নিউইয়র্ক ১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আমার দেখা স্বাধীনতা যুদ্ধ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১৬:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ১৭৯ বার পঠিত

মাহবুবা বেগম: ১৯৬৯ সাল সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছি, বিয়ে হয়ে গেলো এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। ৭০-এর নভেম্বরে কোল জুড়ে এলো এক কন্যা সন্তান, ভালোই কাটছিল দিনকাল। হঠাৎ করে পাকিস্তানীদের বিশ^াস ঘাতকতায় জেগে উঠলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, নির্বাচনে শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও হতে পারলেন না পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানীরা শুরু করল নানা রকম টাল বাহানা। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাস্তায় নেমে শুরু করলো আন্দোলন। হরতাল, বিক্ষোভ, অবরোধ, মিছিল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হলো পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস। তখন চলছিল মার্চ মাস। একদিন সন্ধ্যায় বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলাম। সম্ভবত সেদিন ছিল ২৩ মার্চ, বাবা বললেন- আজ আর যাওয়ার দরকার নেই, শুনতেছি গন্ডগোল লাগবে। বাবার পাশের ফ্লাটটি খালি ছিল। সেই ঘরেই আমাদের দু’জনের রাতে থাকার ব্যবস্থ্া হলো। ছোট মেয়েটিকে নিয়ে সেখানে রাত কাটাবো এটাই হলো আয়োজন। সে রাত ছিল ২৫ মার্চের কালোরাত, রাত ১২টার পর পুলিশ লাইন থেকে গোলাগুলি শুরু হলো। পুলিশরা গুলি ছুড়ছে আর বিহারীরা পাল্টা গুলি ছুড়ছে। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ভয়ে বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে ছিলাম। সকালে সবাই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, খুজতে লাগলো বিহারীদের। যেখানে যে বিহারী পেল মারধর করলো। লালখান বাজারে একজনকে মেরেই ফেলল, আরেক জনকে আহত করলো। উদিত হলো ২৬ মার্চের সূর্য। মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার।
শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ, হাজার হাজার মানুষ ভারতে পালিয়ে গেল। আমরা সবাই আমাদের একটি ভাড়া ঘরে আশ্রয় নিলাম। আমার চাচা, ফফুু, আমি এবং বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই মিলে আমরা ২৫জন মানুষ। যেসব লোকজন ভারতে যেতে পারেনি, তারা গ্রামে চলে গেল, আমার বাবা বললেন- এত লোক নিয়ে আমি কিভাবে গ্রামে যাব, আমার এই মহান পরোপকারী বাবা একা একা গ্রামে গিয়ে আতœগোপন করতে রাজী হলেন না। ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন সকলের মায়ায় লালখান বাজার ছেড়ে গেলেন না। নিজ ঘরেই থেকে গেলেন, লালখান বাজার বাঙালী শূন্য হয়ে পড়ল। যে কয়জন ছিল তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগলো। সারা এলাকা জুড়ে বিহারীদের তান্ডব, লুটপাট, মারামারি করেই চলছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যুবক বিহারীরা নানা রকম পরিকল্পনা করতো, কখন কার ঘরে হামলা করা যায়। আর আমরা ঘরে বসে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম আর আল্লাহর জিকির করতে থাকতাম। আমাদের বিশ^াস ছিল একদিন আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে স্বাধীনতা দেবেন। একদিকে বিহারীদের অত্যাচার, অপরদিকে পাকিস্তানী সেনাদের, সেনারা বাঙালীদের ঘরে ঢুকে ঢুকে তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ফেলত। এলাকায় আগুন দিয়ে যত কাঁচাঘর ছিল সব পুড়িয়ে দিল। আমার সাজানো সংসার ওরা পুড়িয়ে দিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিল। আমার বিয়ের সব আসবাবপত্র পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেল। বাজার-ঘাট সবই বিহারীদের দখলে, দোকানপাট বেশির ভাগ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যে দু’চারটা দোকান খোলা থাকতো তাও বিহারীদের দখলে। কেউ বাজারে যেতো না। তখন আমরা পোড়া ভটিায় যে সমস্ত কাটাশাক উঠতো সগেুলো খয়েে জীবন বাঁচয়িছে,ি পানি নেই,তায়াম্মুম করে অজু গোসল করতে হয়েছে, অনেক সময় বিজলী থাকতো নাা, বø্যাক আউট চলতো, রাস্তাঘাট নিরব থাকতো। হটাৎ হঠাৎ বিহারীদের দল এসে লুটপাত করতো। আমি আর আমার এক চাচাতো বোন যুবতী ছিলাম, আমরা ভয়ে থাকতাম, পরিবারের সবাই আমাদের জন্য চিন্তিত থাকতো, আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে আমরা নির্যাতন থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।
শুরু হল এপ্রিল মাস। আমাদের জন্য মহা দুঃখের সময়। সারা লালখান বাজার ধরে শুরু হলো হত্যা যজ্ঞ। আজ একে ধরে নিয়ে যায় কাল ওকে। এভাবে চলতে লাগলো। মনজু মিয়ার কলোনী থেকে একই দিনে ১৭জনকে ধরে নিয়ে গেলো। বেশীরভাগকে হত্যা করল। মনজু মিয়ার কলোনীর নাম হল বিধবা পাড়া। এই এপ্রিলের ১৬ তারিখ আমাদের উপর এলো চরম বিপদ। বেবীট্যাস্কি নিয়ে এলো তিনজন পাকিস্তানী সেনা। আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। শুরু হলো আমাদের দু:খ। যদিও যুদ্ধ লাগার পর থেকে আমরা ছিলাম ব্যথিত, এখন দুঃখটা হলো ভিষণ। একটা পরিবারে যখন বাবা না থাকে, তখন সেই পরিবারের অবস্থা পাঠকরা সহজেই অনুমান করতে পারেন। বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাকে তারা হত্যা করলো (ইন্নালিল্লাহ…………..রাজিউন)। আমার বাবা শহীদ হলেন। যারা ইসলামী যুদ্ধে মারা যায় তারা শহীদ। আর যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় তারাও শহীদ। আমার বাবার কোনো দোষ ছিলনা, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাই, তিনি তো শহীদ। ঘটনা তো এখানেই শেষ নয়। এবার শুরু হয় পাকিস্তানী সেনাদের আমাদের ঘওে আনা-গোনা উদ্দেশ্য টাকা, কখনও ৪জন, কখনও ২জন, কখনও একজন, বার বার আসতে থাকে। আমার বাবার মুক্তিপণ দাবি করে, এভাবে অনেক টাকা নেওয়ার পর এক পর্যায়ে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমার বাবার সন্তানদের মধ্যে আমি সবার বড়, সেই জন্য ভয়ভীতিকে পায়ে ঠেলে, পাক সেনার মুখোমুখি হলাম। বললাম, তোমরা আর কত টাকা চাও? আমার বাবা তো আসছেন না, কবে আসবেন? অথচ ওরা আমার বাবাকে ধরে নেওয়ার সাথে সাথে হত্যা করে, সেদিন থেকে পাক সেনারা আমাদের ঘরে আসা বন্ধ করল, আল্লাহ-তায়ালার উপরে অনুগ্রহ পাক সেনারা আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি, ওরা শুধু আমাদের টাকাই চেয়েছিলো।
৭১-এর দুঃখ আর কত বললো। সামনের দরজা দিয়ে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল আর পিছনের দরজা দিয়ে আমার স্বামী পালিয়ে গেলেন।
পাঠক চিন্তা করুন। আমাদের অবস্থা কি? বাবাকে ধরে নিয়ে গেল স্বামী পালিয়ে গেলেন, ছোট ছোট ভাইবোন তখন আমার। এক হতাশার সমুদ্রে ভাসছিলাম। সপ্তাহ খানেক পর আমার স্বামী একজনের কাছে একটা দুধের কৌটা আর একটা চিরকুট পাঠালেন, তিনি বেঁচে আছেন, আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করলাম।
আলাউদ্দিন নামের এক বিহারীকে বাঙালিরা আহত করেছিলো, সবাই বলছিলো তাদের সহযোগীতায় পাক সেনারা আমার বাবাকে হত্যা করেছিল।
এরপর দীর্ঘ নয় মাস পর্যন্ত চলতে লাগলো বিহারী ও পাক সেনাদের যৌথ অত্যাচার। এরই মধ্যে আমরা কোন রকম বেঁচে থাকলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা সুরক্ষিত ছিলাম। মানুষদের ঘর-বাড়ি পোড়ালো, দোকানপাট লুট করলো, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি খেয়ে উজাড় করলো। কথায় বলে দুঃখের রাত পোহায় না।
যাক সে দুঃখের অবসান হলো। এলো ডিসেম্বর মাস, ১৬ ডিসেম্বর বাংলা শত্রæমুক্ত হলো, উদিত হলো স্বাধীন সূর্য। দিকে দিকে ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে মুখরিত হলো। আমরা স্বাধীন হলাম, সুখের নি:শ্বাস ছাড়লাম। আজকের বিজয় দিবসে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধদের।
চিরজীবি হউক আমাদের মাতৃভূমি।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আমার দেখা স্বাধীনতা যুদ্ধ

প্রকাশের সময় : ০৮:১৬:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

মাহবুবা বেগম: ১৯৬৯ সাল সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছি, বিয়ে হয়ে গেলো এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। ৭০-এর নভেম্বরে কোল জুড়ে এলো এক কন্যা সন্তান, ভালোই কাটছিল দিনকাল। হঠাৎ করে পাকিস্তানীদের বিশ^াস ঘাতকতায় জেগে উঠলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, নির্বাচনে শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও হতে পারলেন না পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানীরা শুরু করল নানা রকম টাল বাহানা। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাস্তায় নেমে শুরু করলো আন্দোলন। হরতাল, বিক্ষোভ, অবরোধ, মিছিল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হলো পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ-বাতাস। তখন চলছিল মার্চ মাস। একদিন সন্ধ্যায় বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলাম। সম্ভবত সেদিন ছিল ২৩ মার্চ, বাবা বললেন- আজ আর যাওয়ার দরকার নেই, শুনতেছি গন্ডগোল লাগবে। বাবার পাশের ফ্লাটটি খালি ছিল। সেই ঘরেই আমাদের দু’জনের রাতে থাকার ব্যবস্থ্া হলো। ছোট মেয়েটিকে নিয়ে সেখানে রাত কাটাবো এটাই হলো আয়োজন। সে রাত ছিল ২৫ মার্চের কালোরাত, রাত ১২টার পর পুলিশ লাইন থেকে গোলাগুলি শুরু হলো। পুলিশরা গুলি ছুড়ছে আর বিহারীরা পাল্টা গুলি ছুড়ছে। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ভয়ে বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে ছিলাম। সকালে সবাই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, খুজতে লাগলো বিহারীদের। যেখানে যে বিহারী পেল মারধর করলো। লালখান বাজারে একজনকে মেরেই ফেলল, আরেক জনকে আহত করলো। উদিত হলো ২৬ মার্চের সূর্য। মেজর জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার।
শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ, হাজার হাজার মানুষ ভারতে পালিয়ে গেল। আমরা সবাই আমাদের একটি ভাড়া ঘরে আশ্রয় নিলাম। আমার চাচা, ফফুু, আমি এবং বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই মিলে আমরা ২৫জন মানুষ। যেসব লোকজন ভারতে যেতে পারেনি, তারা গ্রামে চলে গেল, আমার বাবা বললেন- এত লোক নিয়ে আমি কিভাবে গ্রামে যাব, আমার এই মহান পরোপকারী বাবা একা একা গ্রামে গিয়ে আতœগোপন করতে রাজী হলেন না। ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন সকলের মায়ায় লালখান বাজার ছেড়ে গেলেন না। নিজ ঘরেই থেকে গেলেন, লালখান বাজার বাঙালী শূন্য হয়ে পড়ল। যে কয়জন ছিল তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগলো। সারা এলাকা জুড়ে বিহারীদের তান্ডব, লুটপাট, মারামারি করেই চলছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যুবক বিহারীরা নানা রকম পরিকল্পনা করতো, কখন কার ঘরে হামলা করা যায়। আর আমরা ঘরে বসে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম আর আল্লাহর জিকির করতে থাকতাম। আমাদের বিশ^াস ছিল একদিন আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকে স্বাধীনতা দেবেন। একদিকে বিহারীদের অত্যাচার, অপরদিকে পাকিস্তানী সেনাদের, সেনারা বাঙালীদের ঘরে ঢুকে ঢুকে তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ফেলত। এলাকায় আগুন দিয়ে যত কাঁচাঘর ছিল সব পুড়িয়ে দিল। আমার সাজানো সংসার ওরা পুড়িয়ে দিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিল। আমার বিয়ের সব আসবাবপত্র পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেল। বাজার-ঘাট সবই বিহারীদের দখলে, দোকানপাট বেশির ভাগ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যে দু’চারটা দোকান খোলা থাকতো তাও বিহারীদের দখলে। কেউ বাজারে যেতো না। তখন আমরা পোড়া ভটিায় যে সমস্ত কাটাশাক উঠতো সগেুলো খয়েে জীবন বাঁচয়িছে,ি পানি নেই,তায়াম্মুম করে অজু গোসল করতে হয়েছে, অনেক সময় বিজলী থাকতো নাা, বø্যাক আউট চলতো, রাস্তাঘাট নিরব থাকতো। হটাৎ হঠাৎ বিহারীদের দল এসে লুটপাত করতো। আমি আর আমার এক চাচাতো বোন যুবতী ছিলাম, আমরা ভয়ে থাকতাম, পরিবারের সবাই আমাদের জন্য চিন্তিত থাকতো, আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে আমরা নির্যাতন থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।
শুরু হল এপ্রিল মাস। আমাদের জন্য মহা দুঃখের সময়। সারা লালখান বাজার ধরে শুরু হলো হত্যা যজ্ঞ। আজ একে ধরে নিয়ে যায় কাল ওকে। এভাবে চলতে লাগলো। মনজু মিয়ার কলোনী থেকে একই দিনে ১৭জনকে ধরে নিয়ে গেলো। বেশীরভাগকে হত্যা করল। মনজু মিয়ার কলোনীর নাম হল বিধবা পাড়া। এই এপ্রিলের ১৬ তারিখ আমাদের উপর এলো চরম বিপদ। বেবীট্যাস্কি নিয়ে এলো তিনজন পাকিস্তানী সেনা। আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। শুরু হলো আমাদের দু:খ। যদিও যুদ্ধ লাগার পর থেকে আমরা ছিলাম ব্যথিত, এখন দুঃখটা হলো ভিষণ। একটা পরিবারে যখন বাবা না থাকে, তখন সেই পরিবারের অবস্থা পাঠকরা সহজেই অনুমান করতে পারেন। বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাকে তারা হত্যা করলো (ইন্নালিল্লাহ…………..রাজিউন)। আমার বাবা শহীদ হলেন। যারা ইসলামী যুদ্ধে মারা যায় তারা শহীদ। আর যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় তারাও শহীদ। আমার বাবার কোনো দোষ ছিলনা, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাই, তিনি তো শহীদ। ঘটনা তো এখানেই শেষ নয়। এবার শুরু হয় পাকিস্তানী সেনাদের আমাদের ঘওে আনা-গোনা উদ্দেশ্য টাকা, কখনও ৪জন, কখনও ২জন, কখনও একজন, বার বার আসতে থাকে। আমার বাবার মুক্তিপণ দাবি করে, এভাবে অনেক টাকা নেওয়ার পর এক পর্যায়ে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমার বাবার সন্তানদের মধ্যে আমি সবার বড়, সেই জন্য ভয়ভীতিকে পায়ে ঠেলে, পাক সেনার মুখোমুখি হলাম। বললাম, তোমরা আর কত টাকা চাও? আমার বাবা তো আসছেন না, কবে আসবেন? অথচ ওরা আমার বাবাকে ধরে নেওয়ার সাথে সাথে হত্যা করে, সেদিন থেকে পাক সেনারা আমাদের ঘরে আসা বন্ধ করল, আল্লাহ-তায়ালার উপরে অনুগ্রহ পাক সেনারা আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি, ওরা শুধু আমাদের টাকাই চেয়েছিলো।
৭১-এর দুঃখ আর কত বললো। সামনের দরজা দিয়ে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল আর পিছনের দরজা দিয়ে আমার স্বামী পালিয়ে গেলেন।
পাঠক চিন্তা করুন। আমাদের অবস্থা কি? বাবাকে ধরে নিয়ে গেল স্বামী পালিয়ে গেলেন, ছোট ছোট ভাইবোন তখন আমার। এক হতাশার সমুদ্রে ভাসছিলাম। সপ্তাহ খানেক পর আমার স্বামী একজনের কাছে একটা দুধের কৌটা আর একটা চিরকুট পাঠালেন, তিনি বেঁচে আছেন, আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করলাম।
আলাউদ্দিন নামের এক বিহারীকে বাঙালিরা আহত করেছিলো, সবাই বলছিলো তাদের সহযোগীতায় পাক সেনারা আমার বাবাকে হত্যা করেছিল।
এরপর দীর্ঘ নয় মাস পর্যন্ত চলতে লাগলো বিহারী ও পাক সেনাদের যৌথ অত্যাচার। এরই মধ্যে আমরা কোন রকম বেঁচে থাকলাম। আল্লাহর রহমতে আমরা সুরক্ষিত ছিলাম। মানুষদের ঘর-বাড়ি পোড়ালো, দোকানপাট লুট করলো, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি খেয়ে উজাড় করলো। কথায় বলে দুঃখের রাত পোহায় না।
যাক সে দুঃখের অবসান হলো। এলো ডিসেম্বর মাস, ১৬ ডিসেম্বর বাংলা শত্রæমুক্ত হলো, উদিত হলো স্বাধীন সূর্য। দিকে দিকে ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে মুখরিত হলো। আমরা স্বাধীন হলাম, সুখের নি:শ্বাস ছাড়লাম। আজকের বিজয় দিবসে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধদের।
চিরজীবি হউক আমাদের মাতৃভূমি।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।