৫ জানুয়ারী নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা
- প্রকাশের সময় : ০৯:০২:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ মার্চ ২০১৫
- / ৯২১ বার পঠিত
ঢাকা: ২০ দলীয় জোট নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘তিনি অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষার দৃষ্টান্ত তাদের নেই। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। পরবর্তীতে সংসদ ভেঙে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।’ বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানানোর পরই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। জনমনে একটাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোন অঙ্গীকার পূরণ করেননি তিনি। দেশের মানুষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের পরই পেছনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। আর খালেদা জিয়ার শুক্রবার (১৩ মার্চ) দেওয়া এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। জনমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেটা নিরসনে দৈনিক সংগ্রামের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের আর্কাইভ পর্যালোচনায় যে তথ্য পাওয়া যায় তা পাঠকদের উদ্দেশেই পত্রস্থ করা হলো ঃ
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সমঝোতায় আসলে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।’
ওই দিন গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (বিরোধী দল) দশম সংসদ নির্বাচনের ট্রেন মিস করেছেন। এবার অবরোধ বন্ধ করেন, গাছ কাটা বন্ধ করেন, জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে মানুষ হত্যা বন্ধ করেন।’ তিনি বলেন, ‘আলোচনা চলতে থাকবে। সমঝোতায় আসতে পারলে নতুন নির্বাচন দেব।’ শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্য শেষে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে। এজন্য আমরা জোটগতভাবে ছাড় দিয়ে প্রার্থী ঠিক করেছি। যখন বিরোধী দল নির্বাচনে আসেনি, তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা স্বাভাবিক। তারপরও নির্বাচনে ১২টি দল ও ৫৪০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিচ্ছে।’
এর দুই দিন পর (২০১৩ সালের) ২১ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আলোচনা চলছে, আলোচনা চলতে থাকবে। ভবিষ্যতে সমঝোতা হলে, আপনাদের (বিএনপি) দাবি (ডিমান্ড) যদি থাকে তাহলে সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দেব। তবে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে, হত্যা বন্ধ করতে হবে, বিভিন্ন স্থানে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, তা থামাতে হবে।’
একই দিন আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও সাবেক বিতর্কিত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আলোচনাও চলবে, (২০১৪ সালের ) ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, বিরোধী দল যদি জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন, হরতাল-অবরোধ ও নাশকতা বন্ধ করে তাহলে আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’
নির্বাচনের বিষয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা মেনে অগণতান্ত্রিক কর্মসূচি বন্ধ করুন। নির্বাচনের পরে একাদশ সংসদ হবে, নতুন মন্ত্রিসভা হবে। আমরা আশা করি, আলোচনায় বসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় নির্বাচন করতে পারব।’
২০১৪ সালের সেই বিতর্কিত ভোটারবিহীন ‘জাতীয়’ নির্বাচনের তিনদিন আগে ২ জানুয়ারী সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য। ২০১০ সাল থেকে বার বার আমি বিএনপি নেত্রীকে আহ্বান জানিয়েছি আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে এগিয়ে আসতে। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে স্বরাষ্ট্রসহ যেকোনো মন্ত্রণালয় দিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমি নিজে টেলিফোন করে বিরোধীদলীয় নেতাকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি। তিনি সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন। বার বার আমাকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।’
জনগণের উদ্দেশে ওই ভাষণে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে আমরা গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছিলাম। তাই, সাংবিধানিকভাবেই আগামী ৫ জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি আশা করি, গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত ৫ হাজার ৮০৩টি স্থানীয় সরকার ও উপ-নির্বাচনে আপনারা যেভাবে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছেন তেমনিভাবে আগামী ৫ জানুয়ারী একটি উৎসবমুখর পরিবেশে আপনারা ভোট দেবেন। পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন।’
২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে মন্তব্য করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ কতদিনের হবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ ওই দিন রাজধানীর সেতু ভবনে তৎকালীন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় মন্তব্য করেছিলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার পাঁচ বছরই মেয়াদ পূর্ণ করবে।’ জয়ের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি যতটুকু জানি সরকার বা দলের শীর্ষ পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি আপনাদের আগেও বলেছি সমঝোতার ব্যাপারে মধ্য জানুয়ারীতে একটি চমক থাকছে।’
এদিকে গত শুক্রবার (১৩ মার্চ) অবরদ্ধ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ৫ জানুয়ারীর নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর পরবর্তীতে সংসদ ভেঙে দিয়ে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তার কথায় বিশ্বাস রেখে আমরা আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।’
খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কবে কোথায় বলেছেন ৫ জানুয়ারী নির্বাচন একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।’
পরস্পর বিরোধী এমন বক্তব্য আর সরকারীদল আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জের পরই জনগণের দৃষ্টি পেছনে ফিরতে শুরু করে। তারা ভাবতে শুরু করেছেন, ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েও তা রক্ষা করেনি আওয়ামী লীগ। ৫৭ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা দিয়েও তা রক্ষা করেননি শেখ হাসিনা। তার বর্তমান বয়স ৬৮ বছর। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন নিয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়াও দলের একাধিক নীতি নির্ধারকের যে বক্তব্য বিবৃতি তৎকালীন গণমাধ্যমে এসেছিল তা এখন পরখ করে দেখতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহল । তারা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানদের বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে বের করে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছে । (দৈনিক সংগ্রাম)