ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্বের সংগঠক সাংবাদিক নুরুল ইসলামের ইন্তেকাল

- প্রকাশের সময় : ০৯:৫৭:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২
- / ১৭৪ বার পঠিত
বিশেষ প্রতিনিধি: ভাষা সৈনিক,মহান মুক্তিযুদ্বের অন্যতম সংগঠক বঙ্গবন্ধুর ¯েœহধন্য এবং বহুল প্রচারিত ‘প্রবাসীর কথা’ বইয়ের লেখক, বাংলা একাডেমীর ফেলো, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক নুরুল ইসলাম এর রাস্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে, শুক্রবার ব্রিকলেন মসজিদে জানাজা শেষে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। হাই কমিশনের পক্ষ থেকে তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুষ্ঠানিক শোক জানানো হয়, পরে পীস গার্ডেনে নুরুল ইসলামকে চিরবিদায় জানানো হয়। উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারী লন্ডনের একটি হাসপাতালে করোনারোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লন্ডন সময় মঙ্গলবার রাত ৭টা ১৫মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার (ইন্নালিল্লøাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একছেলে, এক মেয়েসহ নাতি নাতনি, আতœীয়, স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভোগছিলেন, তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ১৯৩২ সালের পহেলা জুন সিলেটের সদরখোলায়। তার মৃত্যুর ফলে একটি ইতিহাসের বিদায় হলো।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী নুরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে মুরছালীন ইসলাম জানান, সম্প্রতি তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হলে এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তারা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। লীভার সমস্যাাসহ নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে মুরছালীন বলেন গত ২৭ ডিসেম্বর থেকে নুরুল ইসলাম চিকিৎসকদের নিবীড় পরিচর্যায় ছিলেন। নুরুল ইসলামের বোন লিলি আহমদ জানান ৭ ভাই বোনের মধ্যে নুরুল ইসলাম ছিলেন সবার বড়, আর তিনি সবার ছোট। তিনি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। ৯ বছর আগে নুরুল ইসলামের একমাত্র ভাই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম মারা যান। এর আগে এবং পরে হারিয়েছেন অন্য বোন।
মরহুম নুরুল ইসলামের ভাগিনা নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক এমদাদ চৌধুরী দীপু বলেন, দেশে এবং প্রবাসে ইংরেজী দৈনিকে সাংবাদিকতা করতেন নুরুল ইসলাম, ছিলেন সিলেট প্রেসক্লাবের সদস্য, ছাত্র জীবনে সহপাটি ছিলেন মরহুম অর্থমন্ত্রী এম, সাইফুর রহমানের, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের। অন্তিম ইচ্ছা ছিল তার জন্ম মাটি সিলেট সদর উপজেলার হাদারখোলায় একটি গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করবেন, তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সুরমা নদীর তীরে উন্নত বিশ্বের ন্যায় একটি গ্রন্থাগার এখন দৃশ্যমান।
সিলেট সদর উপজেলার সদরখোলা গ্রামের মরহুম হাজী মুবশ্বির আলী এবং শিক্ষিকা মরহুম নুরুন্নেছা চৌধুরীর বড় ছেলে নুরুল ইসলামের বর্নাঢ্য কর্মজীবনের ইতিহাস বিম্বয়ের। দেশের জাতীয় ইস্যু রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, প্রবাসী কল্যাণসহ নানা ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও যুক্তরাজ্যে বাঙালী কমিনিউটির বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজে নূরুল ইসলামের অবদান ছিল অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রেরণার। মেধাবী ছাত্র নুরুল ইসলাম ছাত্র জীবনে ছাত্রনেতা হয়ে উঠেন, নির্বাচিত হোন সিলেট এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস। ১৯৫২-৫৩ সালে এমসি কলেজের জিএস নুরুল ইসলাম ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে।
সিলেট এমসি কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৫২-৫৩ সালে কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনরত ছাত্রদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তৎকালীন গোবিন্দপার্কে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক প্রথম সভায় তিনি সভাপতিত্ব করার বিরল গৌরবের অধিকারী হন।
ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য নুরুল ইসলাম ১৯৫৬ সালের ৬ নভেম্বর বিলাতে আসেন। লন্ডনে তিনি ১৯৫৮ সালের আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ১৯৬৩ সালে ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন’ গঠনের অন্যতম প্রধান এবং ১৯৬৪ সালে ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে ভ্রমণকালীন লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউসকেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে তাঁর লেখাপড়ার সেখানেই ইতি ঘটে! তিনি দেশে ফিরে ৬-দফা আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, এবং শেষ পর্যন্ত ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে সেক্টর ৪ এ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১-৭২ সালে স্বাধীনতার পর তিনি প্রশাসনিক সচিব ছিলেন। ভারতে তখন ৪ ও ৫ নং সেক্টরের প্রতিনিধি দেওয়ান ফরিদ গাজীর (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন) একান্ত সচিব ছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রবাসীদের কল্যাণার্থে ‘প্রবাসী বাঙালী কল্যাণ বোর্ড’ গঠিত হলে এটির সচিব হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন তিনি। সিলেট মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বচিত হোন তিনি এবং ১৯৫৩-৫৪ সালে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করে ছাত্র ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সক্রিয়ভাবে ভুমিকা রাখেন। তিনি ১৯৫৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের নেতা, ১৯৬৩ সালে ন্যাশন্যাল ফেডারেশন অব পাকিস্তান এসোসিয়েশনের ইন গ্রেট বৃটেনের গঠনের উদ্যোগতা এবং প্রধান ছিলেন, ১৯৬৪ সালে ইস্ট পাকিস্তান হাউসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-র নির্বাচন, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্বের সময় দেশে বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। ১৯৭৮ সালে তিনি সিলেটের জিন্দাবাজারে বাংলাদেশ ওভারসীজ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন প্রবাসীদের কল্যাণে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি। সিলেটে প্রবাসী সন্তানদের পড়ার সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন খাজাঞ্চীবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি লন্ডন থেকে প্রকাশিত দেশের ডাক, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান টুডে এবং প্রাচীন ডন পত্রিকার লন্ডন প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি বাংলাদেশ অভজারভার এবং নিউনেশন পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।।
তিনি যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের’ প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী যা পূর্বে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন নামে ছিল ও ‘পাকিস্তান ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন, যা বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিযেশন’ নামে পরিচিত। এছাড়াও তিনি সিলেটে ‘ওভারসিজ সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিনিয়র কো-ওর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পাকিস্তান এসোসিয়েশন ইন ইউকের ফাউন্ডার জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি বৃটেন ও বাংলাদেশের আরও বহু সংগঠনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে সেক্টর ৪ এ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং যুগো¯øাভিয়া সফর করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন বাড়াতে। ১৯৭১ সালে দেওয়ান ফরিদ গাজীর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-৭২ সালে স্বাধীনতার পর তিনি প্রশাসনিক সচিব ছিলেন। ২০১২ সালে তাঁকে তাঁর বই ‘প্রবাসীর কথা’ লেখক হিসাবে সসম্মানে বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ দেওয়া হয়। গবেষণা গ্রন্থ ‘প্রবাসীর কথা’র অসামান্য অবদান রয়েছে বিশ্ব অভিবাসনের ক্ষেত্রে। ২০১৩-১৮ তিনি বোর্ড সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের। ২০১৩ সালে অভিবাসনের উপর তার দ্বিতীয় গবেষণা বই ‘ঋৎড়স ঝড়লড়ঁৎহবৎ ঃড় ঝবঃঃষবৎং’ সম্পূর্ণ করেছেন। বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত।
শোক প্রকাশ: সাংবাদিক ও গবেষক নূরুল ইসলামের ইন্তেকালে বাংলা পত্রিকা ও টাইম টেলিভিশন পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন প্রতিষ্ঠান দুটির সিইও/সম্পাদক আবু তাহের। এছাড়াও মৌলভীবাজার ডিষ্ট্রিক সোসাইটি ইউএস’র পক্ষ থেকে সংগঠনের সভপতি তজমুল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক জাবেদ উদ্দিন শোক ও সমাবেদনা প্রকাশ করেছেন।