নিউইয়র্ক ১২:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বিদায় কবরী : আমাদের কিংবদন্তি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৫৪:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১
  • / ৪৮ বার পঠিত

ববিতা: কবরী আপা আর নেই- আকস্মিক এ খবরে বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়ার অনুভূতি হলো। এত সপ্রাণ, সজীব-হাসিখুশি কবরী আপা এভাবে কয়েক দিনের অসুখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, এ আমার ভাবনার অতীত ছিল।
গভীর রাতে কানাডা থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের [নায়করাজ রাজ্জাক] ছেলের বউয়ের মাধ্যমে জানতে পারি কবরী আপার মৃত্যুর খবরটি। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো গুজব। পরে যখন টিভি এবং পরিচিত অনেকেই জানালেন কবরী আপা আর নেই- আমি সত্যিকার অর্থেই আমার একান্ত স্বজন হারানোর বেদনা বোধ করি। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মনে পড়ে, কবরী আপার সঙ্গে আমার অজ¯্র স্মৃতি, আনন্দ-বেদনার কয়েক যুগ।
আমি যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি, তখন কবরী আপা সুপারস্টার। সারাদেশের মানুষ তাকে এক নামে চেনেন। আমি চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই কবরী আপা আর রাজ্জাক ভাইয়ের ভক্ত ছিলাম। সিনেমা হলে গিয়ে প্রথম দেখি এই জুটির সাড়াজাগানো ‘ময়নামতি’। এই ছবিতে ময়না চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী আপা। কী অসাধারণ অভিনয়। কী দারুণ দেখতে! আর হাসি! এই ভুবন-ভোলানো হাসি দিয়েই কবরী আপা মুগ্ধ করেছেন দেশের সব মানুষকে।
কবরী ও ববিতা

১৯৬৯ সালে এফডিসিতে ‘শেষ পর্যন্ত’ নামে একটি ছবির কাজ করছিলাম। এ সময় একজন জানাল, পাশের সেটে চলছে কবরী আপার শুটিং। শোনামাত্রই আমি সেখানে ছুটে যাই। দেখি আমার পছন্দের অভিনেত্রীকে। সেই প্রথম কবরী আপার সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে ১৯৭৯ সালে সিরাজুল ইসলামের ‘সোনার হরিণ’ এবং পরে গাজী মাহবুবের পরিচালনায় ‘রাজা সূর্য খাঁ’ ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘রাজা সূর্য খাঁ’ ছবির নির্মাতা গাজী মাহবুব কবরী আপার শিডিউল মেলাতে পারছিলেন না। কারণ, আপা ওই সময় সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া নানা ব্যস্ততাও ছিল তার। আমি তাকে ফোন করে ওই ছবিতে একসঙ্গে অভিনয়ের ইচ্ছার কথা জানালাম। তিনি শিডিউল দিয়ে দিলেন। এফডিসির ৩ নম্বর ফ্লোরে বিশাল সেট পড়ল। টিফিন ক্যারিয়ারে বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। আমি আর কবরী আপা একসঙ্গে মেকআপ রুমে বসে অনেকদিন খাবার খেয়েছি। এক দিন তিনি আমাকে বললেন- ‘ববিতা, তোমাকে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অনেক ভালোবাসে। তারা সরাসরি তোমার অটোগ্রাফ নিতে চায়। কী করি বলো?’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ওদেরকে শুটিংয়ে নিয়ে আসেন। শুটিংও দেখবে আর আমার সঙ্গে কথাও বলতে পারবে।’ আপা আমার কথা শুনে স্মিত হেসে মাথা নাড়ালেন।
কবরী আপার সঙ্গে তাসখন্দ, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে একসঙ্গে গিয়েছি। কয়েক দিন কবরী আপার সঙ্গে এক রুমে ঘুমিয়েছি। রাতে অনেক গল্প করে সুন্দর সময় কেটেছে। এসবই এখন মনে পড়ছে।
রাজ্জাক ভাই যেদিন মারা গেলেন, এফডিসিতে তাকে দেখতে গেলাম। কবরী আপাও এসেছিলেন। সেদিনই কবরী আপার সঙ্গে সেই শেষ দেখা! রাজ্জাক-কবরী আপাকে শেষ দেখার স্মৃতি চোখে এখনও ভাসছে। তাদের কালজয়ী জুটির কথা এ দেশের মানুষ ভুলবে না কোনো দিন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবরী আপা ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আসেন। অভিনয়-জাদুতেও দর্শককে মুগ্ধ করেছেন কয়েক দশক। এ দেশের চার থেকে পাঁচ প্রজন্মের মানুষের প্রিয় নায়িকা তিনি। অভিনয়ে যেমন সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, পরিচালনায়ও ভালো করেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও শুটিং করছিলেন তার পরিচালনায় ‘এই তুমি সেই তুমি’ ছবির। অনেকটা কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন। পরিচালনার পাশাপাশি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন; যেটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের বাঁকে দেশের লাখো কোটি জনতার স্মৃতিতে অল্ফম্নান হয়ে আছেন কবরী, থাকবেন আজীবন। পশ্চিম বাংলায় সুচিত্রা সেন যেমন সবার কাছে দশকের পর দশক প্রিয় নায়িকা হয়ে আছেন, কবরী এ দেশে তাই- থাকবেনও চিরকাল, যত দিন এ দেশের মানুষ সিনেমা দেখবে। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের বাতিঘর।
কবরীর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি তার অসামান্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ভালোবাসার কারণে। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন। একজন প্রকৃত ও গুণী শিল্পী হিসেবে এই নিষ্ঠা তার ছিল। তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কবরী আপার মৃত্যু আমাকে আবার নতুন করে সেই বিস্ময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে- জীবন এত ছোট!
জানতাম, কবরী আপা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম, তার কিছুই হবে না। তিনি করোনা জয় করে আবার সেই ভুবনজয়ী হাসি মুখে নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু সবাইকে তিনি কাঁদিয়ে চলে গেলেন।
মৃত্যুই মানুষের শেষ গন্তব্য- তারপরও বড় অসময়ের মৃত্যু আমাদের কাঁদায় বেশি। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, নতুন নতুন কাজের স্বপ্নে বিভোর কবরী আপার মৃত্যু তাই আমাদের বেশি কাঁদাচ্ছে। কয়েক দশকের গভীর সম্পর্কের একজন- তিনি আবার কবরী আপার মতো কিংবদন্তি- তার সম্পর্কে মৃত্যুর পরপর কিছু বলা কত কঠিন, এখন বুঝতে পারি।
কবরী আপা এ দেশের চলচ্চিত্রের সত্যিকারের কিংবদন্তি- বাংলা চলচ্চিত্রে তার নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে। (দৈনিক সমকাল)
লেখক: লেখিকার পুরো নাম ফরিদা আক্তার ববিতা। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বিদায় কবরী : আমাদের কিংবদন্তি

প্রকাশের সময় : ০৯:৫৪:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ মে ২০২১

ববিতা: কবরী আপা আর নেই- আকস্মিক এ খবরে বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়ার অনুভূতি হলো। এত সপ্রাণ, সজীব-হাসিখুশি কবরী আপা এভাবে কয়েক দিনের অসুখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, এ আমার ভাবনার অতীত ছিল।
গভীর রাতে কানাডা থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের [নায়করাজ রাজ্জাক] ছেলের বউয়ের মাধ্যমে জানতে পারি কবরী আপার মৃত্যুর খবরটি। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো গুজব। পরে যখন টিভি এবং পরিচিত অনেকেই জানালেন কবরী আপা আর নেই- আমি সত্যিকার অর্থেই আমার একান্ত স্বজন হারানোর বেদনা বোধ করি। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মনে পড়ে, কবরী আপার সঙ্গে আমার অজ¯্র স্মৃতি, আনন্দ-বেদনার কয়েক যুগ।
আমি যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি, তখন কবরী আপা সুপারস্টার। সারাদেশের মানুষ তাকে এক নামে চেনেন। আমি চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই কবরী আপা আর রাজ্জাক ভাইয়ের ভক্ত ছিলাম। সিনেমা হলে গিয়ে প্রথম দেখি এই জুটির সাড়াজাগানো ‘ময়নামতি’। এই ছবিতে ময়না চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী আপা। কী অসাধারণ অভিনয়। কী দারুণ দেখতে! আর হাসি! এই ভুবন-ভোলানো হাসি দিয়েই কবরী আপা মুগ্ধ করেছেন দেশের সব মানুষকে।
কবরী ও ববিতা

১৯৬৯ সালে এফডিসিতে ‘শেষ পর্যন্ত’ নামে একটি ছবির কাজ করছিলাম। এ সময় একজন জানাল, পাশের সেটে চলছে কবরী আপার শুটিং। শোনামাত্রই আমি সেখানে ছুটে যাই। দেখি আমার পছন্দের অভিনেত্রীকে। সেই প্রথম কবরী আপার সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে ১৯৭৯ সালে সিরাজুল ইসলামের ‘সোনার হরিণ’ এবং পরে গাজী মাহবুবের পরিচালনায় ‘রাজা সূর্য খাঁ’ ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘রাজা সূর্য খাঁ’ ছবির নির্মাতা গাজী মাহবুব কবরী আপার শিডিউল মেলাতে পারছিলেন না। কারণ, আপা ওই সময় সংসদ সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া নানা ব্যস্ততাও ছিল তার। আমি তাকে ফোন করে ওই ছবিতে একসঙ্গে অভিনয়ের ইচ্ছার কথা জানালাম। তিনি শিডিউল দিয়ে দিলেন। এফডিসির ৩ নম্বর ফ্লোরে বিশাল সেট পড়ল। টিফিন ক্যারিয়ারে বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতাম। আমি আর কবরী আপা একসঙ্গে মেকআপ রুমে বসে অনেকদিন খাবার খেয়েছি। এক দিন তিনি আমাকে বললেন- ‘ববিতা, তোমাকে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অনেক ভালোবাসে। তারা সরাসরি তোমার অটোগ্রাফ নিতে চায়। কী করি বলো?’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ওদেরকে শুটিংয়ে নিয়ে আসেন। শুটিংও দেখবে আর আমার সঙ্গে কথাও বলতে পারবে।’ আপা আমার কথা শুনে স্মিত হেসে মাথা নাড়ালেন।
কবরী আপার সঙ্গে তাসখন্দ, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে একসঙ্গে গিয়েছি। কয়েক দিন কবরী আপার সঙ্গে এক রুমে ঘুমিয়েছি। রাতে অনেক গল্প করে সুন্দর সময় কেটেছে। এসবই এখন মনে পড়ছে।
রাজ্জাক ভাই যেদিন মারা গেলেন, এফডিসিতে তাকে দেখতে গেলাম। কবরী আপাও এসেছিলেন। সেদিনই কবরী আপার সঙ্গে সেই শেষ দেখা! রাজ্জাক-কবরী আপাকে শেষ দেখার স্মৃতি চোখে এখনও ভাসছে। তাদের কালজয়ী জুটির কথা এ দেশের মানুষ ভুলবে না কোনো দিন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবরী আপা ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আসেন। অভিনয়-জাদুতেও দর্শককে মুগ্ধ করেছেন কয়েক দশক। এ দেশের চার থেকে পাঁচ প্রজন্মের মানুষের প্রিয় নায়িকা তিনি। অভিনয়ে যেমন সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, পরিচালনায়ও ভালো করেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও শুটিং করছিলেন তার পরিচালনায় ‘এই তুমি সেই তুমি’ ছবির। অনেকটা কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন। পরিচালনার পাশাপাশি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন; যেটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের বাঁকে দেশের লাখো কোটি জনতার স্মৃতিতে অল্ফম্নান হয়ে আছেন কবরী, থাকবেন আজীবন। পশ্চিম বাংলায় সুচিত্রা সেন যেমন সবার কাছে দশকের পর দশক প্রিয় নায়িকা হয়ে আছেন, কবরী এ দেশে তাই- থাকবেনও চিরকাল, যত দিন এ দেশের মানুষ সিনেমা দেখবে। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের বাতিঘর।
কবরীর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি তার অসামান্য নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ভালোবাসার কারণে। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নিখুঁতভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন। একজন প্রকৃত ও গুণী শিল্পী হিসেবে এই নিষ্ঠা তার ছিল। তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কবরী আপার মৃত্যু আমাকে আবার নতুন করে সেই বিস্ময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে- জীবন এত ছোট!
জানতাম, কবরী আপা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছিলাম, তার কিছুই হবে না। তিনি করোনা জয় করে আবার সেই ভুবনজয়ী হাসি মুখে নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু সবাইকে তিনি কাঁদিয়ে চলে গেলেন।
মৃত্যুই মানুষের শেষ গন্তব্য- তারপরও বড় অসময়ের মৃত্যু আমাদের কাঁদায় বেশি। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর, নতুন নতুন কাজের স্বপ্নে বিভোর কবরী আপার মৃত্যু তাই আমাদের বেশি কাঁদাচ্ছে। কয়েক দশকের গভীর সম্পর্কের একজন- তিনি আবার কবরী আপার মতো কিংবদন্তি- তার সম্পর্কে মৃত্যুর পরপর কিছু বলা কত কঠিন, এখন বুঝতে পারি।
কবরী আপা এ দেশের চলচ্চিত্রের সত্যিকারের কিংবদন্তি- বাংলা চলচ্চিত্রে তার নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে। (দৈনিক সমকাল)
লেখক: লেখিকার পুরো নাম ফরিদা আক্তার ববিতা। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী