দেশ বনাম রাষ্ট্র
- প্রকাশের সময় : ০১:৩০:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ অক্টোবর ২০২১
- / ৭৯ বার পঠিত
ড. আবু এন এম ওয়াহিদ: দেশ ও রাষ্ট্র এ দুটো শব্দকে একই অর্থে ব্যবহার করা যায়, আবার তাদের মধ্যে একটি তফাৎ নির্ণয় করাও সম্ভব। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে উভয়ই এক ও অভিন্ন; কারণ দেশ গঠন করতে দরকার হয় ভূখন্ড, মানুষ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব।
রাষ্ট্রের বেলাও তাই, তবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী জনকল্যাণমুখী নীতিমালা, কর্মতৎপরতা ও কার্যকারিতার দিক থেকে আমার মতে এ দুটো ধারণা এক নয়, বরং সুস্পষ্টভাবেই আলাদা।
যে দেশের সরকার স্বাধীনভাবে তার সার্বভৌমত্বের চর্চা ও প্রয়োগ করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ হাসিল করতে পারে না অথবা ন্যূনতমপক্ষে নাগরিকদের দুয়ারে দুয়ারে ইনসাফ পৌঁছে দিতে পারে না অথবা এ দুয়ের মাঝে কোনোটারই বিহিত করতে অপারগ-সেটি দেশ হতে পারে, কিন্তু তাকে আমি রাষ্ট্র বলতে নারাজ।
আর সম্ভবত এ অর্থেই একবার ঢাকার এক টিভি টকশোতে জনৈক প্রবীণ সাংবাদিক একটি চমৎকার কথা বলেছিলেন-‘একাত্তরে আমরা একটি দেশ পেয়েছি, রাষ্ট্র পাইনি’। আমার প্রশ্ন, আজও কি পেয়েছি? কেবল আমরাই নই, এ জমিনে বসবাসকারী অনেক জাতি আছে, যারা নিজ নিজ দেশকে যুগ যুগ ধরেও রাষ্ট্র বানাতে পারেনি। বলা বাহুল্য, দেশ পাওয়া যত সহজ, তাকে তিলে তিলে রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা তার চেয়ে অনেক কঠিন।
এবার আসুন দেখি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও ইতোমধ্যে আমি ‘ইনসাফে’র বিষয়টি যেভাবে রাষ্ট্র-সংজ্ঞার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি, তা ওই শাস্ত্রের কোনো কিতাবে আছে কিনা আমার জানা নেই। ধারণাটি আমি কোনো পন্ডিতের বয়ান কিংবা গবেষণা প্রবন্ধ থেকেও নেইনি।
কথাটি আমার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত। এর সঙ্গে কেউ একমত হতে পারেন, না-ও পারেন। তবে যে কথার সঙ্গে কারও দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই তা হলো, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তার ‘সার্বভৌমত্ব’। আমার আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই এখান থেকেই।
বর্তমান পৃথিবীতে দু’শর অধিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্বাধীন দেশ আছে, যাদের সবাই তথাকথিত ‘সার্বভৌমত্বের’ দাবিদার। সাধারণ পরিষদে পূর্ণ ভোটাধিকারসহ তারা জাতিসংঘের সদস্যও বটে। হলে কী হবে, তাদের মধ্যে কতটা রাষ্ট্রপদবাচ্য, কতটা সত্যিকার অর্থে আপন আপন আজাদী ও সার্বভৌম ক্ষমতা এস্তেমাল করতে পারে? এ প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরেফিরে আসে। ‘আম’ দেশগুলোর কথায় আবার ফিরে আসব; এখন একটু দেখতে চাই মুরব্বিদের কী অবস্থা।
আমরা জানি, দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের মাথার ওপর বসে আছে পাঁচ মুরব্বি (‘ক্লাব অফ ফাইভ’)- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। এ ‘ক্লাব অফ ফাইভ’ বিশ্বসংস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে শক্তিশালী ‘ভেটো’ পাওয়ার।
এ অভাবনীয় ও অভিনব ক্ষমতাবলে তারা কী না করতে পারে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘নিরাপত্তা পরিষদে’ ভোটাভুটি হয়। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পাঁচ মুরব্বির যে কোনো একজনের পছন্দ না হলে সে একাই তুড়ি মেরে নিমেষে তা উড়িয়ে দিতে পারে।
এ ছাড়া ‘ক্লাব অফ ফাইভে’র সবাই অর্থেবিত্তে, প্রযুক্তিতে, কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে দরকষাকষি করে, মারামারি করে না। তারা পারস্পরিক মর্যাদা, দেওয়া-নেওয়া ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সযতেœ আপন আপন সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করে, কোনো রকম সংঘাত ছাড়াই নিজেদের স্বার্থ কৌশলে উদ্ধার করতে পারে। যখন পারে না, তখন প্রতিপক্ষের ওপর ক্রমাগত কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপ বাড়াতে থাকে।
কোনো এক পর্যায়ে এক বা একাধিক বন্ধুরাষ্ট্রকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে। আখেরে কোনো সময় সফল হয়, কখনো আবার ব্যর্থও হয়। তবে প্রতিপক্ষের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয় না, দিতে পারে না এবং আক্রান্ত না হলে যুদ্ধও করে না,
আবার আত্মসমর্পণও করে না। আর তাই, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সবার উপরে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় তাদের অবস্থান। এই তারাই যখন অন্যান্য ছোটখাটো রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মোয়ামেলাত করে, তখন কোনো কোনো সময় নিজেদের একক ও অন্যায্য সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। যেমন ইংল্যান্ড করল ‘ফকলান্ড’ যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র করল ‘ইরাক’ যুদ্ধ।
ইতিহাসে এ রকম ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। তবে এ কাজটি সব সময় সবার সঙ্গে একইভাবে করা যায় না। যখন ¯্রফে গায়ের জোরে কোনো কিছু কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না, তখন তারা বোঝাপড়া ও দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থের হেফাজত করে থাকে।
এখানে ২০১৯ সালের দুটো উদাহরণই যথেষ্ট- ১. ইরান যখন উড়ন্ত মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন গুলি করে ফেলে দিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র পালটা হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছু হটল, সামনে এগোতে পারল না; ২. এককালের পরাশক্তি ইংল্যান্ড ইরানের তেলবাহী জাহাজ জিব্রাল্টারে আটকাল বটে, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। প্রতিপক্ষের পালটা অ্যাকশনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।
এ ঘটনাগুলো আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। দেখার বিষয়, এখানে কোনো পক্ষই সীমা লঙ্ঘন করেনি। যেমন-যুক্তরাষ্ট্র ইরানের আকাশসীমা ঘেঁষে ওড়াউড়ি করে ইরানকে একটু বাজিয়ে দেখল প্রতিপক্ষের সক্ষমতা কতখানি, কী-ই বা তার আত্মপ্রত্যয়, কিন্তু বোমা ফেলল না, মানুষ মারল না, বাড়াবাড়ি করল না।
একইভাবে ইরান মানুষবিহীন ড্রোন ফেলে আমেরিকাকে সঙ্গে সঙ্গে কড়া ও কঠিন বার্তাটি দিয়ে দিল বটে, কিন্তু সেও সীমা লঙ্ঘন করল না, ভূপাতিত করা ওই ড্রোনের পাশেই মানুষ বহনকারী আমেরিকার অন্য বিমানের দিকে কামান দাগাল না।
এভাবে উভয়ের জন্য সমস্যার একটি সমঝোতামূলক সম্মানজনক সমাধান হয়ে গেল। সাবধানে কেউই পরিস্থিতিকে আর বাড়তে দেয়নি, উত্তপ্ত হতে দেয়নি। কাসেম সুলেমানি হত্যার পর খেলাটা একই তরিকায় শেষ হয়-যত গর্জন তত বর্ষণ হয়নি। তবে এক্ষেত্রে আরেকটা বাড়তি উপাদান ছিল।
কেউ আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়েছে, মুচকি মুচকি হেসেছে। যাদের বোঝার তারা বুঝেছে ঠিকই, কিন্তু কোনো অ্যাকশনে যায়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব খেলায় হারজিৎ ও মান-অপমানের কোনো বালাই থাকে না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইরানের তেলবাহী জাহাজ নিয়ে যা ঘটেছিল, তা-ও চরিত্রগত দিক থেকে একই কিসিমের।
আমার বিবেচনায়, কূটনৈতিক ও সামরিক দক্ষতার বলে পাঁচ মুরব্বির সঙ্গে ইরানকেও ‘রাষ্ট্র’ বলা যায়। এদের সঙ্গে হাতেগোনা আরও কয়েকটি দেশকে এ কাতারে ফেলাও যায়-তার মধ্যে সবার আগে যে নামটি আসে সেটি হলো ভারত, তারপর আসবে তুরস্কের নাম।
কৌশলগত অবস্থান, সামরিক শক্তি ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দেনদরবার অব্যাহত রাখার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ বলতে পারেন পাকিস্তানও এদের দলে পড়ে, আবার কেউ এ মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতেই পারেন, সেদেশের সার্বভৌমত্ব তো চীনের কাছে বন্ধক দেওয়া।
অন্যদের কথা যদি বলি-প্রযুক্তিতে উন্নত ও অর্থনীতির ভিত্তি এত মজবুত হওয়া সত্তে¡ও জার্মানি, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য উন্নত দেশকে আমি এসব শক্তিমান সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমকক্ষ মনে করি না, কারণ তাদের দেখভাল, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা যুগ যুগ ধরে ‘ন্যাটো’ তথা আমেরিকার জিম্মায় রয়েছে। তাহলে সার্বভৌমত্বের মাপকাঠিতে দেখা যায়, দুনিয়ার অতি অল্পসংখ্যক দেশই রাষ্ট্রপদবাচ্য।
এবার দেখতে চাই দেশ কিংবা রাষ্ট্র হিসাবে ছোটরা কেন এত বড় ও মহৎ একটি জাতীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। পারে না-কারণ তারা ছোট, তারা গরিব, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে তারা দুর্বল। এর চেয়েও বড় কথা, তারা সব সময় পরাধীনতা ও হীমন্যতার মানিসকতায়ও ভুগে থাকে।
তাদের কাজকারবারে নিজেদের প্রতি আস্থা এবং আপন জনগণের প্রতি যথাযথ সম্মান ও অঙ্গীকারে বিশাল ঘাটতি প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান হয়। তারা হামেশা বড় কিংবা পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে একদিকে নানা ধরনের সুবিধা নিয়ে থাকে, আবার অন্যদিকে ওই বড়দের চাপে নিষ্পেষিতও হতে থাকে।
এর মাঝে যেসব দেশ যত বড়, যত সবল, যত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যত বুদ্ধিমান ও কৌশলী-তারা তাদের সার্বভৌমত্বকে ততটাই স্বাধীনভাবে অনুশীলন ও ব্যবহার করতে পারে অথবা অন্তত করার চেষ্টা করতে পারে। এভাবে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে যে দেশ যত দৃঢ়তার সঙ্গে যত বেশি এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেদেশ ততটাই স্বাধীন, ততটাই সার্বভৌম, ততটাই রাষ্ট্র নামের যোগ্য। বোধগম্য কারণেই ইরান যা পারে, বাংলাদেশ তা পারে না, প্রতিবেশী দেশ ভারত যা পারে, বাংলাদেশ তা পারে না। তাই অন্যসব ছোট দেশের মতো বাংলাদেশকেও তার সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের আগে তার মুরব্বিদের অর্থাৎ ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশের স্বার্থের দিকে হামেশা যতœবান থাকতে হয়। (দৈনিক যুগান্তর)
লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র