ইউরোপজুড়ে ভ্যাকসিনবিরোধী আন্দোলন জোরালো হচ্ছে

- প্রকাশের সময় : ০৬:১৫:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী ২০২২
- / ৮১ বার পঠিত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নতুন বছরের শুরুতেই পুরো ইউরোপ উত্তপ্ত হয়েছে ভ্যাকসিনবিরোধী আন্দোলনে। ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিকসহ ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার ভ্যাকসিনের বিষয়ে সরকারি বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে চলছে এই বিক্ষোভ। বেশিরভাগ স্থানেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও, কিছু শহরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কিছু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। বিক্ষোভকারীরা ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপারটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
‘বিবিসি’ বলছে যে, এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, এবারের বিক্ষোভ তার চেয়ে চার গুণ বড় ছিল।
‘আলজাজিরা’ বলছে, ৮ জানুয়ারি ভ্যাকসিনের বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করে ফ্রান্সে ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। পুলিশ বলছে, রাজধানী প্যারিসে প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১৮ হাজার মানুষ ‘সত্য’, ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘ভ্যাকসিন পাস মানি না’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেন। অনেকেই তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রে রেখেছিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে। এক সপ্তাহ আগেই ম্যাক্রোঁ ‘লে প্যারিসিয়ান’ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাতে ভ্যাকসিনবিরোধীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত খারাপ শব্দ ব্যবহার করে হুমকি দেন, যারা ভ্যাকসিন নেবে না তিনি তাদের জীবন এতটাই দুর্বিষহ করে ফেলবেন যে, তারা বাধ্য হবে ভ্যাকসিন নিতে। আন্দোলনকারীরা ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধেও একই ধরনের খারাপ শব্দ ব্যবহার করে প্রতিবাদ করেন।
একজন বিক্ষোভকারী ‘রয়টার্স’কে বলেন, এটা ছিল ম্যাক্রোঁর ‘শেষ চেষ্টা’। বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, সরকার তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা ছাড়াও নাগরিকদের মাঝে পার্থক্য করছে।
এই বিক্ষোভ এমন সময়ে এলো, যখন এক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সে ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়্যান্টের কারণে একদিনে ৩ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতমা। ‘
বিবিসি’র মতে, ১২ বছরের বেশি বয়সের জনগণের ৯০ শতাংশকেই পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আইসিইউগুলো ভর্তি হয়ে যাচ্ছে; হাসপাতালগুলো চাপের মধ্যে রয়েছে। আর ৬ জানুয়ারি ফ্রান্সের পার্লামেন্টে আইন পাস করে বলা হয় যে, জনগণকে রেস্টুরেন্টে খেতে, আন্তঃশহর বাসে চড়তে বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন নিতে হবে।
‘বিবিসি’ আরও বলছে, ফরাসি সিনেটে বিরোধী দলের শক্তি বেশি থাকায় সেখানে বিল পাস হতে কিছু সময় লাগতে পারে। এই আইন ১৫ জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়িত হবার কথা রয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে পুলিশ ৩৪ জনকে গ্রেফতার করে। ১০ জন পুলিশ অফিসারও কিছুটা আহত হয়। মঁপেলিয়ে শহরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে।
অস্ট্রিয়ার পুলিশের মতে, রাজধানী ভিয়েনাতে ৪০ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। সেখানে আগামী মাস থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জার্মানিতেও অনেক শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মাঝে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয় হামবুর্গ শহরে; যেখানে ১৩ হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। সেখানে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘যথেষ্ট হয়েছে; আমাদের সন্তানদেরকে রেহাই দাও’। একজন বিক্ষোভকারী তার গায়ে ইহুদিদের ‘স্টার অব ডেভিড’ বহন করছিলেন; যেখানে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি’। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদিদের গায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ‘স্টার অব ডেভিড’ এঁকে রাখার নির্দেশনার সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। জার্মানিতে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা চলছে। সেখানে এক মাস আগে থেকে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে।
‘ডয়েচে ভেলে’র মতে, ৯ জানুয়ারি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন। পুলিশ ৪১ জনকে গ্রেফতার করে। বিক্ষোভকারীদের প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন একনায়কতন্ত্র’। বেলজিয়ামে রেস্টুরেন্ট, বার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কোভিড পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে এক সপ্তাহে নতুন সংক্রমণ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। চেক রিপাবলিকে ৬০ বছরের ওপরে জনগণ, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দেশটির নতুন কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা নেবার আগে এই পরিকল্পনাগুলোর বিরোধিতা করেছিল। এখন ক্ষমতায় গিয়ে নীতি পরিবর্তন করে তারা বিভিন্ন পেশাজীবীদের বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাইছে।
ইতালির তুরিন শহরেও শত শত মানুষ বিক্ষোভ করেন। সেখানে ৫০ বছরের বেশি বয়সী সকল ব্যক্তির ভ্যাকসিন নেওয়া বাধ্যমূলক করা হয়েছে। আর ১১ জানুয়ারি থেকে ইতালিতে ভ্যাকসিন না নিলে কেউ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে পারবে না, অথবা গণপরিবহনে চড়তে পারবে না। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাক ‘ডাই আম সনটাগ’ পত্রিকাকে বলেন, স্বল্পসংখ্যক মানুষ সব বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় মিথ্যা তথ্যের মাঝে ডুবে থাকতে চাইছে। তিনি আরও বলেন, ভ্যাকসিনবিরোধীরা এবং করোনাভাইরাসকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দেওয়া মানুষেরা সব মাপকাঠি এবং লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে।
‘ডয়েচে ভেলে’র মতে, জার্মানির মিনডেন শহরে আড়াই হাজার এবং ড্রেসডেন শহরে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে মানববন্ধন করেন। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা ভ্যাকসিন বিরোধীদের আক্রমণের শিকার। এর মাঝে ৭ জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার পুরোপুরি ভ্যাকসিন নেবার পর বুস্টার ডোজ নিয়েও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ইউরোপের সরকারগুলো করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের দুই শতকের ব্যক্তি স্বাধীনতাভিত্তিক চিন্তাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে তুলে ধরতে চাইলেও সরকার তাদের সংখ্যাকে ছোট বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ডোজের পর ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও যখন ‘ওমিক্রন’এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি; লিবারাল আদর্শ নয়।
ফ্রান্স ও চেক রিপাবলিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে, রাজনীতিবিদরা মূলত জনগণের মতামতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।
হককথা / এমউএ