নিউইয়র্ক ১২:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কথাসাহিত্যের অভিভাবক হাসান আজিজুল হক : স্মৃতিতে ও প্রভাবে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:১০:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১
  • / ৪৫ বার পঠিত

অসাধারণ কিছু ছোটগল্প আর কথাসাহিত্যের কথাকতা লিখে হাসান আজিজুল হক আমাদের যৌবনে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অভিভাবক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও অন্যতম মোড়ল হয়ে উঠেছিলেন। মোড়ল এই অর্থে, তিনি লিখেছেন যত, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা-আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাবাজি করেছেন আরও বেশি।

কলম না ধরেও তিনি মুখে মুখে কথা বললেও তা সাহিত্যের ছোটখাট নিবন্ধ হয়ে যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে তার একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বহু তরুণ লেখকের কাঙালপনা দেখেছি। জিনিসটা তিনি দিয়েছেনও বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত নবীন কি বিশিষ্ট অনেক লেখককেই।

আমার সঙ্গে হাসান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা যেটুকু গড়ে উঠেছিল, তা কিন্তু এই মোড়ল-ভূমিকা কিংবা তিনি বড় লেখক হওয়ার কারণে নয়। বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রথম পরিচয়েই প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। রাজধানীতে যেসব লেখক-বুদ্ধিজীবী খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা লোটার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন, তাদের মাঝে ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল তাকে। সে কারণেই সম্ভবত পরিচয়ের পর মনখোলা আড্ডা দেওয়ার মতো যখন ঘনিষ্ঠতা হলো, কিছু ধান্ধাবাজ লেখকের নাম দৃষ্টান্ত দিয়ে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি ক্ষমতার লেজুড় ও মানুষ হিসেবে যারা নিকৃষ্ট, তাদের দ্বারা কি শিল্পসাহিত্যে ভালো কাজ হতে পারে? জানি বিষয়টা বিতর্কিত, তারপরও তিনি জোরালো না জবাব দিয়েছিলেন বলে তাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়েছিল।

লেখক হিসেবে সামাজিক দায়বোধ ও তার সাহিত্য চিন্তা সহজেই প্রভাবিত করেছিল নিজেকে। মনে হয়েছিল, লেখক হিসেবে যে দায়বোধ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মহাশ্বেতা দেবী তার কথাসাহিত্যে আদিবাসী ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে লেখার বিষয় করে কথাসাহিত্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন, হাসানের দায়বোধ ও আদর্শিক স্থান সেরকমই। তার পাতালে হাসপাতালে গল্পগ্রন্থসহ শেষদিকের লেখা গল্পগুলো ও কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে লেখকের এই দাযবোধের বিষয়টি।

আরও স্পষ্ট হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে সাহিত্যের ঘরোয়া আড্ডায়। আর এভাবে দূরে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কথাসাহিত্যের প্রিয় অভিভাবক তুল্য আপনজন।

১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকে যেসব বড় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা ও আড্ডাবাজি দেখেছি, তিনি প্রথমে তাদের মধ্যে ছিলেন না। কেননা থাকতেন রাজশাহীতে। আমি অনেকের কাছে তার গল্পের প্রশংসা শুনে আত্মজা ও করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি বই পড়েই তার বড় লেখক হওয়ার কারণ-বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে কি, প্রথম পাঠে তাকে অতটা ভালো লাগেনি, বড় লেখকও মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে শুরু করে অনেক বড় লেখকের প্রিয় গল্প পড়ে যেরকম মুগ্ধতা বোধ জেগেছিল, সেরকম অনুভূতি জাগেনি। মনে হয়েছিল, তার লেখায় রসকষের অভাব। আর গল্পের পটভূমি ও চরিত্রগুলিকেও মনে হয় দূরের মানুষ।

প্রথম পরিচয়ের দিনেই পাঠক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার গল্পের গ্রামগুলো আসলে কোথাকার? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, রাঢ় বঙ্গের। হতে পারে, নিজে উত্তরবঙ্গের সরল মানুষ হওয়ায় রাঢ় বঙ্গ ও সাহিত্যের প্রতীকী তাৎপর্য ও জটিলতা তখনো বুঝতে পারিনি বলে তাকে বড় লেখক মনে হয়নি। প্রথম দিকের গল্পে লেখক হিসেবে দায়বোধ বা প্রতিবাদী চেতনাও পষ্ট ধরতে পারিনি। তাছাড়া বাঙলা কথা সাহিত্যের বড় লেখক মানেই তো মেলা উপন্যাস, হাসান ভাইয়ের তখনো একটাও উপন্যাস পাইনি বলে কাজের চেয়ে তার নাম নিয়ে মাতামাতি বেশি মনে হয়েছিল।

প্রথম দেখা ও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল অফিসেই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক বদল হয়েছে তখন। পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমান তখন শাসনক্ষমতায়। অধ্যাপক আবুল ফজল যেমন হয়েছিলেন শেখ মুজিবের শাসনামলে, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানও তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও যেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রন্থজগতের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করতে চাইলেন তিনি। এই লক্ষ্যে সরদার জয়েন উদ্দীনকে টেকস্ট বুক বোর্ডে বদলি করে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ও আপন ভাগ্নে ফজলে রাব্বিকে পরিচালক করে আনলেন গ্রন্থকেন্দ্রের। আমি যেহেতু তখন পরিচালকের একান্ত সহকারী, উপরন্তু গ্রন্থানুরাগী হবু-লেখক ও গোগ্রাসী-পাঠকও বটে, গ্রন্থোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পরিচালকের উৎসাহী সহযোগী-সমর্থক এবং কখনও বা প্রধান বিরোধীও ছিলাম। ফলে বস হিসেবে রাব্বি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার দীর্ঘস্থায়ী ও তিক্তমধুর হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অফিসের সরকারি গ্রন্থান্নয়নের কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার বয়ান থাক, আমি বরং নিজের সাহিত্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গে হাসান ভাইয়ের কিছু স্মৃতিচারণা করি এ লেখাটায়।

ফজলে রাব্বির আমলে শিশুসাহিত্যের বড় লেখক এখলাস উদ্দিন আহমেদ ও বাংলা একাডেমির আর এক পরিচালক আবুল হাসনাতও গ্রন্থকেন্দ্রে আড্ডা দিতে প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। হাসান ভাই এদেরও বন্ধু ছিলেন। তিনজনই তারা জন্মগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, মিলটা এ কারণেও বেশি হতে পারে। কী একটা বই যেন এদেরকে অভিন্ন হৃদয়েষু বলে উৎসর্গ করেছিলেন। এখলাস ভাই ও হাসনাত ভাইয়ের সুপারিশে রাব্বি সাহেব হাসান ভাইয়ের শ্যালক ও কাজিন রফিককে গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি দিয়েছিলেন। হাসান ভাইয়ের রাজশাহীর বাসায় থেকে তার বিভাগে দর্শনে মাস্টার্স করেছিলেন রফিক। সহকর্মী হিসেবে রফিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এতটা বাড়ে যে, শাহজাহানপুরের এক বাসায় আমরা সপরিবার সহভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম বেশ কিছুদিন। আমি রফিকের আগেই বিয়ে করে তখন এক সন্তানের পিতা। প্রথম বই বের হয়নি তখনো। তবে ঘরে-বাইরে লেখক হয়ে ওঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। রফিকের কাছে গল্প শুনে শুনে লেখক ও মানুষ হাসান আজিজুল হকও খুব চেনা হয়ে উঠেছিলেন। আমার লেখক হওয়ার প্রয়াস ও চালচলন দেখেই হয়তো, হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে আমাকেও তার কার্বন কপি বলে মন্তব্য করত রফিক। আমার স্ত্রীর কাছে লেখক মানেই যেমন সংসার করার অনুপযোগী মানুষ, রফিক ভাইয়ের প্রশংসাও সেরকম ছিল কিনা জানি না।

তবে নিজেকে হাসান ভাইয়ের মতো সম্ভাবনায় লেখক ভাবতে ভাল লাগত, এরকম ধারনা প্রেরণাও জোগাত নিজেকে।

রফিকের মাধ্যমে হাসান ভাইয়ের নানা গল্প শোনা ছাড়াও তার মাধ্যমেই হাসান ভাইয়ের অগ্রজ বোন ও লেখক জাহানারা নওশনীন ওরফে জানু আপার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। ফলে হাসান ভাই ঢাকায় এলে গ্রন্থকেন্দ্রে কিংবা গ্রন্থকেন্দ্রের নিকটবর্তী পুরানা পল্টনে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হকের অফিসে যাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, সেসইসব আড্ডাতেও শরিক হওয়ার সুযোগ ক্রমে বাড়তে থাকে আমার। সরদার জয়েন উদ্দীনের আমলেই শিল্পী আব্দুর রউফ সরকার গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সম্পর্কে তিনি লেখক শওকত আলীর অনুজ। শওকত আলীও কবি কায়সুল হককে অগ্রজের মতো দেখতেন। সেই সবুাদে শওকত ভাইও প্রায় আসতেন অফিসে।

হাসান ভাই ঢাকায় এলে একবার রউফ তার মেজদাসহ হাসান ভাইকেও বাসায় নিমন্ত্রণ করেন হাঁস-খিচুড়ি খাওয়াতে। আমি গ্রন্থকেন্দ্রের সহকর্মী ও প্রতিবেশী হিসেবে অগ্রজ দুই লেখকরে সঙ্গে রউফ ভাইয়ের বাসার খিচুড়ি-আড্ডায় শরিক হওয়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হই।

লেখক হিসেবে আমার সম্ভাবনা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব ও পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজন’ প্রকাশের পর। বই প্রকাশের আগেই যেহেতু তাদের সঙ্গে অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কটা নিবিড় হয়েছিল, তিনজনকেই বই দিয়েছিলাম পড়তে। তিনজনই পড়েছিলেন তারা। হাসান ভাই ওই সময়ে কোনো এক পত্রিকায় শাহাদুজ্জামানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে আমার বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ লেখক হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। গল্পগুলোকে বিদ্যুতের তরোয়ালের মতো কিংবা লাঙলের ফলার মতো ধারালো- এ ধরণের মন্তব্য করেছিলেন।

আমার প্রথম উপন্যাস তমস সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের তালিকায় রেখেছিলেন কোনো বক্তৃতায় কিংবা আড্ডায়। বড় লেখকের এক-আধ লাইনের সার্টিফিকেট, এমনকি মৌখিক প্রশংসাও যে পঠন-পাঠনে অতি দীন ও ক্ষীণ দেশের সাহিত্যজগতে তরুণদের লেখক ইমেজ গড়ে উঠতে টনিকের কাজ দেয়, হাসান ভাইয়ের ওইটুকু প্রশংসাতেই বুঝেছিলাম। যারা আমার বই পড়েননি, সৌজন্য কপি উপহার দিলেও পড়ার সময় পাননি- এমন সাহিত্যবোদ্ধারাও আমাকে লেখক স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু হাসান, শওকত বা ইলিয়াস ভালো বলেছেন, অতএব অপাঠক বিশিষ্টজনের চোখেও আমি শক্তিমান লেখক।

আমার বিশ্বাস, পাঠক-সংকটে ক্রমশঃ সংকুচিত সাহিত্যজগতে পরের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত সাহিত্যবোদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি। এ ধরণের সাহিত্যবোদ্ধার প্রশংসা-প্রশস্তির চেয়ে প্রকৃত পাঠকের পঠন প্রতিক্রিয়ার অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ‘ভাল’ কিংবা ভাল না লাগার প্রকাশ্য নাক কুঁচকানো উপেক্ষাও লেখকের জন্য উপকারী জিনিস। আর প্রকৃত পাঠক যদি সততার সঙ্গে তার পাঠের তৃপ্তি কিংবা অতৃপ্তির কিছু কারণ জানান, সাহিত্যবোদ্ধার সার্টিফিকেটের চেয়েও এমন প্রাপ্তি লেখকের জন্য প্রেরণার কারণ হতে পারে। এ কারণে নিজের বইয়ের ভূমিকা বা প্রচ্ছদ পরিচিতিতে ব্যবহারের জন্য বড় লেখকের ইমেজসম্পন্ন কারো কাছে সার্টিফিকেট লিখে দেয়ার আবদার করিনি।

তবে প্রথম বই প্রকাশের পরই আমার সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকের যে ইমেজ গড়ে ওঠে, তার মূলে হাসান ভাই ও ইলিয়াস ভাইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিতভাবে আমার প্রশংসা করেননি, কিন্তু প্রথম বইয়ের জন্য পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা আদায় করে দেয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে গল্প অন্যত্র করব।

এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যে কথাটি বলতে চাই, নবীন লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ লেখকরা অভিভাবক তুল্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমার ক্ষেত্রে এ ভূমিকা যারা পালন করেছেন যে অগ্রজগণ, হাসান ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই। নব্বইয়ের দশকেই আমার ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ উপন্যাসটি তাকে উৎসর্গ করতে পেরে, বইটি প্রকাশেরও অন্যতম সার্থকতা মনে হয়েছিল।

লেখকজীবনের শুরু থেকে যেসব অগ্রজ লেখক আত্মীয়তুল্য আপনজন হয়ে উঠেছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই হারিয়েছি। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একে একে কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক ও শওকত আলীকে হারানোর পর কথাসাহিত্য পরিবারে নিজের একাকিত্ব ও অসহায় দশা বেড়েছে সন্দেহ নেই। জীবিতদের মাঝে অশীতিপর হাসান ভাই রাজশাহীতে। সামাজিক দায় পালনে নানা ইস্যুতে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী বিবৃতিতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা ছাড়াও নিজের মতো করে টুকটাক লেখালেখি করছেন হয়তো। ঢাকার নানা অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে আগের মতো মঞ্চে তার উপস্থিতি ও বক্তৃতার খবর পাই না আর। বয়সের ভারেও ঘরকুণো হতে বাধ্য হয়েছেন হয়তো।

অন্যদিকে ঢাকা ছেড়ে আমিও গ্রামমুখো হওয়ায় হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক বছর। ফোনালাপে একদিন রাজশাহীতে তার বাড়ি উজানে গিয়ে দীর্ঘ সাহিত্য-আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। দুই তিনটি উপন্যাস লিখে হাসান ভাই উপন্যাসিক হিসেবেও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তমস ছাড়া আমার আর কোনো উপন্যাস সম্পর্কে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। আবাসভূমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সাক্ষাতে বলেছিলেন, তোমার বইটির পাখা গজিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল, পড়াই হয়নি আর। এ কারণে আমার নির্বাচিত কয়েকটা উপন্যাস তাকে দিয়ে দাবি জানাব, এগুলোকে উড়ে যেতে দেবেন না, না পড়ে মরেও যাবেন না প্লিজ।

ঠাট্টা করে আরো জিজ্ঞেস করব, আপনার সাবিত্রী আখ্যান উপন্যাসটি আমার প্রতিমা উপন্যাসের সাফল্য কিংবা দুর্বলতার কোনো মিলের জায়গা আছে কি? কিন্তু উজানযাত্রাসহ তার উজানবাড়িতে কবে যে যাওয়া হবে কে জানে!

জীবনে একবার সপরিবার তার ওই নতুন বাড়ি উজানে গিয়ে ভাবির হাতের আন্তরিক আপ্যয়ন ভুলবার মতো নয়। ঢাকায় এলে আমার কলাগাবানের বাসায় সপরিবার একবার বেড়াতে এসেও ধন্য করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসছিলেন। সেখানে অতিথি ছিলেন হাসান ভাই। আমি দেবেশ রায়কে মঙ্গাকালের মানুষ গল্পগ্রন্থ উৎসর্গ করেছি, কিন্তু তখনো সাক্ষাত পরিচয় হয়নি, বইও পৌঁছাতে পারিনি। বইটি দিতে বেইলি রোডের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েছিলাম, হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে।

এইসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি ছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ কিংবা নাঈম হাসানের বাসায় আমাদের প্রিয় অভিভাবক তুল্য সজ্জন ভালো মানুষটিকে কাছে পাওয়ার ও মন খুলে আড্ডা দেয়ার কতো যে স্মৃতি! জীবদ্দশাতেও সেইসব স্মৃতি থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করি অনেক সময়। হাসান ভাইযের মৃত্যুসংবাদ পেলে নিজে সম্পূর্ণরূপে অভিভাবশূন্য ও একা হয়ে যাব। একাকিত্ব, নানারকম স্মৃতি ও বেদনাভার নিয়ে নিজেরও নেই হয়ে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। অমোঘ সান্ত্বনা এখন একটাই।অসাধারণ কিছু ছোটগল্প আর কথাসাহিত্যের কথাকতা লিখে হাসান আজিজুল হক আমাদের যৌবনে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অভিভাবক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও অন্যতম মোড়ল হয়ে উঠেছিলেন। মোড়ল এই অর্থে, তিনি লিখেছেন যত, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা-আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাবাজি করেছেন আরও বেশি।

কলম না ধরেও তিনি মুখে মুখে কথা বললেও তা সাহিত্যের ছোটখাট নিবন্ধ হয়ে যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে তার একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বহু তরুণ লেখকের কাঙালপনা দেখেছি। জিনিসটা তিনি দিয়েছেনও বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত নবীন কি বিশিষ্ট অনেক লেখককেই।

আমার সঙ্গে হাসান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা যেটুকু গড়ে উঠেছিল, তা কিন্তু এই মোড়ল-ভূমিকা কিংবা তিনি বড় লেখক হওয়ার কারণে নয়। বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রথম পরিচয়েই প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। রাজধানীতে যেসব লেখক-বুদ্ধিজীবী খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা লোটার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন, তাদের মাঝে ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল তাকে। সে কারণেই সম্ভবত পরিচয়ের পর মনখোলা আড্ডা দেওয়ার মতো যখন ঘনিষ্ঠতা হলো, কিছু ধান্ধাবাজ লেখকের নাম দৃষ্টান্ত দিয়ে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি ক্ষমতার লেজুড় ও মানুষ হিসেবে যারা নিকৃষ্ট, তাদের দ্বারা কি শিল্পসাহিত্যে ভালো কাজ হতে পারে? জানি বিষয়টা বিতর্কিত, তারপরও তিনি জোরালো না জবাব দিয়েছিলেন বলে তাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়েছিল।

লেখক হিসেবে সামাজিক দায়বোধ ও তার সাহিত্য চিন্তা সহজেই প্রভাবিত করেছিল নিজেকে। মনে হয়েছিল, লেখক হিসেবে যে দায়বোধ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মহাশ্বেতা দেবী তার কথাসাহিত্যে আদিবাসী ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে লেখার বিষয় করে কথাসাহিত্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন, হাসানের দায়বোধ ও আদর্শিক স্থান সেরকমই। তার পাতালে হাসপাতালে গল্পগ্রন্থসহ শেষদিকের লেখা গল্পগুলো ও কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে লেখকের এই দাযবোধের বিষয়টি।

আরও স্পষ্ট হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে সাহিত্যের ঘরোয়া আড্ডায়। আর এভাবে দূরে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কথাসাহিত্যের প্রিয় অভিভাবক তুল্য আপনজন।

১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকে যেসব বড় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা ও আড্ডাবাজি দেখেছি, তিনি প্রথমে তাদের মধ্যে ছিলেন না। কেননা থাকতেন রাজশাহীতে। আমি অনেকের কাছে তার গল্পের প্রশংসা শুনে আত্মজা ও করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি বই পড়েই তার বড় লেখক হওয়ার কারণ-বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে কি, প্রথম পাঠে তাকে অতটা ভালো লাগেনি, বড় লেখকও মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে শুরু করে অনেক বড় লেখকের প্রিয় গল্প পড়ে যেরকম মুগ্ধতা বোধ জেগেছিল, সেরকম অনুভূতি জাগেনি। মনে হয়েছিল, তার লেখায় রসকষের অভাব। আর গল্পের পটভূমি ও চরিত্রগুলিকেও মনে হয় দূরের মানুষ।

প্রথম পরিচয়ের দিনেই পাঠক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার গল্পের গ্রামগুলো আসলে কোথাকার? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, রাঢ় বঙ্গের। হতে পারে, নিজে উত্তরবঙ্গের সরল মানুষ হওয়ায় রাঢ় বঙ্গ ও সাহিত্যের প্রতীকী তাৎপর্য ও জটিলতা তখনো বুঝতে পারিনি বলে তাকে বড় লেখক মনে হয়নি। প্রথম দিকের গল্পে লেখক হিসেবে দায়বোধ বা প্রতিবাদী চেতনাও পষ্ট ধরতে পারিনি। তাছাড়া বাঙলা কথা সাহিত্যের বড় লেখক মানেই তো মেলা উপন্যাস, হাসান ভাইয়ের তখনো একটাও উপন্যাস পাইনি বলে কাজের চেয়ে তার নাম নিয়ে মাতামাতি বেশি মনে হয়েছিল।

প্রথম দেখা ও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল অফিসেই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক বদল হয়েছে তখন। পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমান তখন শাসনক্ষমতায়। অধ্যাপক আবুল ফজল যেমন হয়েছিলেন শেখ মুজিবের শাসনামলে, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানও তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও যেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রন্থজগতের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করতে চাইলেন তিনি। এই লক্ষ্যে সরদার জয়েন উদ্দীনকে টেকস্ট বুক বোর্ডে বদলি করে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ও আপন ভাগ্নে ফজলে রাব্বিকে পরিচালক করে আনলেন গ্রন্থকেন্দ্রের। আমি যেহেতু তখন পরিচালকের একান্ত সহকারী, উপরন্তু গ্রন্থানুরাগী হবু-লেখক ও গোগ্রাসী-পাঠকও বটে, গ্রন্থোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পরিচালকের উৎসাহী সহযোগী-সমর্থক এবং কখনও বা প্রধান বিরোধীও ছিলাম। ফলে বস হিসেবে রাব্বি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার দীর্ঘস্থায়ী ও তিক্তমধুর হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অফিসের সরকারি গ্রন্থান্নয়নের কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার বয়ান থাক, আমি বরং নিজের সাহিত্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গে হাসান ভাইয়ের কিছু স্মৃতিচারণা করি এ লেখাটায়।

ফজলে রাব্বির আমলে শিশুসাহিত্যের বড় লেখক এখলাস উদ্দিন আহমেদ ও বাংলা একাডেমির আর এক পরিচালক আবুল হাসনাতও গ্রন্থকেন্দ্রে আড্ডা দিতে প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। হাসান ভাই এদেরও বন্ধু ছিলেন। তিনজনই তারা জন্মগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, মিলটা এ কারণেও বেশি হতে পারে। কী একটা বই যেন এদেরকে অভিন্ন হৃদয়েষু বলে উৎসর্গ করেছিলেন। এখলাস ভাই ও হাসনাত ভাইয়ের সুপারিশে রাব্বি সাহেব হাসান ভাইয়ের শ্যালক ও কাজিন রফিককে গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি দিয়েছিলেন। হাসান ভাইয়ের রাজশাহীর বাসায় থেকে তার বিভাগে দর্শনে মাস্টার্স করেছিলেন রফিক। সহকর্মী হিসেবে রফিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এতটা বাড়ে যে, শাহজাহানপুরের এক বাসায় আমরা সপরিবার সহভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম বেশ কিছুদিন। আমি রফিকের আগেই বিয়ে করে তখন এক সন্তানের পিতা। প্রথম বই বের হয়নি তখনো। তবে ঘরে-বাইরে লেখক হয়ে ওঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। রফিকের কাছে গল্প শুনে শুনে লেখক ও মানুষ হাসান আজিজুল হকও খুব চেনা হয়ে উঠেছিলেন। আমার লেখক হওয়ার প্রয়াস ও চালচলন দেখেই হয়তো, হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে আমাকেও তার কার্বন কপি বলে মন্তব্য করত রফিক। আমার স্ত্রীর কাছে লেখক মানেই যেমন সংসার করার অনুপযোগী মানুষ, রফিক ভাইয়ের প্রশংসাও সেরকম ছিল কিনা জানি না।

তবে নিজেকে হাসান ভাইয়ের মতো সম্ভাবনায় লেখক ভাবতে ভাল লাগত, এরকম ধারনা প্রেরণাও জোগাত নিজেকে।

রফিকের মাধ্যমে হাসান ভাইয়ের নানা গল্প শোনা ছাড়াও তার মাধ্যমেই হাসান ভাইয়ের অগ্রজ বোন ও লেখক জাহানারা নওশনীন ওরফে জানু আপার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। ফলে হাসান ভাই ঢাকায় এলে গ্রন্থকেন্দ্রে কিংবা গ্রন্থকেন্দ্রের নিকটবর্তী পুরানা পল্টনে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হকের অফিসে যাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, সেসইসব আড্ডাতেও শরিক হওয়ার সুযোগ ক্রমে বাড়তে থাকে আমার। সরদার জয়েন উদ্দীনের আমলেই শিল্পী আব্দুর রউফ সরকার গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সম্পর্কে তিনি লেখক শওকত আলীর অনুজ। শওকত আলীও কবি কায়সুল হককে অগ্রজের মতো দেখতেন। সেই সবুাদে শওকত ভাইও প্রায় আসতেন অফিসে।

হাসান ভাই ঢাকায় এলে একবার রউফ তার মেজদাসহ হাসান ভাইকেও বাসায় নিমন্ত্রণ করেন হাঁস-খিচুড়ি খাওয়াতে। আমি গ্রন্থকেন্দ্রের সহকর্মী ও প্রতিবেশী হিসেবে অগ্রজ দুই লেখকরে সঙ্গে রউফ ভাইয়ের বাসার খিচুড়ি-আড্ডায় শরিক হওয়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হই।

লেখক হিসেবে আমার সম্ভাবনা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব ও পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজন’ প্রকাশের পর। বই প্রকাশের আগেই যেহেতু তাদের সঙ্গে অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কটা নিবিড় হয়েছিল, তিনজনকেই বই দিয়েছিলাম পড়তে। তিনজনই পড়েছিলেন তারা। হাসান ভাই ওই সময়ে কোনো এক পত্রিকায় শাহাদুজ্জামানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে আমার বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ লেখক হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। গল্পগুলোকে বিদ্যুতের তরোয়ালের মতো কিংবা লাঙলের ফলার মতো ধারালো- এ ধরণের মন্তব্য করেছিলেন।

আমার প্রথম উপন্যাস তমস সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের তালিকায় রেখেছিলেন কোনো বক্তৃতায় কিংবা আড্ডায়। বড় লেখকের এক-আধ লাইনের সার্টিফিকেট, এমনকি মৌখিক প্রশংসাও যে পঠন-পাঠনে অতি দীন ও ক্ষীণ দেশের সাহিত্যজগতে তরুণদের লেখক ইমেজ গড়ে উঠতে টনিকের কাজ দেয়, হাসান ভাইয়ের ওইটুকু প্রশংসাতেই বুঝেছিলাম। যারা আমার বই পড়েননি, সৌজন্য কপি উপহার দিলেও পড়ার সময় পাননি- এমন সাহিত্যবোদ্ধারাও আমাকে লেখক স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু হাসান, শওকত বা ইলিয়াস ভালো বলেছেন, অতএব অপাঠক বিশিষ্টজনের চোখেও আমি শক্তিমান লেখক।

আমার বিশ্বাস, পাঠক-সংকটে ক্রমশঃ সংকুচিত সাহিত্যজগতে পরের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত সাহিত্যবোদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি। এ ধরণের সাহিত্যবোদ্ধার প্রশংসা-প্রশস্তির চেয়ে প্রকৃত পাঠকের পঠন প্রতিক্রিয়ার অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ‘ভাল’ কিংবা ভাল না লাগার প্রকাশ্য নাক কুঁচকানো উপেক্ষাও লেখকের জন্য উপকারী জিনিস। আর প্রকৃত পাঠক যদি সততার সঙ্গে তার পাঠের তৃপ্তি কিংবা অতৃপ্তির কিছু কারণ জানান, সাহিত্যবোদ্ধার সার্টিফিকেটের চেয়েও এমন প্রাপ্তি লেখকের জন্য প্রেরণার কারণ হতে পারে। এ কারণে নিজের বইয়ের ভূমিকা বা প্রচ্ছদ পরিচিতিতে ব্যবহারের জন্য বড় লেখকের ইমেজসম্পন্ন কারো কাছে সার্টিফিকেট লিখে দেয়ার আবদার করিনি।

তবে প্রথম বই প্রকাশের পরই আমার সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকের যে ইমেজ গড়ে ওঠে, তার মূলে হাসান ভাই ও ইলিয়াস ভাইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিতভাবে আমার প্রশংসা করেননি, কিন্তু প্রথম বইয়ের জন্য পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা আদায় করে দেয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে গল্প অন্যত্র করব।

এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যে কথাটি বলতে চাই, নবীন লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ লেখকরা অভিভাবক তুল্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমার ক্ষেত্রে এ ভূমিকা যারা পালন করেছেন যে অগ্রজগণ, হাসান ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই। নব্বইয়ের দশকেই আমার ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ উপন্যাসটি তাকে উৎসর্গ করতে পেরে, বইটি প্রকাশেরও অন্যতম সার্থকতা মনে হয়েছিল।

লেখকজীবনের শুরু থেকে যেসব অগ্রজ লেখক আত্মীয়তুল্য আপনজন হয়ে উঠেছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই হারিয়েছি। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একে একে কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক ও শওকত আলীকে হারানোর পর কথাসাহিত্য পরিবারে নিজের একাকিত্ব ও অসহায় দশা বেড়েছে সন্দেহ নেই। জীবিতদের মাঝে অশীতিপর হাসান ভাই রাজশাহীতে। সামাজিক দায় পালনে নানা ইস্যুতে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী বিবৃতিতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা ছাড়াও নিজের মতো করে টুকটাক লেখালেখি করছেন হয়তো। ঢাকার নানা অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে আগের মতো মঞ্চে তার উপস্থিতি ও বক্তৃতার খবর পাই না আর। বয়সের ভারেও ঘরকুণো হতে বাধ্য হয়েছেন হয়তো।

অন্যদিকে ঢাকা ছেড়ে আমিও গ্রামমুখো হওয়ায় হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক বছর। ফোনালাপে একদিন রাজশাহীতে তার বাড়ি উজানে গিয়ে দীর্ঘ সাহিত্য-আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। দুই তিনটি উপন্যাস লিখে হাসান ভাই উপন্যাসিক হিসেবেও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তমস ছাড়া আমার আর কোনো উপন্যাস সম্পর্কে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। আবাসভূমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সাক্ষাতে বলেছিলেন, তোমার বইটির পাখা গজিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল, পড়াই হয়নি আর। এ কারণে আমার নির্বাচিত কয়েকটা উপন্যাস তাকে দিয়ে দাবি জানাব, এগুলোকে উড়ে যেতে দেবেন না, না পড়ে মরেও যাবেন না প্লিজ।

ঠাট্টা করে আরো জিজ্ঞেস করব, আপনার সাবিত্রী আখ্যান উপন্যাসটি আমার প্রতিমা উপন্যাসের সাফল্য কিংবা দুর্বলতার কোনো মিলের জায়গা আছে কি? কিন্তু উজানযাত্রাসহ তার উজানবাড়িতে কবে যে যাওয়া হবে কে জানে!

জীবনে একবার সপরিবার তার ওই নতুন বাড়ি উজানে গিয়ে ভাবির হাতের আন্তরিক আপ্যয়ন ভুলবার মতো নয়। ঢাকায় এলে আমার কলাগাবানের বাসায় সপরিবার একবার বেড়াতে এসেও ধন্য করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসছিলেন। সেখানে অতিথি ছিলেন হাসান ভাই। আমি দেবেশ রায়কে মঙ্গাকালের মানুষ গল্পগ্রন্থ উৎসর্গ করেছি, কিন্তু তখনো সাক্ষাত পরিচয় হয়নি, বইও পৌঁছাতে পারিনি। বইটি দিতে বেইলি রোডের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েছিলাম, হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে।

এইসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি ছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ কিংবা নাঈম হাসানের বাসায় আমাদের প্রিয় অভিভাবক তুল্য সজ্জন ভালো মানুষটিকে কাছে পাওয়ার ও মন খুলে আড্ডা দেয়ার কতো যে স্মৃতি! জীবদ্দশাতেও সেইসব স্মৃতি থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করি অনেক সময়। হাসান ভাইযের মৃত্যুসংবাদ পেলে নিজে সম্পূর্ণরূপে অভিভাবশূন্য ও একা হয়ে যাব। একাকিত্ব, নানারকম স্মৃতি ও বেদনাভার নিয়ে নিজেরও নেই হয়ে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। অমোঘ সান্ত্বনা এখন একটাই।- লেখাটি হাসান আজিজুল হকের জীবদ্দশায় রচিত

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

কথাসাহিত্যের অভিভাবক হাসান আজিজুল হক : স্মৃতিতে ও প্রভাবে

প্রকাশের সময় : ০৭:১০:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১

অসাধারণ কিছু ছোটগল্প আর কথাসাহিত্যের কথাকতা লিখে হাসান আজিজুল হক আমাদের যৌবনে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অভিভাবক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও অন্যতম মোড়ল হয়ে উঠেছিলেন। মোড়ল এই অর্থে, তিনি লিখেছেন যত, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা-আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাবাজি করেছেন আরও বেশি।

কলম না ধরেও তিনি মুখে মুখে কথা বললেও তা সাহিত্যের ছোটখাট নিবন্ধ হয়ে যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে তার একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বহু তরুণ লেখকের কাঙালপনা দেখেছি। জিনিসটা তিনি দিয়েছেনও বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত নবীন কি বিশিষ্ট অনেক লেখককেই।

আমার সঙ্গে হাসান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা যেটুকু গড়ে উঠেছিল, তা কিন্তু এই মোড়ল-ভূমিকা কিংবা তিনি বড় লেখক হওয়ার কারণে নয়। বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রথম পরিচয়েই প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। রাজধানীতে যেসব লেখক-বুদ্ধিজীবী খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা লোটার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন, তাদের মাঝে ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল তাকে। সে কারণেই সম্ভবত পরিচয়ের পর মনখোলা আড্ডা দেওয়ার মতো যখন ঘনিষ্ঠতা হলো, কিছু ধান্ধাবাজ লেখকের নাম দৃষ্টান্ত দিয়ে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি ক্ষমতার লেজুড় ও মানুষ হিসেবে যারা নিকৃষ্ট, তাদের দ্বারা কি শিল্পসাহিত্যে ভালো কাজ হতে পারে? জানি বিষয়টা বিতর্কিত, তারপরও তিনি জোরালো না জবাব দিয়েছিলেন বলে তাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়েছিল।

লেখক হিসেবে সামাজিক দায়বোধ ও তার সাহিত্য চিন্তা সহজেই প্রভাবিত করেছিল নিজেকে। মনে হয়েছিল, লেখক হিসেবে যে দায়বোধ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মহাশ্বেতা দেবী তার কথাসাহিত্যে আদিবাসী ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে লেখার বিষয় করে কথাসাহিত্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন, হাসানের দায়বোধ ও আদর্শিক স্থান সেরকমই। তার পাতালে হাসপাতালে গল্পগ্রন্থসহ শেষদিকের লেখা গল্পগুলো ও কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে লেখকের এই দাযবোধের বিষয়টি।

আরও স্পষ্ট হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে সাহিত্যের ঘরোয়া আড্ডায়। আর এভাবে দূরে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কথাসাহিত্যের প্রিয় অভিভাবক তুল্য আপনজন।

১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকে যেসব বড় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা ও আড্ডাবাজি দেখেছি, তিনি প্রথমে তাদের মধ্যে ছিলেন না। কেননা থাকতেন রাজশাহীতে। আমি অনেকের কাছে তার গল্পের প্রশংসা শুনে আত্মজা ও করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি বই পড়েই তার বড় লেখক হওয়ার কারণ-বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে কি, প্রথম পাঠে তাকে অতটা ভালো লাগেনি, বড় লেখকও মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে শুরু করে অনেক বড় লেখকের প্রিয় গল্প পড়ে যেরকম মুগ্ধতা বোধ জেগেছিল, সেরকম অনুভূতি জাগেনি। মনে হয়েছিল, তার লেখায় রসকষের অভাব। আর গল্পের পটভূমি ও চরিত্রগুলিকেও মনে হয় দূরের মানুষ।

প্রথম পরিচয়ের দিনেই পাঠক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার গল্পের গ্রামগুলো আসলে কোথাকার? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, রাঢ় বঙ্গের। হতে পারে, নিজে উত্তরবঙ্গের সরল মানুষ হওয়ায় রাঢ় বঙ্গ ও সাহিত্যের প্রতীকী তাৎপর্য ও জটিলতা তখনো বুঝতে পারিনি বলে তাকে বড় লেখক মনে হয়নি। প্রথম দিকের গল্পে লেখক হিসেবে দায়বোধ বা প্রতিবাদী চেতনাও পষ্ট ধরতে পারিনি। তাছাড়া বাঙলা কথা সাহিত্যের বড় লেখক মানেই তো মেলা উপন্যাস, হাসান ভাইয়ের তখনো একটাও উপন্যাস পাইনি বলে কাজের চেয়ে তার নাম নিয়ে মাতামাতি বেশি মনে হয়েছিল।

প্রথম দেখা ও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল অফিসেই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক বদল হয়েছে তখন। পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমান তখন শাসনক্ষমতায়। অধ্যাপক আবুল ফজল যেমন হয়েছিলেন শেখ মুজিবের শাসনামলে, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানও তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও যেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রন্থজগতের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করতে চাইলেন তিনি। এই লক্ষ্যে সরদার জয়েন উদ্দীনকে টেকস্ট বুক বোর্ডে বদলি করে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ও আপন ভাগ্নে ফজলে রাব্বিকে পরিচালক করে আনলেন গ্রন্থকেন্দ্রের। আমি যেহেতু তখন পরিচালকের একান্ত সহকারী, উপরন্তু গ্রন্থানুরাগী হবু-লেখক ও গোগ্রাসী-পাঠকও বটে, গ্রন্থোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পরিচালকের উৎসাহী সহযোগী-সমর্থক এবং কখনও বা প্রধান বিরোধীও ছিলাম। ফলে বস হিসেবে রাব্বি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার দীর্ঘস্থায়ী ও তিক্তমধুর হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অফিসের সরকারি গ্রন্থান্নয়নের কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার বয়ান থাক, আমি বরং নিজের সাহিত্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গে হাসান ভাইয়ের কিছু স্মৃতিচারণা করি এ লেখাটায়।

ফজলে রাব্বির আমলে শিশুসাহিত্যের বড় লেখক এখলাস উদ্দিন আহমেদ ও বাংলা একাডেমির আর এক পরিচালক আবুল হাসনাতও গ্রন্থকেন্দ্রে আড্ডা দিতে প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। হাসান ভাই এদেরও বন্ধু ছিলেন। তিনজনই তারা জন্মগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, মিলটা এ কারণেও বেশি হতে পারে। কী একটা বই যেন এদেরকে অভিন্ন হৃদয়েষু বলে উৎসর্গ করেছিলেন। এখলাস ভাই ও হাসনাত ভাইয়ের সুপারিশে রাব্বি সাহেব হাসান ভাইয়ের শ্যালক ও কাজিন রফিককে গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি দিয়েছিলেন। হাসান ভাইয়ের রাজশাহীর বাসায় থেকে তার বিভাগে দর্শনে মাস্টার্স করেছিলেন রফিক। সহকর্মী হিসেবে রফিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এতটা বাড়ে যে, শাহজাহানপুরের এক বাসায় আমরা সপরিবার সহভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম বেশ কিছুদিন। আমি রফিকের আগেই বিয়ে করে তখন এক সন্তানের পিতা। প্রথম বই বের হয়নি তখনো। তবে ঘরে-বাইরে লেখক হয়ে ওঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। রফিকের কাছে গল্প শুনে শুনে লেখক ও মানুষ হাসান আজিজুল হকও খুব চেনা হয়ে উঠেছিলেন। আমার লেখক হওয়ার প্রয়াস ও চালচলন দেখেই হয়তো, হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে আমাকেও তার কার্বন কপি বলে মন্তব্য করত রফিক। আমার স্ত্রীর কাছে লেখক মানেই যেমন সংসার করার অনুপযোগী মানুষ, রফিক ভাইয়ের প্রশংসাও সেরকম ছিল কিনা জানি না।

তবে নিজেকে হাসান ভাইয়ের মতো সম্ভাবনায় লেখক ভাবতে ভাল লাগত, এরকম ধারনা প্রেরণাও জোগাত নিজেকে।

রফিকের মাধ্যমে হাসান ভাইয়ের নানা গল্প শোনা ছাড়াও তার মাধ্যমেই হাসান ভাইয়ের অগ্রজ বোন ও লেখক জাহানারা নওশনীন ওরফে জানু আপার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। ফলে হাসান ভাই ঢাকায় এলে গ্রন্থকেন্দ্রে কিংবা গ্রন্থকেন্দ্রের নিকটবর্তী পুরানা পল্টনে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হকের অফিসে যাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, সেসইসব আড্ডাতেও শরিক হওয়ার সুযোগ ক্রমে বাড়তে থাকে আমার। সরদার জয়েন উদ্দীনের আমলেই শিল্পী আব্দুর রউফ সরকার গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সম্পর্কে তিনি লেখক শওকত আলীর অনুজ। শওকত আলীও কবি কায়সুল হককে অগ্রজের মতো দেখতেন। সেই সবুাদে শওকত ভাইও প্রায় আসতেন অফিসে।

হাসান ভাই ঢাকায় এলে একবার রউফ তার মেজদাসহ হাসান ভাইকেও বাসায় নিমন্ত্রণ করেন হাঁস-খিচুড়ি খাওয়াতে। আমি গ্রন্থকেন্দ্রের সহকর্মী ও প্রতিবেশী হিসেবে অগ্রজ দুই লেখকরে সঙ্গে রউফ ভাইয়ের বাসার খিচুড়ি-আড্ডায় শরিক হওয়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হই।

লেখক হিসেবে আমার সম্ভাবনা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব ও পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজন’ প্রকাশের পর। বই প্রকাশের আগেই যেহেতু তাদের সঙ্গে অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কটা নিবিড় হয়েছিল, তিনজনকেই বই দিয়েছিলাম পড়তে। তিনজনই পড়েছিলেন তারা। হাসান ভাই ওই সময়ে কোনো এক পত্রিকায় শাহাদুজ্জামানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে আমার বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ লেখক হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। গল্পগুলোকে বিদ্যুতের তরোয়ালের মতো কিংবা লাঙলের ফলার মতো ধারালো- এ ধরণের মন্তব্য করেছিলেন।

আমার প্রথম উপন্যাস তমস সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের তালিকায় রেখেছিলেন কোনো বক্তৃতায় কিংবা আড্ডায়। বড় লেখকের এক-আধ লাইনের সার্টিফিকেট, এমনকি মৌখিক প্রশংসাও যে পঠন-পাঠনে অতি দীন ও ক্ষীণ দেশের সাহিত্যজগতে তরুণদের লেখক ইমেজ গড়ে উঠতে টনিকের কাজ দেয়, হাসান ভাইয়ের ওইটুকু প্রশংসাতেই বুঝেছিলাম। যারা আমার বই পড়েননি, সৌজন্য কপি উপহার দিলেও পড়ার সময় পাননি- এমন সাহিত্যবোদ্ধারাও আমাকে লেখক স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু হাসান, শওকত বা ইলিয়াস ভালো বলেছেন, অতএব অপাঠক বিশিষ্টজনের চোখেও আমি শক্তিমান লেখক।

আমার বিশ্বাস, পাঠক-সংকটে ক্রমশঃ সংকুচিত সাহিত্যজগতে পরের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত সাহিত্যবোদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি। এ ধরণের সাহিত্যবোদ্ধার প্রশংসা-প্রশস্তির চেয়ে প্রকৃত পাঠকের পঠন প্রতিক্রিয়ার অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ‘ভাল’ কিংবা ভাল না লাগার প্রকাশ্য নাক কুঁচকানো উপেক্ষাও লেখকের জন্য উপকারী জিনিস। আর প্রকৃত পাঠক যদি সততার সঙ্গে তার পাঠের তৃপ্তি কিংবা অতৃপ্তির কিছু কারণ জানান, সাহিত্যবোদ্ধার সার্টিফিকেটের চেয়েও এমন প্রাপ্তি লেখকের জন্য প্রেরণার কারণ হতে পারে। এ কারণে নিজের বইয়ের ভূমিকা বা প্রচ্ছদ পরিচিতিতে ব্যবহারের জন্য বড় লেখকের ইমেজসম্পন্ন কারো কাছে সার্টিফিকেট লিখে দেয়ার আবদার করিনি।

তবে প্রথম বই প্রকাশের পরই আমার সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকের যে ইমেজ গড়ে ওঠে, তার মূলে হাসান ভাই ও ইলিয়াস ভাইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিতভাবে আমার প্রশংসা করেননি, কিন্তু প্রথম বইয়ের জন্য পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা আদায় করে দেয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে গল্প অন্যত্র করব।

এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যে কথাটি বলতে চাই, নবীন লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ লেখকরা অভিভাবক তুল্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমার ক্ষেত্রে এ ভূমিকা যারা পালন করেছেন যে অগ্রজগণ, হাসান ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই। নব্বইয়ের দশকেই আমার ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ উপন্যাসটি তাকে উৎসর্গ করতে পেরে, বইটি প্রকাশেরও অন্যতম সার্থকতা মনে হয়েছিল।

লেখকজীবনের শুরু থেকে যেসব অগ্রজ লেখক আত্মীয়তুল্য আপনজন হয়ে উঠেছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই হারিয়েছি। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একে একে কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক ও শওকত আলীকে হারানোর পর কথাসাহিত্য পরিবারে নিজের একাকিত্ব ও অসহায় দশা বেড়েছে সন্দেহ নেই। জীবিতদের মাঝে অশীতিপর হাসান ভাই রাজশাহীতে। সামাজিক দায় পালনে নানা ইস্যুতে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী বিবৃতিতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা ছাড়াও নিজের মতো করে টুকটাক লেখালেখি করছেন হয়তো। ঢাকার নানা অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে আগের মতো মঞ্চে তার উপস্থিতি ও বক্তৃতার খবর পাই না আর। বয়সের ভারেও ঘরকুণো হতে বাধ্য হয়েছেন হয়তো।

অন্যদিকে ঢাকা ছেড়ে আমিও গ্রামমুখো হওয়ায় হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক বছর। ফোনালাপে একদিন রাজশাহীতে তার বাড়ি উজানে গিয়ে দীর্ঘ সাহিত্য-আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। দুই তিনটি উপন্যাস লিখে হাসান ভাই উপন্যাসিক হিসেবেও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তমস ছাড়া আমার আর কোনো উপন্যাস সম্পর্কে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। আবাসভূমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সাক্ষাতে বলেছিলেন, তোমার বইটির পাখা গজিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল, পড়াই হয়নি আর। এ কারণে আমার নির্বাচিত কয়েকটা উপন্যাস তাকে দিয়ে দাবি জানাব, এগুলোকে উড়ে যেতে দেবেন না, না পড়ে মরেও যাবেন না প্লিজ।

ঠাট্টা করে আরো জিজ্ঞেস করব, আপনার সাবিত্রী আখ্যান উপন্যাসটি আমার প্রতিমা উপন্যাসের সাফল্য কিংবা দুর্বলতার কোনো মিলের জায়গা আছে কি? কিন্তু উজানযাত্রাসহ তার উজানবাড়িতে কবে যে যাওয়া হবে কে জানে!

জীবনে একবার সপরিবার তার ওই নতুন বাড়ি উজানে গিয়ে ভাবির হাতের আন্তরিক আপ্যয়ন ভুলবার মতো নয়। ঢাকায় এলে আমার কলাগাবানের বাসায় সপরিবার একবার বেড়াতে এসেও ধন্য করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসছিলেন। সেখানে অতিথি ছিলেন হাসান ভাই। আমি দেবেশ রায়কে মঙ্গাকালের মানুষ গল্পগ্রন্থ উৎসর্গ করেছি, কিন্তু তখনো সাক্ষাত পরিচয় হয়নি, বইও পৌঁছাতে পারিনি। বইটি দিতে বেইলি রোডের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েছিলাম, হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে।

এইসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি ছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ কিংবা নাঈম হাসানের বাসায় আমাদের প্রিয় অভিভাবক তুল্য সজ্জন ভালো মানুষটিকে কাছে পাওয়ার ও মন খুলে আড্ডা দেয়ার কতো যে স্মৃতি! জীবদ্দশাতেও সেইসব স্মৃতি থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করি অনেক সময়। হাসান ভাইযের মৃত্যুসংবাদ পেলে নিজে সম্পূর্ণরূপে অভিভাবশূন্য ও একা হয়ে যাব। একাকিত্ব, নানারকম স্মৃতি ও বেদনাভার নিয়ে নিজেরও নেই হয়ে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। অমোঘ সান্ত্বনা এখন একটাই।অসাধারণ কিছু ছোটগল্প আর কথাসাহিত্যের কথাকতা লিখে হাসান আজিজুল হক আমাদের যৌবনে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অভিভাবক এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও অন্যতম মোড়ল হয়ে উঠেছিলেন। মোড়ল এই অর্থে, তিনি লিখেছেন যত, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা-আলোচনা, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাবাজি করেছেন আরও বেশি।

কলম না ধরেও তিনি মুখে মুখে কথা বললেও তা সাহিত্যের ছোটখাট নিবন্ধ হয়ে যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে তার একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বহু তরুণ লেখকের কাঙালপনা দেখেছি। জিনিসটা তিনি দিয়েছেনও বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত নবীন কি বিশিষ্ট অনেক লেখককেই।

আমার সঙ্গে হাসান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা যেটুকু গড়ে উঠেছিল, তা কিন্তু এই মোড়ল-ভূমিকা কিংবা তিনি বড় লেখক হওয়ার কারণে নয়। বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রথম পরিচয়েই প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। রাজধানীতে যেসব লেখক-বুদ্ধিজীবী খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা লোটার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন, তাদের মাঝে ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল তাকে। সে কারণেই সম্ভবত পরিচয়ের পর মনখোলা আড্ডা দেওয়ার মতো যখন ঘনিষ্ঠতা হলো, কিছু ধান্ধাবাজ লেখকের নাম দৃষ্টান্ত দিয়ে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি ক্ষমতার লেজুড় ও মানুষ হিসেবে যারা নিকৃষ্ট, তাদের দ্বারা কি শিল্পসাহিত্যে ভালো কাজ হতে পারে? জানি বিষয়টা বিতর্কিত, তারপরও তিনি জোরালো না জবাব দিয়েছিলেন বলে তাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়েছিল।

লেখক হিসেবে সামাজিক দায়বোধ ও তার সাহিত্য চিন্তা সহজেই প্রভাবিত করেছিল নিজেকে। মনে হয়েছিল, লেখক হিসেবে যে দায়বোধ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, মহাশ্বেতা দেবী তার কথাসাহিত্যে আদিবাসী ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে লেখার বিষয় করে কথাসাহিত্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছেন, হাসানের দায়বোধ ও আদর্শিক স্থান সেরকমই। তার পাতালে হাসপাতালে গল্পগ্রন্থসহ শেষদিকের লেখা গল্পগুলো ও কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে লেখকের এই দাযবোধের বিষয়টি।

আরও স্পষ্ট হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে সাহিত্যের ঘরোয়া আড্ডায়। আর এভাবে দূরে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কথাসাহিত্যের প্রিয় অভিভাবক তুল্য আপনজন।

১৯৭৩-এ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকে যেসব বড় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা ও আড্ডাবাজি দেখেছি, তিনি প্রথমে তাদের মধ্যে ছিলেন না। কেননা থাকতেন রাজশাহীতে। আমি অনেকের কাছে তার গল্পের প্রশংসা শুনে আত্মজা ও করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন ইত্যাদি বই পড়েই তার বড় লেখক হওয়ার কারণ-বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে কি, প্রথম পাঠে তাকে অতটা ভালো লাগেনি, বড় লেখকও মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে শুরু করে অনেক বড় লেখকের প্রিয় গল্প পড়ে যেরকম মুগ্ধতা বোধ জেগেছিল, সেরকম অনুভূতি জাগেনি। মনে হয়েছিল, তার লেখায় রসকষের অভাব। আর গল্পের পটভূমি ও চরিত্রগুলিকেও মনে হয় দূরের মানুষ।

প্রথম পরিচয়ের দিনেই পাঠক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার গল্পের গ্রামগুলো আসলে কোথাকার? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, রাঢ় বঙ্গের। হতে পারে, নিজে উত্তরবঙ্গের সরল মানুষ হওয়ায় রাঢ় বঙ্গ ও সাহিত্যের প্রতীকী তাৎপর্য ও জটিলতা তখনো বুঝতে পারিনি বলে তাকে বড় লেখক মনে হয়নি। প্রথম দিকের গল্পে লেখক হিসেবে দায়বোধ বা প্রতিবাদী চেতনাও পষ্ট ধরতে পারিনি। তাছাড়া বাঙলা কথা সাহিত্যের বড় লেখক মানেই তো মেলা উপন্যাস, হাসান ভাইয়ের তখনো একটাও উপন্যাস পাইনি বলে কাজের চেয়ে তার নাম নিয়ে মাতামাতি বেশি মনে হয়েছিল।

প্রথম দেখা ও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল অফিসেই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক বদল হয়েছে তখন। পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমান তখন শাসনক্ষমতায়। অধ্যাপক আবুল ফজল যেমন হয়েছিলেন শেখ মুজিবের শাসনামলে, প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানও তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও যেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, গ্রন্থজগতের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটিকে যুগোপযোগী করতে চাইলেন তিনি। এই লক্ষ্যে সরদার জয়েন উদ্দীনকে টেকস্ট বুক বোর্ডে বদলি করে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ও আপন ভাগ্নে ফজলে রাব্বিকে পরিচালক করে আনলেন গ্রন্থকেন্দ্রের। আমি যেহেতু তখন পরিচালকের একান্ত সহকারী, উপরন্তু গ্রন্থানুরাগী হবু-লেখক ও গোগ্রাসী-পাঠকও বটে, গ্রন্থোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে পরিচালকের উৎসাহী সহযোগী-সমর্থক এবং কখনও বা প্রধান বিরোধীও ছিলাম। ফলে বস হিসেবে রাব্বি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার দীর্ঘস্থায়ী ও তিক্তমধুর হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অফিসের সরকারি গ্রন্থান্নয়নের কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার বয়ান থাক, আমি বরং নিজের সাহিত্যের উন্নয়ন প্রসঙ্গে হাসান ভাইয়ের কিছু স্মৃতিচারণা করি এ লেখাটায়।

ফজলে রাব্বির আমলে শিশুসাহিত্যের বড় লেখক এখলাস উদ্দিন আহমেদ ও বাংলা একাডেমির আর এক পরিচালক আবুল হাসনাতও গ্রন্থকেন্দ্রে আড্ডা দিতে প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। হাসান ভাই এদেরও বন্ধু ছিলেন। তিনজনই তারা জন্মগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, মিলটা এ কারণেও বেশি হতে পারে। কী একটা বই যেন এদেরকে অভিন্ন হৃদয়েষু বলে উৎসর্গ করেছিলেন। এখলাস ভাই ও হাসনাত ভাইয়ের সুপারিশে রাব্বি সাহেব হাসান ভাইয়ের শ্যালক ও কাজিন রফিককে গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি দিয়েছিলেন। হাসান ভাইয়ের রাজশাহীর বাসায় থেকে তার বিভাগে দর্শনে মাস্টার্স করেছিলেন রফিক। সহকর্মী হিসেবে রফিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এতটা বাড়ে যে, শাহজাহানপুরের এক বাসায় আমরা সপরিবার সহভাড়াটিয়া হিসেবে ছিলাম বেশ কিছুদিন। আমি রফিকের আগেই বিয়ে করে তখন এক সন্তানের পিতা। প্রথম বই বের হয়নি তখনো। তবে ঘরে-বাইরে লেখক হয়ে ওঠার জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। রফিকের কাছে গল্প শুনে শুনে লেখক ও মানুষ হাসান আজিজুল হকও খুব চেনা হয়ে উঠেছিলেন। আমার লেখক হওয়ার প্রয়াস ও চালচলন দেখেই হয়তো, হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে আমাকেও তার কার্বন কপি বলে মন্তব্য করত রফিক। আমার স্ত্রীর কাছে লেখক মানেই যেমন সংসার করার অনুপযোগী মানুষ, রফিক ভাইয়ের প্রশংসাও সেরকম ছিল কিনা জানি না।

তবে নিজেকে হাসান ভাইয়ের মতো সম্ভাবনায় লেখক ভাবতে ভাল লাগত, এরকম ধারনা প্রেরণাও জোগাত নিজেকে।

রফিকের মাধ্যমে হাসান ভাইয়ের নানা গল্প শোনা ছাড়াও তার মাধ্যমেই হাসান ভাইয়ের অগ্রজ বোন ও লেখক জাহানারা নওশনীন ওরফে জানু আপার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। ফলে হাসান ভাই ঢাকায় এলে গ্রন্থকেন্দ্রে কিংবা গ্রন্থকেন্দ্রের নিকটবর্তী পুরানা পল্টনে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হকের অফিসে যাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, সেসইসব আড্ডাতেও শরিক হওয়ার সুযোগ ক্রমে বাড়তে থাকে আমার। সরদার জয়েন উদ্দীনের আমলেই শিল্পী আব্দুর রউফ সরকার গ্রন্থকেন্দ্রের চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সম্পর্কে তিনি লেখক শওকত আলীর অনুজ। শওকত আলীও কবি কায়সুল হককে অগ্রজের মতো দেখতেন। সেই সবুাদে শওকত ভাইও প্রায় আসতেন অফিসে।

হাসান ভাই ঢাকায় এলে একবার রউফ তার মেজদাসহ হাসান ভাইকেও বাসায় নিমন্ত্রণ করেন হাঁস-খিচুড়ি খাওয়াতে। আমি গ্রন্থকেন্দ্রের সহকর্মী ও প্রতিবেশী হিসেবে অগ্রজ দুই লেখকরে সঙ্গে রউফ ভাইয়ের বাসার খিচুড়ি-আড্ডায় শরিক হওয়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হই।

লেখক হিসেবে আমার সম্ভাবনা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রভাব ও পক্ষপাত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অবিনাশী আয়োজন’ প্রকাশের পর। বই প্রকাশের আগেই যেহেতু তাদের সঙ্গে অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কটা নিবিড় হয়েছিল, তিনজনকেই বই দিয়েছিলাম পড়তে। তিনজনই পড়েছিলেন তারা। হাসান ভাই ওই সময়ে কোনো এক পত্রিকায় শাহাদুজ্জামানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে আমার বই পাঠের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ লেখক হিসেবে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। গল্পগুলোকে বিদ্যুতের তরোয়ালের মতো কিংবা লাঙলের ফলার মতো ধারালো- এ ধরণের মন্তব্য করেছিলেন।

আমার প্রথম উপন্যাস তমস সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের তালিকায় রেখেছিলেন কোনো বক্তৃতায় কিংবা আড্ডায়। বড় লেখকের এক-আধ লাইনের সার্টিফিকেট, এমনকি মৌখিক প্রশংসাও যে পঠন-পাঠনে অতি দীন ও ক্ষীণ দেশের সাহিত্যজগতে তরুণদের লেখক ইমেজ গড়ে উঠতে টনিকের কাজ দেয়, হাসান ভাইয়ের ওইটুকু প্রশংসাতেই বুঝেছিলাম। যারা আমার বই পড়েননি, সৌজন্য কপি উপহার দিলেও পড়ার সময় পাননি- এমন সাহিত্যবোদ্ধারাও আমাকে লেখক স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু হাসান, শওকত বা ইলিয়াস ভালো বলেছেন, অতএব অপাঠক বিশিষ্টজনের চোখেও আমি শক্তিমান লেখক।

আমার বিশ্বাস, পাঠক-সংকটে ক্রমশঃ সংকুচিত সাহিত্যজগতে পরের মুখে ঝাল খেতে অভ্যস্ত সাহিত্যবোদ্ধাদের সংখ্যাই বেশি। এ ধরণের সাহিত্যবোদ্ধার প্রশংসা-প্রশস্তির চেয়ে প্রকৃত পাঠকের পঠন প্রতিক্রিয়ার অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ‘ভাল’ কিংবা ভাল না লাগার প্রকাশ্য নাক কুঁচকানো উপেক্ষাও লেখকের জন্য উপকারী জিনিস। আর প্রকৃত পাঠক যদি সততার সঙ্গে তার পাঠের তৃপ্তি কিংবা অতৃপ্তির কিছু কারণ জানান, সাহিত্যবোদ্ধার সার্টিফিকেটের চেয়েও এমন প্রাপ্তি লেখকের জন্য প্রেরণার কারণ হতে পারে। এ কারণে নিজের বইয়ের ভূমিকা বা প্রচ্ছদ পরিচিতিতে ব্যবহারের জন্য বড় লেখকের ইমেজসম্পন্ন কারো কাছে সার্টিফিকেট লিখে দেয়ার আবদার করিনি।

তবে প্রথম বই প্রকাশের পরই আমার সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকের যে ইমেজ গড়ে ওঠে, তার মূলে হাসান ভাই ও ইলিয়াস ভাইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখিতভাবে আমার প্রশংসা করেননি, কিন্তু প্রথম বইয়ের জন্য পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার টাকা আদায় করে দেয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সে গল্প অন্যত্র করব।

এখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যে কথাটি বলতে চাই, নবীন লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অগ্রজ লেখকরা অভিভাবক তুল্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমার ক্ষেত্রে এ ভূমিকা যারা পালন করেছেন যে অগ্রজগণ, হাসান ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই। নব্বইয়ের দশকেই আমার ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ উপন্যাসটি তাকে উৎসর্গ করতে পেরে, বইটি প্রকাশেরও অন্যতম সার্থকতা মনে হয়েছিল।

লেখকজীবনের শুরু থেকে যেসব অগ্রজ লেখক আত্মীয়তুল্য আপনজন হয়ে উঠেছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই হারিয়েছি। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একে একে কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক ও শওকত আলীকে হারানোর পর কথাসাহিত্য পরিবারে নিজের একাকিত্ব ও অসহায় দশা বেড়েছে সন্দেহ নেই। জীবিতদের মাঝে অশীতিপর হাসান ভাই রাজশাহীতে। সামাজিক দায় পালনে নানা ইস্যুতে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী বিবৃতিতে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা ছাড়াও নিজের মতো করে টুকটাক লেখালেখি করছেন হয়তো। ঢাকার নানা অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে আগের মতো মঞ্চে তার উপস্থিতি ও বক্তৃতার খবর পাই না আর। বয়সের ভারেও ঘরকুণো হতে বাধ্য হয়েছেন হয়তো।

অন্যদিকে ঢাকা ছেড়ে আমিও গ্রামমুখো হওয়ায় হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক বছর। ফোনালাপে একদিন রাজশাহীতে তার বাড়ি উজানে গিয়ে দীর্ঘ সাহিত্য-আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। দুই তিনটি উপন্যাস লিখে হাসান ভাই উপন্যাসিক হিসেবেও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তমস ছাড়া আমার আর কোনো উপন্যাস সম্পর্কে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। আবাসভূমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সাক্ষাতে বলেছিলেন, তোমার বইটির পাখা গজিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল, পড়াই হয়নি আর। এ কারণে আমার নির্বাচিত কয়েকটা উপন্যাস তাকে দিয়ে দাবি জানাব, এগুলোকে উড়ে যেতে দেবেন না, না পড়ে মরেও যাবেন না প্লিজ।

ঠাট্টা করে আরো জিজ্ঞেস করব, আপনার সাবিত্রী আখ্যান উপন্যাসটি আমার প্রতিমা উপন্যাসের সাফল্য কিংবা দুর্বলতার কোনো মিলের জায়গা আছে কি? কিন্তু উজানযাত্রাসহ তার উজানবাড়িতে কবে যে যাওয়া হবে কে জানে!

জীবনে একবার সপরিবার তার ওই নতুন বাড়ি উজানে গিয়ে ভাবির হাতের আন্তরিক আপ্যয়ন ভুলবার মতো নয়। ঢাকায় এলে আমার কলাগাবানের বাসায় সপরিবার একবার বেড়াতে এসেও ধন্য করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসছিলেন। সেখানে অতিথি ছিলেন হাসান ভাই। আমি দেবেশ রায়কে মঙ্গাকালের মানুষ গল্পগ্রন্থ উৎসর্গ করেছি, কিন্তু তখনো সাক্ষাত পরিচয় হয়নি, বইও পৌঁছাতে পারিনি। বইটি দিতে বেইলি রোডের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েছিলাম, হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে।

এইসব অবিস্মরণীয় স্মৃতি ছাড়াও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ কিংবা নাঈম হাসানের বাসায় আমাদের প্রিয় অভিভাবক তুল্য সজ্জন ভালো মানুষটিকে কাছে পাওয়ার ও মন খুলে আড্ডা দেয়ার কতো যে স্মৃতি! জীবদ্দশাতেও সেইসব স্মৃতি থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করি অনেক সময়। হাসান ভাইযের মৃত্যুসংবাদ পেলে নিজে সম্পূর্ণরূপে অভিভাবশূন্য ও একা হয়ে যাব। একাকিত্ব, নানারকম স্মৃতি ও বেদনাভার নিয়ে নিজেরও নেই হয়ে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। অমোঘ সান্ত্বনা এখন একটাই।- লেখাটি হাসান আজিজুল হকের জীবদ্দশায় রচিত