চীনকে ঠেকাতে ভারতমুখী যুক্তরাষ্ট্র

- প্রকাশের সময় : ১২:৩১:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ অগাস্ট ২০২১
- / ১১৯ বার পঠিত
রাবেয়া আশরাফী পিংকি: যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন জো বাইডেন। নানা ঘটনায় ভীষণ উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে তিনি এ পদে অভিষিক্ত হন। তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য প্রেসিডেন্টদের মতো সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। তার উগ্র সমর্থকরা দেশটির পার্লামেন্টে (ক্যাপিটল) হামলা চালানোর মতো নজিরবিহীন ঘটনার সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই নানা কর্মকান্ডে বিতর্কিত ছিলেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টের মধ্যেই কমবেশি চীন-বিরোধী মনোভাব দেখা গেলেও, ট্রাম্প এর প্রকট প্রকাশ দেখিয়েছেন। বিশেষ করে এশিয়ায় চীনের প্রভাব তিনি যে কোনোভাবে রুখতে চেয়েছেন।ক্ষমতায় না থাকার পরও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রীয় কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করেছেন। ওই নথিতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বেইজিংয়ের উত্থানকে দমিয়ে রাখতে ভারতের আধিপত্য বাড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, চীনের হামলা থেকে সুরক্ষিত থাকতে তাইওয়ানের সক্ষমতা বাড়ানোও আমেরিকান পরিকল্পনায় রয়েছে।
‘ইউনাইটেড স্টেটস স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক’ শিরোনামের নথিটি প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েন। ২০১৮ সালে নথিটি অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ও’ব্রায়েনের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত দিক-নির্দেশনা’র বিষয়গুলো এ নথিতে রয়েছে। আর এই মুহূর্তে নথিটি প্রকাশ করার অর্থ ‘ভবিষ্যতেও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল মুক্ত ও উদার রাখার’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতির বহিঃপ্রকাশ। ও’ব্রায়েন এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোকে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির তৈরি ‘পরিণতির’ দিকে সঁপে দিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পুরোপুরি ভিন্ন। আমাদের যেসব মিত্র ও অংশীদার একটি মুক্ত এবং উদার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বিশ্বাস করে, তাদের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত রাখা হবে এ বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করতে চাই।”
প্রসঙ্গত, সা¤প্রতিক সময়ে এশিয়া অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে উলে¬খযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণ-এশিয়া অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এখানে চলছে উনিশ শতকের পুরনো গ্রেট গেম। এই খেলার একপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এবং অপর প্রান্তে চীন। বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির দেশের এই টানাপড়েনে দক্ষিণ এশিয়া ও তৎসংলগ্ন, বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মতো দেশগুলো সংকটে রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই নিজেদের দল ভারি করতে এসব দেশকে টানছে। এশিয়ায় চীনের আধিপত্ব হ্রাসের লক্ষ্যে এই ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা ত্যাগের মাত্র এক সপ্তাহ আগে (১২ জানুয়ারী) প্রকাশিত ওই নথিতে দেখা যায়- উত্তর কোরিয়াকে আর হুমকি হিসেবে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে ‘উদীয়মান দেশ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার চীনা প্রয়াস ঠেকিয়ে দিতে বিশ্বের অন্যান্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার কৌশলও প্রকাশ করা হয়েছে এখানে। নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অনুমান বা ধারণার কথাও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়- তাইওয়ানকে চীনা ভূখন্ডের সঙ্গে ‘জোরপূর্বক একীভূতকরণ’ ক্রমেই জোরালো করছে চীন। এ ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে চীনা আধিপত্য আরও বাড়বে বলেও সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ খাতে চীনা আধিপত্য ‘উদার দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ’ বয়ে আনবে।
উল্লেখ্য, মূল চীন থেকে তাইওয়ান প্রায় ১১০ মাইল দূরে। ১৬৮৩ সালে চীন এই দ্বীপ দখল করলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তা আবার জাপানের দখলে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান বিতারিত হওয়ার পর চীন আবার দ্বীপটির কর্তৃত্ব পায়। মাও সে তুঙের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মূল ভূখন্ডের ক্ষমতা দখল করলে প্রতিপক্ষ জাতীয়বাদী দল কুওমিনটাং ওই দ্বীপে ঘাঁটি গাড়ে। মূল চীন থেকে তাদের অনেক সমর্থকও তাইওয়ানে চলে আসে। তখন থেকে দ্বীপটি তাদের শাসনে চললেও চীন একে নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, একসময় মূল ভূখন্ড ছেড়ে আসা ‘কুয়োমিনটাং’ দল এখন চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরির পক্ষে। কিন্তু দেশটির প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ দল এর বিপক্ষে। চীন তাইওয়ানকে একক দেশ হিসেবে মানতে নারাজ। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষুণন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেক দেশই তাইওয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখে না। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে তাইওয়ানের সঙ্গে পরিপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে মাত্র ১৫টি দেশের। এই তাইওয়ানকে চাপে রাখতে চীন এখন পেশিশক্তি দেখাচ্ছে। দেশটির উপকূল ঘেঁষে প্রায়ই চীনের নৌবাহিনী শক্তি দেখায়। যুদ্ধবিমানও তাক করে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ভরসা চীনের শত্রæ যুক্তরাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের উত্তেজনা যত বাড়ছে তাইওয়ানে আমেরিকান উপস্থিতিও দৃঢ় হচ্ছে। কারণ চীনকে পরাস্ত করতে তাইওয়ানকে নিজেদের হাতের মুঠিতে রাখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ জন্য ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল পরিকল্পনায় তাইওয়ানের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নিয়ে উন্মুক্ত কোনো উৎস এখন পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও নথিতে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক সপ্তাহ আগে এই কৌশল প্রকাশের পেছনে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। এশিয়ায় চীনের উত্থান ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া পদক্ষেপ ব্যাপক সমর্থন পেয়ে আসছে। বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের আগেই তার কর্মকর্তারা চীনের বিপক্ষে রয়েছেন এমন মিত্র এবং সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে আরও বেশি কাজ করার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক আরও জোরদারে গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।
প্রকাশিত নথি প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের অধ্যাপক ররি মেডকাফ বলেন, ‘এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি মূলত মিত্রশক্তি বৃদ্ধি এবং চীনকে প্রতিরোধ প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।’ তবে কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এসব কৌশল যে ব্যর্থ হবে, তা প্রায় নিশ্চিত বলেও উল্লেখ করেছেন মেডকাফ। উত্তর কোরিয়ার নিরস্ত্রীকরণ, আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখা এবং চীনের ক্ষতিকর অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে তোলার মতো কৌশলগুলো খুব একটা কার্যকর হবে না বলে মনে করেন তিনি। প্রকাশিত নথিতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান ও ভারতকে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। দেশ দুটির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও ‘গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু’ হিসেবে উলে¬খ করা হয়েছে। এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য। আর এখানে উত্তর কোরিয়াকে দমিয়ে রাখা চীনের মতোই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এ নথিতে আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন আধিপত্যশীল উপস্থিতি বিবেচনায় এ অঞ্চলের নিরাপত্তার দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। নথিটিতে চীনের কারণে সৃষ্ট নানা চ্যালেঞ্জকে বিস্তারিত ও দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এ নথিটিকে মূলত গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমের প্রতিফলন বলা যায়। ২০১৮ সালে এশিয়ায় চীনের আধিপত্য হ্রাসের যুদ্ধে প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয় এশিয়া-প্যাসিফিককে ইন্দো-প্যাসিফিক নামে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় এ অঞ্চলে ভারতকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, এশিয়ায় সামরিক মহড়া পরিচালনার জন্য কোয়াড কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে দেশটি। তবে ২০১৯ সালে এশিয়াজুড়ে জাপানের আরও সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়। এদিক থেকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই বৈরিতা রয়েছে। আর এ সমস্যাগুলো সমাধান না হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ভাবছে, সেখানে বড় ধরনের ফোকর সৃষ্টি হয়ে যাবে।এ ছাড়া এই কৌশলগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক সহযোগীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
অন্যদিকে, রিজিওনাল ক¤িপ্রহেনসিভ ইকোনমিক কো-অপারেশন কর্মসূচির মাধ্যমে সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের কাঠামোগত রূপ দিয়েছে। ‘ইউনাইটেড স্টেটস স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য ইন্দো-প্যাসিফিক’ নথির গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ-চীনএ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায় চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বায়ো জেনেটিকের মতো প্রযুক্তি খাতে আধিপত্য করতে চায় দেশটি। তাইওয়ানের ওপর দখলদারিত্ব পাকা করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। চীনের শিল্পনীতি এবং বেআইনি বাণিজ্যচর্চা যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ক্ষতি না করতে পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক ঐক্যজোট তৈরি।চীনের সামরিক ও কৌশলগত অধিগ্রহণ ঠেকাতে সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা। ভারতনিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কার্যকর সহযোগী মনে করে ভারত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাব প্রতিরোধে এই দুই দেশ একত্রে কাজ করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রণী অবস্থানে থাকবে ভারত এবং ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা রক্ষার নেতৃত্বেও ভূমিকা অব্যাহতরাখবে।
মালদ্বীপ, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মতো উদীয়মান সহযোগী দেশগুলোর সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা। (সাম্প্রদিক দেশকাল)