নিউইয়র্ক ০৫:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

টাঙ্গাইলের নামকরণের ইতিহাস

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৩২:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১
  • / ২৯৫ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত যা ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। এর জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ লক্ষ এবং আয়তন ৩৪১৪.৩৫ বর্গ কিলোমিটার। টাঙ্গাইল আয়তনের ভিত্তিতে ঢাকা বিভাগের সর্ববৃহৎ এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জেলা।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি টাঙ্গাইল ছিল অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা; ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এটি একটি নদী বিধৌত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এই জেলা যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এর মাঝ দিয়ে লৌহজং নদী প্রবহমান।
অবস্থান ও আয়তন: টাঙ্গাইল জেলা ঢাকা হতে প্রায় ৮৪ কি মি দূরে অবস্থিত। এই জেলার পূর্বে রয়েছে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলা, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলা, উত্তরে জামালপুর জেলা, দক্ষিণে ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলা। এর আয়তন ৩৪১৪.৩৮ বর্গ কি.মি.।
নামকরণ: টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহুজনশ্রæতি ও নানা মতামত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’ শব্দের আধিক্য আছে (যেমন- বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি)। অনেকের ধারণা টাঙ্গাইলের অন্য স্থানের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনা প্রবাহে ‘টাঙ্গাইল’ নাম হযয়েছে। টং শব্দের ফরাসী অর্থ উঁচু। আর আইল হচ্ছে আবাদী জমির সীমানা সংলগ্ন অংশ। এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির উপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফরাসী শব্দ, অর্থ হলো উঁচু। অতীত সময়ে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’ বলতো। টাঙ্গাইল জেলা প্রাচীনকাল থেকে পাহাড়ের উঁচু ভূমি ও নিকটবর্তী কৃষি জমির সমাহার। এই উঁচু ভূমি বা টং ও জমির ‘আইল’এই দুইয়ের সমন্বয়ের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের এলাকার নাম টাঙ্গাইল হয়েছে।
টাঙ্গাইলের ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম এর মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে।
আরেক জনশ্রæতিতে রয়েছে, নীলকর টেংগু সাহেবের গল্প এবং এটিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। কয়েকজন সাধারণ এই আইলকে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ।
বাংলাদেশ আদম শুমারী রিপোর্ট, টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ারে, তরুণ গবেষক ইতিহাসবিদ, অনুবাদক জনাব খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নাম ঃ ইতিহাস ও কিংবদন্তী’ নামক এক প্রবন্ধে এবং ড. তারা চাঁদের ‘ঞযব রহভষঁবহপব ড়ভ ওংষধস ড়হ ওহফরধহ পঁষঃঁৎব’ বইয়ে পাওয়া যায় যে, সুবাদার শায়েস্তা খাঁ মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করার জন্য দক্ষিণ ভারতের মালাবর অঞ্চলের মোপলাদের আনার সিদ্ধান্ত নেন। সমুদ্র পাড়ের এই সব মোপলা, যারা অসম সাহসী যোদ্ধা, সম্মুখ যুদ্ধে যারা কখনও পিছু হটে না। এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠণ করে জলদস্যুদের উৎপাত যখন কিছুটা দমিত হলো তখন তাদের বসতির স্থান নির্ধারণ করলেন বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে পরে তারা লৌহজং নদীর চর এলাকায় বসতি স্থাপন করে। মোপলাদের ধর্মগুরুকে তারা নিজস্ব ভাষায় তাংগাইল বলে। নতুন গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে মোগলরা অভিহিত করেছিলেন দিহ্ টাঙ্গাল (দিহ্ শব্দের ফরাসী অর্থ হলো মহল্লা) যা কালক্রমে টাঙ্গাইল হয়েছে।
অন্য মতে, বৃটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয় আটিয়া। নীল ব্যবসার চরম উন্নতির সময় তখন আর আটিয়া স্থানটিকে আশ্রয় করে তখন এই অঞ্চল জম-জমাট হয়ে উঠে। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলে টাঙ্গা গাড়ির সর্বত্র চলাচল ছিল। ‘আল’ শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে ‘টাঙ্গা+আইল’ এভাবে যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’ এমতটি অনেকে পোষণ করেন।
ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মতে, কাগমারি পরগণার জমিদার ইনায়াতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী (১৭০৭-১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ) লৌহজং নদীর টানের আইল দিয়া কাগমারী আধামাইল দূরে খুশনুদপুর (খুশির জায়গা যার সংস্কৃতায়ন করলে সন্তোষ) তাঁর সদর কাচারিতে যাতায়াতে করতেন। এই টানের আইল বা টান আইল বলিয়া বলে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হতে হতে টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে।
অন্য মতবাদে জানা যায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজায় অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থাপন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীণ সময়ে টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামের রূপান্তরিত হয়। আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিক ভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে ‘টান আইল’বলা হতো। যা পরিবর্তীত হয়ে টাঙ্গাইল হয়েছে।
অন্য একটা সূত্রে জানা যায় হযরত শাহ জামাল (রাঃ) জাহাজ যোগে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এদের দলপতির নাম ‘টাংগা’। জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’।
কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সন্তোষ জমিদারিতে ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায় শেষে ঢাকা যাওয়ার পথে একদল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে সেই সঙ্গে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করে লৌহজং এর পূর্ব পারে টাংগিয়ে রেখে যায়। সেই থেকে নাম দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল।
আবার কারো করো মতে ‘টান’ এবং ‘ইল’ নামক দু’জন ইংরেজ সাহেব সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন থানার স্থান নির্বাচনের জন্য তাদের নামানুসারে নাম হয়েছে টাঙ্গাইল।
আঞ্চলিক ইতিহাস: ইতিহাসে টাঙ্গাইলের সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল আজ থেকে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ অঞ্চলই সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিলো। শুধু মাত্র মধুপুর ভাওয়াল বনাঞ্চল শৈল শিলার উচ্চতা নিয়ে বিরাজ করেছিলো। ধারণা করা হয় যে, সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের গারো পাহাড় হতে ভাওয়াল গড় পর্যন্ত যে পাহাড়মালা তাই হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম স্থলভাগ। এই স্থলভাগের বড় অংশ টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত। কাজেই এ জেলার জনবসতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সু-প্রাচীন।
অতীত কাল থেকেই বহু ভাঙ্গাগড়া ও রাজনৈতিক দখল-বেদখল, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যে এলাকা আজ টাঙ্গাইল জেলা বলে পরিচিত লাভ করেছে, টাঙ্গাইল হিসাবে তার গঠন ও স্বতন্ত্র পরিচয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই ভূমিতে জন বসতি পুরাতন হলেও টাঙ্গাইল নামটি সাম্প্রতিক। বরং এই অঞ্চল আটিয়া পরগণার অংশ হিসেবে মোগল আমল থেকে পরিচিত।
প্রাচীনকালে (৬২৯-৬৪৫ খ্রিঃ) পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ কাহিনী পাঠে জানা যায় বঙ্গভূমি ছয়টি প্রধান রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। ১। পৌন্ড্র, (উত্তর বঙ্গ, ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিম ভাগ) ২। কামরূপ (ময়মনসিংহের পূর্বভাগসহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম) ৩। সমতট (ঢাকা-ফরিদপুর) ৪। কমলাহু (ত্রিপুরা বা কুমিল্লা) ৫। তা¤্রলিপ্ত (দক্ষিণ পশ্চিম ভাগ) ও ৬। কর্ণ সুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ)। আমাদের টাঙ্গাইল জেলা তৎকালে কামরূপ রাজ্যের বা প্রাগ জ্যোতিষপুর রাজ্যাংশ- যাকে বলা হয় ‘ভাটির মুল্লুক’এর অন্তর্গত ছিলো। মহাভারত কাব্যগ্রন্থের কামরূপ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত বলা হয়েছে।
তাছাড়া পর্যটক ইবনে বতুতার গ্রন্থেও এ এলাকার বর্ণনা পাওয়া যায়। সূত্র: উইকিপিডিয়া

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

টাঙ্গাইলের নামকরণের ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ০৭:৩২:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১

হককথা ডেস্ক: টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত যা ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। এর জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ লক্ষ এবং আয়তন ৩৪১৪.৩৫ বর্গ কিলোমিটার। টাঙ্গাইল আয়তনের ভিত্তিতে ঢাকা বিভাগের সর্ববৃহৎ এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জেলা।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি টাঙ্গাইল ছিল অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা; ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এটি একটি নদী বিধৌত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এই জেলা যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এর মাঝ দিয়ে লৌহজং নদী প্রবহমান।
অবস্থান ও আয়তন: টাঙ্গাইল জেলা ঢাকা হতে প্রায় ৮৪ কি মি দূরে অবস্থিত। এই জেলার পূর্বে রয়েছে ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলা, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলা, উত্তরে জামালপুর জেলা, দক্ষিণে ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলা। এর আয়তন ৩৪১৪.৩৮ বর্গ কি.মি.।
নামকরণ: টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহুজনশ্রæতি ও নানা মতামত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’ শব্দের আধিক্য আছে (যেমন- বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি)। অনেকের ধারণা টাঙ্গাইলের অন্য স্থানের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনা প্রবাহে ‘টাঙ্গাইল’ নাম হযয়েছে। টং শব্দের ফরাসী অর্থ উঁচু। আর আইল হচ্ছে আবাদী জমির সীমানা সংলগ্ন অংশ। এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির উপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফরাসী শব্দ, অর্থ হলো উঁচু। অতীত সময়ে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’ বলতো। টাঙ্গাইল জেলা প্রাচীনকাল থেকে পাহাড়ের উঁচু ভূমি ও নিকটবর্তী কৃষি জমির সমাহার। এই উঁচু ভূমি বা টং ও জমির ‘আইল’এই দুইয়ের সমন্বয়ের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের এলাকার নাম টাঙ্গাইল হয়েছে।
টাঙ্গাইলের ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম এর মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে।
আরেক জনশ্রæতিতে রয়েছে, নীলকর টেংগু সাহেবের গল্প এবং এটিই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। কয়েকজন সাধারণ এই আইলকে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ।
বাংলাদেশ আদম শুমারী রিপোর্ট, টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ারে, তরুণ গবেষক ইতিহাসবিদ, অনুবাদক জনাব খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নাম ঃ ইতিহাস ও কিংবদন্তী’ নামক এক প্রবন্ধে এবং ড. তারা চাঁদের ‘ঞযব রহভষঁবহপব ড়ভ ওংষধস ড়হ ওহফরধহ পঁষঃঁৎব’ বইয়ে পাওয়া যায় যে, সুবাদার শায়েস্তা খাঁ মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করার জন্য দক্ষিণ ভারতের মালাবর অঞ্চলের মোপলাদের আনার সিদ্ধান্ত নেন। সমুদ্র পাড়ের এই সব মোপলা, যারা অসম সাহসী যোদ্ধা, সম্মুখ যুদ্ধে যারা কখনও পিছু হটে না। এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠণ করে জলদস্যুদের উৎপাত যখন কিছুটা দমিত হলো তখন তাদের বসতির স্থান নির্ধারণ করলেন বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে পরে তারা লৌহজং নদীর চর এলাকায় বসতি স্থাপন করে। মোপলাদের ধর্মগুরুকে তারা নিজস্ব ভাষায় তাংগাইল বলে। নতুন গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে মোগলরা অভিহিত করেছিলেন দিহ্ টাঙ্গাল (দিহ্ শব্দের ফরাসী অর্থ হলো মহল্লা) যা কালক্রমে টাঙ্গাইল হয়েছে।
অন্য মতে, বৃটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয় আটিয়া। নীল ব্যবসার চরম উন্নতির সময় তখন আর আটিয়া স্থানটিকে আশ্রয় করে তখন এই অঞ্চল জম-জমাট হয়ে উঠে। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলে টাঙ্গা গাড়ির সর্বত্র চলাচল ছিল। ‘আল’ শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে ‘টাঙ্গা+আইল’ এভাবে যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’ এমতটি অনেকে পোষণ করেন।
ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মতে, কাগমারি পরগণার জমিদার ইনায়াতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী (১৭০৭-১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ) লৌহজং নদীর টানের আইল দিয়া কাগমারী আধামাইল দূরে খুশনুদপুর (খুশির জায়গা যার সংস্কৃতায়ন করলে সন্তোষ) তাঁর সদর কাচারিতে যাতায়াতে করতেন। এই টানের আইল বা টান আইল বলিয়া বলে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হতে হতে টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে।
অন্য মতবাদে জানা যায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজায় অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থাপন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীণ সময়ে টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামের রূপান্তরিত হয়। আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিক ভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে ‘টান আইল’বলা হতো। যা পরিবর্তীত হয়ে টাঙ্গাইল হয়েছে।
অন্য একটা সূত্রে জানা যায় হযরত শাহ জামাল (রাঃ) জাহাজ যোগে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এদের দলপতির নাম ‘টাংগা’। জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’।
কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সন্তোষ জমিদারিতে ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায় শেষে ঢাকা যাওয়ার পথে একদল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে সেই সঙ্গে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করে লৌহজং এর পূর্ব পারে টাংগিয়ে রেখে যায়। সেই থেকে নাম দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল।
আবার কারো করো মতে ‘টান’ এবং ‘ইল’ নামক দু’জন ইংরেজ সাহেব সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন থানার স্থান নির্বাচনের জন্য তাদের নামানুসারে নাম হয়েছে টাঙ্গাইল।
আঞ্চলিক ইতিহাস: ইতিহাসে টাঙ্গাইলের সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল আজ থেকে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ অঞ্চলই সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিলো। শুধু মাত্র মধুপুর ভাওয়াল বনাঞ্চল শৈল শিলার উচ্চতা নিয়ে বিরাজ করেছিলো। ধারণা করা হয় যে, সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের গারো পাহাড় হতে ভাওয়াল গড় পর্যন্ত যে পাহাড়মালা তাই হচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম স্থলভাগ। এই স্থলভাগের বড় অংশ টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত। কাজেই এ জেলার জনবসতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সু-প্রাচীন।
অতীত কাল থেকেই বহু ভাঙ্গাগড়া ও রাজনৈতিক দখল-বেদখল, চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যে এলাকা আজ টাঙ্গাইল জেলা বলে পরিচিত লাভ করেছে, টাঙ্গাইল হিসাবে তার গঠন ও স্বতন্ত্র পরিচয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই ভূমিতে জন বসতি পুরাতন হলেও টাঙ্গাইল নামটি সাম্প্রতিক। বরং এই অঞ্চল আটিয়া পরগণার অংশ হিসেবে মোগল আমল থেকে পরিচিত।
প্রাচীনকালে (৬২৯-৬৪৫ খ্রিঃ) পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ কাহিনী পাঠে জানা যায় বঙ্গভূমি ছয়টি প্রধান রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। ১। পৌন্ড্র, (উত্তর বঙ্গ, ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিম ভাগ) ২। কামরূপ (ময়মনসিংহের পূর্বভাগসহ পূর্ববঙ্গ ও আসাম) ৩। সমতট (ঢাকা-ফরিদপুর) ৪। কমলাহু (ত্রিপুরা বা কুমিল্লা) ৫। তা¤্রলিপ্ত (দক্ষিণ পশ্চিম ভাগ) ও ৬। কর্ণ সুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ)। আমাদের টাঙ্গাইল জেলা তৎকালে কামরূপ রাজ্যের বা প্রাগ জ্যোতিষপুর রাজ্যাংশ- যাকে বলা হয় ‘ভাটির মুল্লুক’এর অন্তর্গত ছিলো। মহাভারত কাব্যগ্রন্থের কামরূপ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত বলা হয়েছে।
তাছাড়া পর্যটক ইবনে বতুতার গ্রন্থেও এ এলাকার বর্ণনা পাওয়া যায়। সূত্র: উইকিপিডিয়া