যেভাবে গণমানুষের শিল্পী ফকির আলমগীর

- প্রকাশের সময় : ০৩:৩৩:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুলাই ২০২১
- / ৪০ বার পঠিত
বিনোদন ডেস্ক: ফকির আলমগীর ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। গণসংগীত নিয়ে একাই পরিপূর্ণভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। যদিও অন্য ধারার গানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তবে গণমানুষের গানই ফকির আলমগীরকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের হৃদয়ের কাছে। ‘ও সখিনা’ কিংবা ‘মায়ের একধার দুধের দাম’সহ অনেক গানই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে সারা জীবন। করোনার কাছে হেরে গিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
তাঁর গান তরুণ প্রজন্মের মাঝে যেমন জাগিয়েছে দেশপ্রেম তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারী ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে। কালামৃধা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফকির আলমগীর জড়িয়ে যান বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ। তার পরপরই ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়েও ফকির আলমগীর কণ্ঠ মেলান। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ফকির আলমগীরের বয়স তখন ২১ বছর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেল ডাঙায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন তিনি। সেখানে তার সহশিল্পী ছিলেন তিমির নন্দী, নাট্যকার-অভিনেতা মামুনুর রশীদসহ অনেকে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ফকির আলমগীর। আজম খান, ফিরোজ সাঁই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে ফকির আলমগীরও তখন পপ গানে উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন।
ফকির আলমগীরকে ফেরদৌস ওয়াহিদ ‘বাংলার বাঘ’ বলতেন সব সময়। ফকির আলমগীরের গণমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ‘সখিনা’ চরিত্রের। ১৯৮২ সালে বিটিভিতে ঈদ আনন্দমেলায় ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে’ গানটি প্রচারের পর শ্রোতা-দর্শকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। আলতাফ আলী হাসুর কথায় কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি ফকির আলমগীর গানটির সুরও করেছিলেন। পরে আশির দশকের শেষভাগে তিনি লিখেছেন ও গেয়েছেন ‘চল সখিনা দুবাই যাবো, দ্যাশে বড় দুঃখরে’। কে এই সখিনা? এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ফকির আলমগীরকেপ্র্রতিনিয়ত। তিনি জানিয়েছিলেন, সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুখিনী পল্লীবালা আবার কারও কাছে আহ্লাদী বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনো কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনো বা ফুটপাথের ইটভাঙা শ্রমিক।
নব্বইয়ে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনেও গানে গানে তার প্রতিবাদী রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম’, ‘মন আমার দেহ ঘড়ি’, ‘আহারে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ঘর করলাম না রে আমি’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’সহ তার গাওয়া অনেক গানই আশি ও নব্বইয়ের দশকে সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে কখনো রানা প্লাজা আবার কখনো গাজায় ঘটে যাওয়া অমানবিক নির্যাতন নিয়েও গান বেঁধেছেন তিনি।
১৯৯৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে সময় তাকে নিয়ে লেখা ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি শুনিয়েছিলেন এ শিল্পী। ফকির আলমগীর সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। গণসংগীত চর্চার আরেক সংগঠন গণসংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সহ-সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। গানের পাশাপাশি লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তার লেখা বেশকিছু বই প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে ফকির আলমগীরকে একুশে পদক দেয়া হয়। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। (মানবজমিন)