদস্য হতে পারবে- সেটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে ‘রেড-লাইন’ অর্থাৎ এ নিয়ে তিনি আপোষ করবেন না।
কিন্তু ইউক্রেন এখনো ন্যাটো সদস্যপদের সব শর্ত পূরণ করেনি এবং এখনও তাদের সময় লাগবে। রাশিয়ার সাথে একটি আপোষ-মীমাংসার রাস্তা হিসাবে এ নিয়েই ওয়াশিংটনে এখন কানাঘুষো শুরু হয়েছে।
টমাস গ্রাহাম- যিনি জর্জ বুশ ক্ষমতায় থাকাকালে রাশিয়ার সাথে সংলাপের দায়িত্বে ছিলেন, ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদের ওপর একটি অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারির প্রস্তাব দিয়েছেন।
টমাস গ্রাহাম বলেন, ‘এটি ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করা নয়।’ তিনি বলেন, ‘এটি বরঞ্চ বিপজ্জনক একটি ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে যাওয়ার বিপদ থেকে ইউক্রেনকে রক্ষার একটি চেষ্টা।’
রাশিয়ার সাথে একটি দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও ন্যাটো জোটে ইউক্রেনের সদস্যপদের পক্ষ নেয়া কতটা যথার্থ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ট্রাম্প-পন্থী অনেকেই।
এমনকি ডেমোক্র্যাট সেনেটর ডিক ডারবিনও গ্রাহামের দেয়া প্রস্তাবের লাইনেই একটি সমাধানের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কির হাতে।
সম্প্রতি এনবিসি টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে সেনেটর ডারবিন বলেন, ‘তিনি (ইউক্রেনের নেতা) যদি দেখেন যে তার সামনে দুটো বিকল্প- ন্যাটোর সদস্যপদ এবং ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার দখলদারিত্ব- তাহলে আমরা একটি সমাধান খুঁজে পেতে পারি।’
অর্থাৎ ডারবিন বলার চেষ্টা করেন যে জেলেনস্কি চাইবেন না যে, তার দেশ রাশিয়া কব্জা করুক এবং সেই আশঙ্কা থেকে আপাতত তিনি নিজেই ন্যাটোর সদস্যপদে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন এবং তাতে উত্তেজনা কমবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির দায়িত্বে যারা এখন রয়েছেন, তারা মনে করেন ইউক্রেনকে নিয়ে পুতিনের দাবি মেনে নেয়ার অর্থ হবে রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ। তারা মনে করছেন শীতল যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের বিজয়ের পর এই আত্মসমর্পণ চলবে না।
ড্যানিয়েল ফ্রাইড বলছেন, বাইডেন স্বৈরতন্ত্রের সাথে লড়াইতে যখন নেমেছেন তখন তাকে দেখাতে হবে তিনি সেইমত কাজ করছেন।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘পুতিনের মত একজন আগ্রাসী স্বৈরাচারীকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সেইমত ভূমিকা রাখতে হবে। তবে মিডিয়ার চাহিদামত দুই-তিন সপ্তাহে এর সমাধান হবে না। বরঞ্চ দীর্ঘ একটি সময়ের জন্য আপনারা তৈরি থাকুন।’
প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানেন যে দেশটিকে তিনি গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসাবে যাকে দেখেন, সেই চীন গভীরভাবে নজর রাখছে তিনি রাশিয়াকে কীভাবে মোকাবেলা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে চীন এবং রাশিয়া এখন নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির তাড়না অনুভব করছে। গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে পুতিন ও শি জিনপিংয়ের একসাথে তোলা ছবিতে সেই তাড়না প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন পরিষ্কার করে দিয়েছেন স্বৈরতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার আদর্শিক লড়াইতে তিনি পিছু হটবেন না। এটাই তার বিদেশ নীতির নির্যাস। আর এ লড়াইতে বাইডেন জিতবেন কি হারবেন, ইউক্রেনে হবে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
হককথা/এমউএ