অপরাজনীতির ফল পাপুল : বিব্রত রাজনীতিকরা চান ব্যবস্থা

- প্রকাশের সময় : ১২:৩৮:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১
- / ৭৯ বার পঠিত
ঢাকা ডেস্ক: লক্ষীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে চার বছরের সাজা পাওয়ার ঘটনাকে বিব্রতকর ও লজ্জাজনক বলছেন দেশের রাজনীতিকরা। বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, পাপুল বিদেশে বাংলাদেশের সম্মানহানি করেছেন। বিএনপি বলছে, এ ঘটনা ‘বর্তমান সরকারের দুর্নীতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’।
সংসদ সদস্য পাপুলের সাজা হওয়ার ঘটনায় তাঁর নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর উত্থানের পেছনে যাঁদের মদদ রয়েছে তাঁদেরও বিচার হওয়া উচিত। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর একটি ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না সেটা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে।
আওয়ামী লীগ যা বলছে: পাপুলের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন, পাপুলের দন্ডিত হওয়ার বিষয়টি জেনে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিশেষ করে রায়ের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহের ব্যাপারের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এই সার্টিফায়েড কপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাতে পেলে আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই স্পিকারের নজরে আনা হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা পাপুলকে সংসদ সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পক্ষে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেলে তাঁরা পাপুলের সংসদ সদস্য পদের বিষয়টি স্পিকারের নজরে আনবেন। দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান শুক্রবার (২৯ জানুয়ারী) বলেন, ‘তিনি (পাপুল) তাঁর নিজের লাভের জন্য এমন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়েছেন বলে আমি মনে করি। এ জন্য বাংলাদেশের সংসদ বা সংসদ সদস্যরা তাঁর দায় নেবেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কাজী পাপুলের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংবিধানে নির্দেশনা রয়েছে যে যদি কোনো সংসদ সদস্য কোথাও দুই বছরের ওপরে দন্ডিত হন, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। পাপুলের চার বছরের সাজা হওয়ার পর বিষয়টি স্পিকারের নজরে আনতে হবে এবং রায়ের সার্টিফায়েড কপির প্রয়োজন হবে।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, পাপুলের বিরুদ্ধে দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপি যা বলছে: দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই সরকার গত এক দশকের ওপর দুর্নীতি আর লুটপাটে ব্যস্ত। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই আগাগোড়া দুর্নীতিবাজ।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, পাপুলের সাজা হওয়ার ঘটনায় সরকারের টনক না নড়লেও এটি দেশের জন্য লজ্জার। বর্তমান সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পাপুলের মতো সংসদ সদস্যরা বেপরোয়া দুর্নীতি করার সাহস পেতেন না। তাঁর কোনো পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। প্রচুর টাকার কারণে তাঁকে সংসদ সদস্য করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রীকেও সংসদ সদস্য করা হয়েছে। এভাবে বিরাজনৈতিকীকরণ, রাজনীতিকে একটা নষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে তারা।
রিজভী বলেন, পাপুলের স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার বিরুদ্ধেও শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকারের নির্দেশে নিম্ন আদালতেই তাঁদের জামিন দেওয়া হয়েছে। এতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারের ভূমিকা জাতির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
অন্যান্য রাজনীতিক যা বলছেন: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে লুটপাটের রাজত্ব চলছে। পাপুলের ঘটনা অজ¯্র লুটপাটের ঘটনার ছোট্ট একটি চিত্র। এ ক্ষেত্রে সমুদ্রের মধ্যে ভাসতে থাকা বরফের মতো সমাজের অভ্যন্তরে সীমাহীন লুটপাটের সামান্যই প্রকাশ পেয়েছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লুটপাটতন্ত্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
সাজাপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য পাপুলের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা উচিত ছিল। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও সরকার নিশ্চুপ। এতে পুরো দেশটাকেই হাস্যকর করা হলো।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘বিষয়টি লজ্জাজনক, নিন্দনীয়। যেভাবেই হোক তার গায়ে সংসদ সদস্যর লেবেল লেগেছে। তবে সে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। আদম পাচার করে অর্থ কামিয়েছে, টাকা দিয়ে এমপি হয়েছে। টাকা দিয়ে বউকেও এমপি বানিয়েছে। বলা যায় এমপি বাই চান্স। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল, আমাদের প্রার্থী নির্বাচন না করায় চান্স পেয়ে গেছে।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও গণফোরামের সাবেক কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের জ্বলন্ত উদাহরণ। উন্নয়নের আওয়াজে দুর্নীতিও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব লোক ও তাদের স্ত্রীকেও যে আমরা সংসদে বসার সুযোগ দিচ্ছি, সে কারণে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ একটি কঠিন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’
টিআইবির প্রতিক্রিয়া: দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে জাতীয় সংসদে সরকারিভাবে তো অবশ্যই, রাষ্ট্রীয়ভাবেও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে যারা জড়িত তারা দেশের বাইরে চিহ্নিত হওয়ার আগে দেশের ভেতরেই চিহ্নিত হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৬ জুন কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পাপুলকে কুয়েত সিটির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে মানবপাচার ও অর্থপাচারের পাশাপাশি ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। তিনি কুয়েতে মারাফি কুয়েতিয়া গ্রæপ অব কম্পানিজ নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। মানবপাচার ও ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কুয়েতের ফৌজদারি আদালত গত বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারী) তাকে এবং কুয়েতের তিন কর্মকর্তাকে চার বছর কারাদন্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া তাদের প্রত্যেককে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার জরিমানা করা হয়েছে।
সংসদ সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন: সাজা হওয়ায় পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কুয়েতের আদালতে দেওয়া রায়ের কপি আনার চেষ্টা চলছে। রায়ের কপি পেলেই তা দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুক্রবার (২৯ জানুয়ারী) তিনি একটি টেলিভিশনকে এ কথা বলেন।
তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, সংসদ সদস্য পাপুলের কারাদন্ডের খবর সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে। এটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে তিনি ফৌজদারি অপরাধে চার বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কুয়েতের কারাগারে বন্দি। সুতরাং তিনি আর সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারেন না। এখন প্রক্রিয়া অনুযায়ী তার আসন শূন্য ঘোষণা করা যাবে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের সাজা হলেই তার (পাপুল) সদস্য পদ চলে যাওয়ার কথা।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ)