ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
- প্রকাশের সময় : ১২:২৮:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৭ মার্চ ২০১৫
- / ১০১৬ বার পঠিত
ঢাকা: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম এবং ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি এ আগুনঝরা ভাষণ দেন। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মনের অব্যক্ত কথা যেন বের হয়ে আসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি উচ্চারণে, প্রতিটি শব্দে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি উচ্চারণ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে লাখো প্রাণে। গগনবিদারী আওয়াজ তুলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সমর্থন জানায় উপস্থিত জনতা।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এ দেশের গণমানুষকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে এবং তাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা ও সন্ত্রাস চিরতরে দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আসুন, এসব অঙ্গীকার পূরণের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের নৈরাজ্য ও নিরীহ মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ একতাবদ্ধ হই।’
১৯৭১ সালেল ৭ মার্চের আগের চার-পাঁচ দিনের ঘটনাবলিতে বিক্ষুব্ধ মানুষ এ দিন নতুন কর্মসূচির অপেক্ষায় ছিলেন। সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে আগত জনতার ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। লাখো মানুষের পদভারে ঢাকা পরিণত হয় উদ্বেলিত নগরে। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ প্রভৃতি আগুনঝরা শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে আসতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় রেসকোর্স ময়দান।
বঙ্গবন্ধু জনসভায় আসতে একটু বিলম্ব করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে কি হবে না এ নিয়ে তখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক এবং বিতর্ক চলছে নেতৃবৃন্দের মধ্যে। পরে বঙ্গবন্ধু ২২ মিনিটে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন এভাবেÑ “আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।… আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের বুক খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, আপনি দেখুন।… ২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি ডেকেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। রক্তে পা দিয়ে শহীদের উপর পাড়া দিয়ে অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে… । ”
এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের আগের কয়েক দিনের ঘটনাবলি, শাসকশ্রেণীর সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া এবং মুক্তির আকাক্ষায় বাংলাদেশীদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষনা করেন। ভাষণে তিনি বলেনÑ ‘এরপর যদি একটি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়Ñ তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।… আমি যদি তোমাদের হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা সব বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।… আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এদিন বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র বক্তা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে চার খলিফা খ্যাত আ স ম আবদুর রব, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ নেতা মঞ্চ থেকে মাইকে বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিয়ে উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত রাখেন।
৭ মার্চের আগের ৪-৫ দিনের ঘটনাবলি: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়াসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সব ন্যায্য দাবি দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হয়। ৩ মার্চ পল্টনের বিশাল জনসমাবেশে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ৬ মার্চের মধ্যে যদি সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন না করে তা হলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এ দিকে ৩ মার্চ পল্টনের সমাবেশে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্ধ দেখা দেয়। এ বিষয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী শাহজাহান সিরাজ বলেন, (২০১১ সালে একটি সেমিনারে) পল্টনের সমাবেশেই স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য প্রচন্ড চাপ আসতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের ওপর। ওই দিন পল্টনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেয়ার কথা ছিল না আগে থেকে। কিন্তু সকালে তিনি হঠাৎ করে জানালেন তিনি পল্টনের সমাবেশে ভাষণ দেবেন। তার আসার কথা ছিল আড়াইটায়; কিন্তু তিনি এলেন ৪টার পর। এ দিকে জনগণ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য ক্রমে অধৈর্য হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু আসার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু আসার পর আরেকবার তাকে ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনানো হয় এবং তিনি এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এক দিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ, অন্য দিকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বললেনÑ ছয় তারিখ কর্মসূচি শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন।
ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতার বীজ বপনকারী ঐতিহাসিক জনসভা। (দৈনিক নয়া দিগন্ত)