নিউইয়র্ক ০৪:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নাগরিক সাংবাদিকতার আদি আমেরিকা থেকে বর্তমান বাংলাদেশ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:৫১:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২
  • / ৯৩ বার পঠিত

সিফাত আরা তাবাসসুম: নাগরিক সাংবাদিকতা ইন্টারনেট আশীর্বাদপুষ্ট নাগরিকের মত প্রকাশের অনন্য সংযোজন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অনলাইনে নাগরিক সাংবাদিকতার উচ্চারণ ঘটেছে ধাপে ধাপে এবং এই মুহূর্তে বিগত বছরের চেয়ে এর চর্চা ও জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। যদিও নাগরিক সাংবাদিকতার তাত্তি¡ক ও শেকড় নিয়ে ধারনাটা এই বলয়ের বাইরের গোষ্ঠীর কাছে অস্পষ্টই।
পেশাদার সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠত্ব যতই থাকুক, আদি সাংবাদিকতা মূলত নাগরিক সাংবাদিকতাই। তাহলে কবে ছিল এই নাগরিক সাংবাদিকতার জন্মলগ্ন? সেই ইতিহাস এখন অনেকটা পুরাকথা। বিভিন্ন সংস্করণও রয়েছে। যেমন- আব্রাহাম জ্যাপরুডারকে (Abraham Zapruder) ‘নাগরিক সাংবাদিকতার জনক’ বলা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকান্ডের আটান্ন বছর হতে চলছে। গণনা করা হয় নাগরিক সংবাদিকতারও বয়স আটান্ন হবে।
১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই মুহূর্তটিকে জ্যাপরুডার ধারণ করেন তার সাধারণ চলমানদৃশ্য ধারণ ক্যামেরায়। এই আধ্যেয়টিকে নাগরিক সাংবাদিকতার আদি দৃষ্টান্ত মানা হয় এবং জ্যাপরুডারকে বলা হয় নাগরিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।
নাগরিক সাংবাদিকতার জন্ম ইতিহাসের আরেক পর্ব ঔপনিবেশিক যুগের। আমেরিকার প্রথম পত্রিকা প্রকাশকারী পেশায় ছিলেন বোস্টন শহরে বই বিক্রেতা ও প্রকাশক। বেঞ্জামিন হ্যারিসের (Benjamin Harris) পত্রিকা পাবলিক অকারেন্সেস (Publick Occurrences) প্রকাশ হয়েছিল ১৬৯০ সালে। এর শেষ পৃষ্ঠাটি ইচ্ছাকৃতভাবে খালি রাখা হতো যেন নগরবাসীরা বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সাথে পত্রিকা বিনিময়কালে তাতে স্থানীয় ঘটনা বা পাদটিকা হাতে লিখে দিতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরিতে (University of Missouri) সাংবাদিকতা অনুষদের জন্মলগ্ন ১৯০৮ সাল হচ্ছে পেশাদার সাংবাদিকতা শিক্ষার যাত্রাবর্ষ। তাহলে এর পূর্বে যারাই সংবাদ সংগ্রহ, প্রকাশ ও বিতরণে কাজ করেছেন, তারা সকলেই মূলত নাগরিক সাংবাদিক ছিলেন।
ইন্টারনেটের সূতিকাগার যেমন আমেরিকা, নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও তেমনি গড়ে উঠেছিল আমেরিকাতেই। আলোচিত নাগরিক সাংবাদিকতার দৃষ্টান্তগুলো সেকারণেই যেন হয় আমেরিকাতে, নয়তো আমেরিকাকে ঘিরে। পোশাকি নাম ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে ২০০০ সালের দিকে, তখন সাংবাদিকতা, নাগরিক সাংবাদিকতা আর অনলাইন কমিউনিটি নিয়ে আমেরিকায় পাল্টাপাল্টি আলোচনাও তুঙ্গে। ইন্টারনেটের বাড়ন্ত প্রসারণ এবং নাগরিকদের মাঝে অনলাইন জনপ্রিয়তা নাগরিক সাংবাদিকতাকে উজ্জীবিত করেছিল। ওয়েব ২.০ নাগরিক সাংবাদিকতার শ্রী বৃদ্ধি করে। বলা চলে নাগরিক সাংবাদিকতা গতিপ্রাপ্ত হয় এবং নাগরিকবান্ধব হয়। ডিজিটাল ডিভাইসের ‘স্মিম অ্যান্ড ¯িøক’ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় মোবাইল, ল্যাপটপ, ক্যামেরা সবার হাতে হাতে যতই বৃদ্ধি পেয়েছে, অনলাইনে ততই সরবরাহ বেড়েছে কনটেন্টের। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুক, টুইটারের নামোল্লেখ করা তো যায়ই, একই সাথে কোরিয়ান পোর্টাল OhMyNews.com এবং আমেরিকান গণমাধ্যম সিএনএন এর আইরিপোর্ট (iReport) নাগরিক সাংবাদিকতার বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
অ্যাবোটাবাদে বিন লাদেনের আখরাতে যখন আমেরিকান সৈন্যদের হামলা চলছিল, এর দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থানকারী এক ব্যক্তি লাইভ-টুইট করে যাচ্ছিলেন এমন একটি সিক্রেট মিশন নিয়ে। জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামি বিপর্যয়কালে লাইভ টুইটার আপডেট দেখা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে টুইটার বিপ্লব, ফেসবুক বিপ্লব তাদের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে সহায়তা করেছিল।
এগুলোর অধিকাংশই সম্ভব হয়েছিল, সাধারণ মানুষের কারণে, যাদের নাগরিক সাংবাদিকতায় বিশ্ববাসী নিয়মিতভাবে জানতে পেরেছিল সর্বশেষ খবরটি। এভাবে নাগরিক সাংবাদিকতা আর আমেরিকায় আটকে থাকেনি। খবর প্রস্তুতকারী, খবর পাঠকারী এবং খবরের প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারী সকলেই বৈশ্বিকতার অংশ হয়ে উঠেছে ততদিনে।
বিশ্বে যখন নাগরিক সাংবাদিকতার এমন জনপ্রিয়তা, বাংলাদেশও এই ধারার বাইরে থাকেনি।
সিফাত আরা তাবাসসুম

বাংলাদেশে নাগরিক সাংবাদিকতা করার মত কী আছে? ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মার্ক গেসার ২০০৬ সালে বলেছিলেন, “সিটিজেন জার্নালিজমের পেছনের ধারণাটি হলো, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নেই তারা আধুনিক প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেরা অথবা অন্যের সহায়তায় একটি বিকল্প অথবা তথ্য-যাচাইয়ের মাধ্যম তৈরি করতে পারে। যেমন ধরা যাক, আপনি নগর পরিষদের সভা নিয়ে নিজের বøগ অথবা একটি অনলাইন ফোরামে লিখতে পারেন। এমনকি আপনি একটি মূল গণমাধ্যমের সংবাদপত্রের খবরের তথ্য যাচাই করতে পারেন এবং তথ্যগত ভ্রান্তি বা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে ইঙ্গিত দিতে পারেন আপনার বøগে। অথবা আপনি আপনার এলাকায় পরিবেশন করার মত কোনো ঘটনার একটি ডিজিটাল ছবি তুলতে পারেন এবং অনলাইনে পোস্ট করতে পারেন। অথবা আপনি সেই একই ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করতে পারেন এবং ইউটিউবের মত একটি ওয়েব সাইটে প্রকাশ করতে পারেন।”
নাগরিক সাংবাদিকতা প্রকারান্তরে নাগরিক মত ও মুক্তমত প্রকাশের একটি ধরনও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার ও নাগরিকের মধ্যে ভাব বিনিময়ে বা প্রতিক্রিয়া বিনিময়ে নাগরিক সাংবাদিকতা কার্যকরি। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যম যখন নাগরিক বিশ্বস্ততা হারায় তখন নাগরিক সাংবাদিকতাই নাগরিকের চাহিদা মেটায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সীদের ইন্টারনেট নির্ভরতা ক্রমে বাড়ছে। বিটিআরসির তথ্য মতে গত সেপ্টেম্বরে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। আর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে আট কোটি। সুতরাং অনলাইনে কনটেন্ট সরবরাহ থাকছে নিয়মিত এবং প্রতুল।
ফেইসবুক জনপ্রিয়তার মাঝেও বিষয় হিসেবে নাগরিক সাংবাদিকতা বেছে নিয়ে নষড়ম.নফহবংি২৪.পড়স এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে। ফলে সমগ্র বাংলাদেশের সেই সব সংবাদ উঠে আসছে, যা মূল ধারার গণমাধ্যমে হয় প্রকাশিতই হয় না অথবা পরিশীলিত কাঠামোতে ছাপা হয়।
নাগরিক সাংবাদিকতার এই চর্চায় বরিশালের নাগরিক উত্তরবঙ্গের নাগরিকের সমস্যা জানতে পারছে। চট্টগ্রামের নাগরিক সাংবাদিক তার প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য বিনিময় করছে খুলনার নাগরিক সাংবাদিকের সাথে। ফ্রান্সের সেইন নদী থেকে প্যারিস দেখার আবেদন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীর ভিডিও প্রতিবেদনের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চাঁদপুরের নাগরিক সাংবাদিকের ভিডিও প্রতিবেদনে ডাকাতিয়া নদীটির বেহাল দশা।
হাসপাতালের চিকিৎসা সংকট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন উদ্যোগ, প্রধান সড়কে যানজট সমস্যা, বাসের অন্যায্য ভাড়া, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সময় এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়েও প্রতিবেদন করছেন নাগরিক সাংবাদিকেরা। লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশ ছাড়াও নাগরিক সাংবাদিকরা নিজেরাই ছবি ধারণ করছে, ভিডিও ধারণ করছে।
এসব প্রতিবেদন অনেক ক্ষেত্রেই মূলধারার গণমাধ্যমের পূর্বেই উঠে আসছে। অনলাইনে সাড়াও পাচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর চেয়ে। তাহলে কি নাগরিক সাংবাদিকতা মূল ধারার গণমাধ্যমকে টপকে যাচ্ছে? পেশাদারি সাংবাদিকতার বিপরীতে নাগরিক সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত। ডেভিড সাইমন বলেছেন, “শখের বশে লেখালেখি করা আনপেইড বøগারদের পক্ষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, পেশাদার, ঝানু সাংবাদিকদের জায়গা দখল করা সম্ভব নয়।” এরকম মনোভাব পোষণকারীর সংখ্যা কম নয়। এতে করে নাগরিক সাংবাদিকতা চর্চা বরাবর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আবার এতে নাগরিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞায়নও প্রসারিত হচ্ছে। ফলে নাগরিক সাংবাদিকতার চর্চা থেমে থাকেনি। নাগরিকের পক্ষ থেকে প্রত্যাহবানই তো হচ্ছে নাগরিক সাংবাদিকতা। নাগরিকের ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে নাগরিক সাংবাদিকতা। আবার সচেতন ইন্দ্রিয়ের নাগরিকই কাঙ্খিত নাগরিক সাংবাদিক। তাই নাগরিক সাংবাদিকতার বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ ইতিবাচকই।
লেখক: সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার, বাংলা টিভি

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

নাগরিক সাংবাদিকতার আদি আমেরিকা থেকে বর্তমান বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১২:৫১:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২

সিফাত আরা তাবাসসুম: নাগরিক সাংবাদিকতা ইন্টারনেট আশীর্বাদপুষ্ট নাগরিকের মত প্রকাশের অনন্য সংযোজন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অনলাইনে নাগরিক সাংবাদিকতার উচ্চারণ ঘটেছে ধাপে ধাপে এবং এই মুহূর্তে বিগত বছরের চেয়ে এর চর্চা ও জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। যদিও নাগরিক সাংবাদিকতার তাত্তি¡ক ও শেকড় নিয়ে ধারনাটা এই বলয়ের বাইরের গোষ্ঠীর কাছে অস্পষ্টই।
পেশাদার সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠত্ব যতই থাকুক, আদি সাংবাদিকতা মূলত নাগরিক সাংবাদিকতাই। তাহলে কবে ছিল এই নাগরিক সাংবাদিকতার জন্মলগ্ন? সেই ইতিহাস এখন অনেকটা পুরাকথা। বিভিন্ন সংস্করণও রয়েছে। যেমন- আব্রাহাম জ্যাপরুডারকে (Abraham Zapruder) ‘নাগরিক সাংবাদিকতার জনক’ বলা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকান্ডের আটান্ন বছর হতে চলছে। গণনা করা হয় নাগরিক সংবাদিকতারও বয়স আটান্ন হবে।
১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই মুহূর্তটিকে জ্যাপরুডার ধারণ করেন তার সাধারণ চলমানদৃশ্য ধারণ ক্যামেরায়। এই আধ্যেয়টিকে নাগরিক সাংবাদিকতার আদি দৃষ্টান্ত মানা হয় এবং জ্যাপরুডারকে বলা হয় নাগরিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।
নাগরিক সাংবাদিকতার জন্ম ইতিহাসের আরেক পর্ব ঔপনিবেশিক যুগের। আমেরিকার প্রথম পত্রিকা প্রকাশকারী পেশায় ছিলেন বোস্টন শহরে বই বিক্রেতা ও প্রকাশক। বেঞ্জামিন হ্যারিসের (Benjamin Harris) পত্রিকা পাবলিক অকারেন্সেস (Publick Occurrences) প্রকাশ হয়েছিল ১৬৯০ সালে। এর শেষ পৃষ্ঠাটি ইচ্ছাকৃতভাবে খালি রাখা হতো যেন নগরবাসীরা বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সাথে পত্রিকা বিনিময়কালে তাতে স্থানীয় ঘটনা বা পাদটিকা হাতে লিখে দিতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরিতে (University of Missouri) সাংবাদিকতা অনুষদের জন্মলগ্ন ১৯০৮ সাল হচ্ছে পেশাদার সাংবাদিকতা শিক্ষার যাত্রাবর্ষ। তাহলে এর পূর্বে যারাই সংবাদ সংগ্রহ, প্রকাশ ও বিতরণে কাজ করেছেন, তারা সকলেই মূলত নাগরিক সাংবাদিক ছিলেন।
ইন্টারনেটের সূতিকাগার যেমন আমেরিকা, নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও তেমনি গড়ে উঠেছিল আমেরিকাতেই। আলোচিত নাগরিক সাংবাদিকতার দৃষ্টান্তগুলো সেকারণেই যেন হয় আমেরিকাতে, নয়তো আমেরিকাকে ঘিরে। পোশাকি নাম ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে ২০০০ সালের দিকে, তখন সাংবাদিকতা, নাগরিক সাংবাদিকতা আর অনলাইন কমিউনিটি নিয়ে আমেরিকায় পাল্টাপাল্টি আলোচনাও তুঙ্গে। ইন্টারনেটের বাড়ন্ত প্রসারণ এবং নাগরিকদের মাঝে অনলাইন জনপ্রিয়তা নাগরিক সাংবাদিকতাকে উজ্জীবিত করেছিল। ওয়েব ২.০ নাগরিক সাংবাদিকতার শ্রী বৃদ্ধি করে। বলা চলে নাগরিক সাংবাদিকতা গতিপ্রাপ্ত হয় এবং নাগরিকবান্ধব হয়। ডিজিটাল ডিভাইসের ‘স্মিম অ্যান্ড ¯িøক’ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় মোবাইল, ল্যাপটপ, ক্যামেরা সবার হাতে হাতে যতই বৃদ্ধি পেয়েছে, অনলাইনে ততই সরবরাহ বেড়েছে কনটেন্টের। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুক, টুইটারের নামোল্লেখ করা তো যায়ই, একই সাথে কোরিয়ান পোর্টাল OhMyNews.com এবং আমেরিকান গণমাধ্যম সিএনএন এর আইরিপোর্ট (iReport) নাগরিক সাংবাদিকতার বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
অ্যাবোটাবাদে বিন লাদেনের আখরাতে যখন আমেরিকান সৈন্যদের হামলা চলছিল, এর দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থানকারী এক ব্যক্তি লাইভ-টুইট করে যাচ্ছিলেন এমন একটি সিক্রেট মিশন নিয়ে। জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামি বিপর্যয়কালে লাইভ টুইটার আপডেট দেখা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে টুইটার বিপ্লব, ফেসবুক বিপ্লব তাদের আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে সহায়তা করেছিল।
এগুলোর অধিকাংশই সম্ভব হয়েছিল, সাধারণ মানুষের কারণে, যাদের নাগরিক সাংবাদিকতায় বিশ্ববাসী নিয়মিতভাবে জানতে পেরেছিল সর্বশেষ খবরটি। এভাবে নাগরিক সাংবাদিকতা আর আমেরিকায় আটকে থাকেনি। খবর প্রস্তুতকারী, খবর পাঠকারী এবং খবরের প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারী সকলেই বৈশ্বিকতার অংশ হয়ে উঠেছে ততদিনে।
বিশ্বে যখন নাগরিক সাংবাদিকতার এমন জনপ্রিয়তা, বাংলাদেশও এই ধারার বাইরে থাকেনি।
সিফাত আরা তাবাসসুম

বাংলাদেশে নাগরিক সাংবাদিকতা করার মত কী আছে? ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মার্ক গেসার ২০০৬ সালে বলেছিলেন, “সিটিজেন জার্নালিজমের পেছনের ধারণাটি হলো, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নেই তারা আধুনিক প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেরা অথবা অন্যের সহায়তায় একটি বিকল্প অথবা তথ্য-যাচাইয়ের মাধ্যম তৈরি করতে পারে। যেমন ধরা যাক, আপনি নগর পরিষদের সভা নিয়ে নিজের বøগ অথবা একটি অনলাইন ফোরামে লিখতে পারেন। এমনকি আপনি একটি মূল গণমাধ্যমের সংবাদপত্রের খবরের তথ্য যাচাই করতে পারেন এবং তথ্যগত ভ্রান্তি বা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে ইঙ্গিত দিতে পারেন আপনার বøগে। অথবা আপনি আপনার এলাকায় পরিবেশন করার মত কোনো ঘটনার একটি ডিজিটাল ছবি তুলতে পারেন এবং অনলাইনে পোস্ট করতে পারেন। অথবা আপনি সেই একই ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করতে পারেন এবং ইউটিউবের মত একটি ওয়েব সাইটে প্রকাশ করতে পারেন।”
নাগরিক সাংবাদিকতা প্রকারান্তরে নাগরিক মত ও মুক্তমত প্রকাশের একটি ধরনও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার ও নাগরিকের মধ্যে ভাব বিনিময়ে বা প্রতিক্রিয়া বিনিময়ে নাগরিক সাংবাদিকতা কার্যকরি। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যম যখন নাগরিক বিশ্বস্ততা হারায় তখন নাগরিক সাংবাদিকতাই নাগরিকের চাহিদা মেটায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সীদের ইন্টারনেট নির্ভরতা ক্রমে বাড়ছে। বিটিআরসির তথ্য মতে গত সেপ্টেম্বরে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। আর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে আট কোটি। সুতরাং অনলাইনে কনটেন্ট সরবরাহ থাকছে নিয়মিত এবং প্রতুল।
ফেইসবুক জনপ্রিয়তার মাঝেও বিষয় হিসেবে নাগরিক সাংবাদিকতা বেছে নিয়ে নষড়ম.নফহবংি২৪.পড়স এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে। ফলে সমগ্র বাংলাদেশের সেই সব সংবাদ উঠে আসছে, যা মূল ধারার গণমাধ্যমে হয় প্রকাশিতই হয় না অথবা পরিশীলিত কাঠামোতে ছাপা হয়।
নাগরিক সাংবাদিকতার এই চর্চায় বরিশালের নাগরিক উত্তরবঙ্গের নাগরিকের সমস্যা জানতে পারছে। চট্টগ্রামের নাগরিক সাংবাদিক তার প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য বিনিময় করছে খুলনার নাগরিক সাংবাদিকের সাথে। ফ্রান্সের সেইন নদী থেকে প্যারিস দেখার আবেদন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীর ভিডিও প্রতিবেদনের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চাঁদপুরের নাগরিক সাংবাদিকের ভিডিও প্রতিবেদনে ডাকাতিয়া নদীটির বেহাল দশা।
হাসপাতালের চিকিৎসা সংকট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন উদ্যোগ, প্রধান সড়কে যানজট সমস্যা, বাসের অন্যায্য ভাড়া, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সময় এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়েও প্রতিবেদন করছেন নাগরিক সাংবাদিকেরা। লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশ ছাড়াও নাগরিক সাংবাদিকরা নিজেরাই ছবি ধারণ করছে, ভিডিও ধারণ করছে।
এসব প্রতিবেদন অনেক ক্ষেত্রেই মূলধারার গণমাধ্যমের পূর্বেই উঠে আসছে। অনলাইনে সাড়াও পাচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর চেয়ে। তাহলে কি নাগরিক সাংবাদিকতা মূল ধারার গণমাধ্যমকে টপকে যাচ্ছে? পেশাদারি সাংবাদিকতার বিপরীতে নাগরিক সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত। ডেভিড সাইমন বলেছেন, “শখের বশে লেখালেখি করা আনপেইড বøগারদের পক্ষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, পেশাদার, ঝানু সাংবাদিকদের জায়গা দখল করা সম্ভব নয়।” এরকম মনোভাব পোষণকারীর সংখ্যা কম নয়। এতে করে নাগরিক সাংবাদিকতা চর্চা বরাবর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আবার এতে নাগরিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞায়নও প্রসারিত হচ্ছে। ফলে নাগরিক সাংবাদিকতার চর্চা থেমে থাকেনি। নাগরিকের পক্ষ থেকে প্রত্যাহবানই তো হচ্ছে নাগরিক সাংবাদিকতা। নাগরিকের ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে নাগরিক সাংবাদিকতা। আবার সচেতন ইন্দ্রিয়ের নাগরিকই কাঙ্খিত নাগরিক সাংবাদিক। তাই নাগরিক সাংবাদিকতার বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ ইতিবাচকই।
লেখক: সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার, বাংলা টিভি