নিউইয়র্ক ০৭:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আজ মওলানা ভাসানীর জন্মবার্ষিকী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:০৬:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ২৫৩ বার পঠিত

হককথা রিপোর্ট: আজ ১২ ডিসেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র ১৪০তম জন্মবার্ষিকী। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইতিহাসের এক কিংবদন্তির মহানায়ক। মওলানা ভাসানীর পাসপোর্ট অনুসারে তার জন্ম ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অভিপ্রায়ে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে মজলুম এ জননেতার জন্মদিবস পালন করা হয়। তখন তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সাইন্সেস-এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে। পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। পিতামহের নাম হাজী কেরামত আলী খান। তার পিতা ও পিতামহের নামের আগে হাজী থেকেই বোঝা যায়, সেই সময়কালে তারা উচ্চ–মধ্যবিত্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানীর শ্বশুর ছিলেন জয়পুরহাটের বীরনগর এলাকার জমিদার শাকির উদ্দিন চৌধুরী। শৈশবে পিতা–মাতাকে হারিয়ে বড় চাচা হাজী ইব্রাহিম আলীর কাছে প্রতিপালিত হন তিনি। মাদরাসা শিক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু করেন শিক্ষাজীবন।
মওলানা ভাসানী শুরু থেকেই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতনবিরোধী জনমানুষের নেতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, অবহেলিত মানুষকে রক্ষা ও মানবতার সেবা করার নামই রাজনীতি। মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর খেলাফত আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। আসামে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ভাষানচর নামক স্থানে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সম্মেলন আহবান করেন। সেখানেই তাকে ভাসানী উপাধি প্রদান করা হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসাম ও বাংলায় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তিনি। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং ১৯৩১ সালে মাওলানা শওকত আলী ইন্তেকাল করলে মওলানা ভাসানী ১৯৩৫ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে বসবাস শুরু করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীই প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ভাসানী নিজে ওই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। সহ-সভাপতি মনোনীত হন আতাউর রহমান খান ও আব্দুস সালাম খান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ হন যুগ্ম সম্পাদক। এভাবেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী দলের গোড়াপত্তন করেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন তিনি। সেই সময় শাসকগোষ্ঠী মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হককে বিনা কারণে বার বার গ্রেফতার ও জেল-হাজতে নিক্ষেপ করে। মজলুম জননেতা ওই সময় ইউরোপ সফর করেন এবং বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিপীড়িত জনগণ ও দেশগুলোর স্বাধীনতার জন্য মতবিনিময় করেন।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ’৫৪ সালের নির্বাচনে নূরুল আমিনসহ মুসলিম লীগের বড় বড় নেতারা পরাজিত হন। মাত্র ৯টি আসন পায় মুসলিম লীগ। ফজলুল কাদের চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মুসলিম লীগে যোগদান করে ১০ জন সাংসদ নিয়ে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে মওলানা ভাসানীর দাবির (প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন) প্রতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্ণপাত না করায় এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করার প্রতিবাদে তিনি ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন আহ্বান করেন। মজলুম জননেতা সেই সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে বলেন, তোমরা ভালো থাকো, আমাদেরও নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে দাও। এর মাত্র চার মাস পরে নিজ প্রতিষ্ঠিত দল ত্যাগ করে তিনি গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে থেকে যান নবাবজাদা নাসিরউল্লাহ খান, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আব্দুস সালাম খান, তাজউদ্দীন আহমদ ও মিসেস আমেনা বেগমরা। আর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকেন সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান, সিন্ধু প্রদেশের জিয়েসিন্দ, পাঞ্জাবের মিসেস কানিজ ফাতেমা, অলি আহাদ, মাহমুদ আলী, হাজী মো. দানেশ, আব্দুস সামাদ আজাদ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মো. তোহা ও আব্দুল মতিনরা। মওলানা ভাসানী পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের দাবি তোলেন। অন্যদিকে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরা বলেন, আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইতোমধ্যেই ৯৫ শতাংশ স্বায়ত্ত শাসন অর্জিত হয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিকভাবে থেকে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। কিন্তু তার অন্তরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েই গেল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এখানে উল্লেখ করতে হয় বেগম মুজিবের ভূমিকার কথা। তিনি রাজনীতিতে কোনো দিনই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেননি। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে বঙ্গবন্ধুর হয়ে আজীবন সমস্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মরহুম কাজী জাফর আহমদের বক্তব্য অনুসারে, ১৯৭৩ সালে তিনি ন্যাপের মহাসচিব মনোনীত হন। সেই বছর পবিত্র ঈদ উপলক্ষে পার্টির চেয়ারম্যান মওলানা ভাসানীর জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি কেনেন এবং সেটা তাকে উপহার দেন। মওলানা ভাসানী তখন বলেন, কামালের মা (বেগম মুজিব) প্রতি বছর তাকে ঈদের জামা–কাপড় দেন এবং সেই জামা-কাপড় পরেই তিনি ঈদের নামাজ আদায় করেন। সুদীর্ঘ দিন এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এ থেকে বুঝতে হবে, ভাসানী-মুজিব সম্পর্কের গভীরতা। ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র যখন পাকাপোক্ত, তখন মোনাজাতের নামে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেন মওলানা ভাসানী। লক্ষ লক্ষ ছাত্র–জনতা যুক্ত হলেন তার মোনাজাতে। আওয়াজ উঠলো-জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।
মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে সমগ্র বাঙালী জাতিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন। ইতিহাসে একমাত্র পন্ডিত মতিলাল নেহেরু কৌশলে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নিজ পুত্র পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্য। আর মওলানা ভাসানী পথ ছেড়ে দিয়েছিলেন পুত্রতুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবসুও আপনাকে ভালোবাসেন। এরপরেও আপনি ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ভারত একটি আধিপত্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে সম্প্রসারণবাদী হিসেবে। হায়দরাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করে তারা ভারতের মানচিত্র সম্প্রসারিত করেছে। শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন্তু সেজন্য কাশ্মীর অধিগ্রহণ থেমে থাকেনি। সিকিমকেও অধিগ্রহণ করেছে ভারত। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন জাতীয়তাবাদী নেতার কারণেই বাংলাদেশকে অধিগ্রহণ করতে পারেনি ভারত। মওলানা ভাসানী আরো বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সমস্ত দেশে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করেছিল, তাদের সেনাবাহিনী আজও সেই সকল দেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কারণেই মূলত বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ভারত। কিন্তু ভারতের একটি প্রশাসনিক মহল তা মেনে নিতে পারেনি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৫৭ দিনের মাথায় ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই বছরের ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মোশতাক সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়। এরপর ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন শহীদ জিয়াউর রহমান।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ পর্যন্ত এক ঐতিহাসিক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। দেশবাসী এই মিছিলকে ফারাক্কা লংমার্চ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ এক চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়। বাকশাল ও সামরিক শাসনের ফলে রাজনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সীমান্ত অস্থির হয়ে পড়ে। সর্বোপরি ফারাক্কার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তর জনপদ মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় মওলানা ভাসানী ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে এক ঐতিহাসিক লংমার্চ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু মজলুম জননেতা সেই সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সময়টা সম্ভবত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব আমাকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য নিয়ে যান। হুজুর পূর্বেই আমাকে চিনতেন। হুজুর আমাকে লংমার্চের ধারণা প্রদান করেন এবং তার সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান। আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে ফারাক্কা লংমার্চের সাংগঠনিক কাজ শুরু করি। মওলানা ভাসানী এই ফারাক্কা লংমার্চ পরিচালনা কমিটির আহবায়ক মনোনীত হন। ন্যাপ ভাসানী, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), হাজী দানেশ ও সিরাজুল হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন জাগমুই এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টি-এই পাঁচটি দল থেকে দু’জন করে সদস্য নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। বাইরে থেকে মাত্র দু’জনকে এই পরিচালনা পর্ষদে মনোনয়ন প্রদান করেন মওলানা ভাসানী। একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান এবং অন্যজন শেখ শওকত হোসেন নিলু।
১৯৭৬ সালের ১৫ মে সকাল ১০ ঘটিকায় মওলানা ভাসানীর মাদরাসা ময়দানে উপস্থিত হওয়ার কথা। ১৪ মে সন্ধ্যার মধ্যেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের নেতাকর্মীরা দলে দলে এসে উপস্থিত হতে থাকেন রাজশাহীতে। চট্টগ্রাম থেকে ব্যারিস্টার সলিমুল্লাহ খান মিলকী, বরিশাল থেকে শ্রী সুনীলগুপ্ত ও সিরাজুল হক, খুলনা থেকে গাজী শহিদুল্লাহ, ফরিদপুর থেকে ব্যারিস্টার কামরুল ইসলাম সালাউদ্দিন, যশোর থেকে তরিকুল ইসলাম এবং ঢাকা থেকে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত হন রাজশাহীতে। এছাড়া মশিউর রহমান যাদু মিয়া, এস এ বারী এটি, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, হায়দার আকবর খান রনো ও মাওলানা আব্দুল মতিনরা ১৪ মে’র মধ্যেই রাজশাহীতে উপস্থিত হন।
১৫ মে সকাল ১০টার মধ্যেই মাদরাসা ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মওলানা ভাসানী একটি খোলা জিপে করে আবু নাসের খান ভাসানী, এমরান আলী সরকার ও গাজী শহিদ উল্লাহকে নিয়ে ১০টা বাজার ৫ মিনিট আগে মাদরাসা ময়দানে উপস্থিত হন। লক্ষ কণ্ঠে আওয়াজ ওঠে- ‘যুগ যুগ জিও তুমি মওলানা ভাসানী; সিকিম নয় ভুটান নয় এদেশ আমার বাংলাদেশ’। জনসভায় একমাত্র বক্তা মওলানা ভাসানী। দোয়া পরিচালনা করেন লেবার পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মতিন। এরপর ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা ইন্তেকাল করেন। সুতরাং ১৫ মে’র মাদরাসা ময়দানের জনসভাই তার জীবনের শেষ জনসভা ও ভাষণ। এক ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি তার ভাষণ দেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে একজন লোকও নড়াচড়া করেননি। জনসভা ছিল নিস্তব্ধ। মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভারত একতরফাভাবে ভাটির দেশের জনগণের পানি কেড়ে নিয়ে এই অঞ্চলে এক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, হাজার বছরের এই অঞ্চলে মাটি-পানি এবং কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতীদের সমন্বিত শ্রমের মধ্য দিয়ে এক সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। সেই পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের উপরে এক মরণযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ভারত। এই ফারাক্কা বাঁধের ফলে ১০ লক্ষ জেলে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রের মধ্যে পলি পড়ে বাংলাদেশের যে নতুন ভূখন্ড জেগে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ভারতের শাসকরা বাংলাদেশের বন্ধু জনগণকে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না, ধ্বংস করতে পারে না সভ্য জনসমাজকে।
বেলা ১১টায় রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয় লক্ষ লোকের গণমিছিল। মওলানা ভাসানী একখানা খোলা জিপে করে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলের নেতাকর্মীদের আপ্যায়নের জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, নারী-পুরুষ, ছাত্র-কৃষক সকলেই ছুটে আসে কাঁচা আম, মুড়ি, পানি ও লেবুর শরবত নিয়ে। এভাবেই গড়ে ওঠে এক ঐতিহাসিক গণজাগরণ। আমরা বিকেল ৫টার মধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে যাই। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে সেখানে এক ঐতিহাসিক মশাল মিছিল বের হয়। শেখ শুকত হোসেন নীলু, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুর রাজ্জাক সরকার ছাড়াও এসকেন্দার আলী ও রাজশাহীর মিলন এই মশাল মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মশালের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পরদিন ১৬ মে সকাল ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদ অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষ ফারাক্কা বাঁধের দুই মাইল ভাটিতে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। এরপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
জাতীয় জীবনে জাতীয় ঐক্যের বুনিয়াদ সৃষ্টি হয় এই ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের পানির ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় মজলুম জননেতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আজ মওলানা ভাসানীর জন্মবার্ষিকী

প্রকাশের সময় : ১১:০৬:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২০

হককথা রিপোর্ট: আজ ১২ ডিসেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র ১৪০তম জন্মবার্ষিকী। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইতিহাসের এক কিংবদন্তির মহানায়ক। মওলানা ভাসানীর পাসপোর্ট অনুসারে তার জন্ম ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অভিপ্রায়ে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে মজলুম এ জননেতার জন্মদিবস পালন করা হয়। তখন তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সাইন্সেস-এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার জন্মস্থান সিরাজগঞ্জে। পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। পিতামহের নাম হাজী কেরামত আলী খান। তার পিতা ও পিতামহের নামের আগে হাজী থেকেই বোঝা যায়, সেই সময়কালে তারা উচ্চ–মধ্যবিত্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানীর শ্বশুর ছিলেন জয়পুরহাটের বীরনগর এলাকার জমিদার শাকির উদ্দিন চৌধুরী। শৈশবে পিতা–মাতাকে হারিয়ে বড় চাচা হাজী ইব্রাহিম আলীর কাছে প্রতিপালিত হন তিনি। মাদরাসা শিক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু করেন শিক্ষাজীবন।
মওলানা ভাসানী শুরু থেকেই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতনবিরোধী জনমানুষের নেতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, অবহেলিত মানুষকে রক্ষা ও মানবতার সেবা করার নামই রাজনীতি। মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর খেলাফত আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। আসামে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ভাষানচর নামক স্থানে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সম্মেলন আহবান করেন। সেখানেই তাকে ভাসানী উপাধি প্রদান করা হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসাম ও বাংলায় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তিনি। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং ১৯৩১ সালে মাওলানা শওকত আলী ইন্তেকাল করলে মওলানা ভাসানী ১৯৩৫ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে বসবাস শুরু করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীই প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ভাসানী নিজে ওই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। সহ-সভাপতি মনোনীত হন আতাউর রহমান খান ও আব্দুস সালাম খান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ হন যুগ্ম সম্পাদক। এভাবেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী দলের গোড়াপত্তন করেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন তিনি। সেই সময় শাসকগোষ্ঠী মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হককে বিনা কারণে বার বার গ্রেফতার ও জেল-হাজতে নিক্ষেপ করে। মজলুম জননেতা ওই সময় ইউরোপ সফর করেন এবং বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিপীড়িত জনগণ ও দেশগুলোর স্বাধীনতার জন্য মতবিনিময় করেন।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ’৫৪ সালের নির্বাচনে নূরুল আমিনসহ মুসলিম লীগের বড় বড় নেতারা পরাজিত হন। মাত্র ৯টি আসন পায় মুসলিম লীগ। ফজলুল কাদের চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মুসলিম লীগে যোগদান করে ১০ জন সাংসদ নিয়ে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে মওলানা ভাসানীর দাবির (প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন) প্রতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্ণপাত না করায় এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করার প্রতিবাদে তিনি ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন আহ্বান করেন। মজলুম জননেতা সেই সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে বলেন, তোমরা ভালো থাকো, আমাদেরও নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে দাও। এর মাত্র চার মাস পরে নিজ প্রতিষ্ঠিত দল ত্যাগ করে তিনি গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে থেকে যান নবাবজাদা নাসিরউল্লাহ খান, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আব্দুস সালাম খান, তাজউদ্দীন আহমদ ও মিসেস আমেনা বেগমরা। আর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকেন সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান, সিন্ধু প্রদেশের জিয়েসিন্দ, পাঞ্জাবের মিসেস কানিজ ফাতেমা, অলি আহাদ, মাহমুদ আলী, হাজী মো. দানেশ, আব্দুস সামাদ আজাদ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মো. তোহা ও আব্দুল মতিনরা। মওলানা ভাসানী পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের দাবি তোলেন। অন্যদিকে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরা বলেন, আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইতোমধ্যেই ৯৫ শতাংশ স্বায়ত্ত শাসন অর্জিত হয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিকভাবে থেকে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। কিন্তু তার অন্তরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েই গেল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এখানে উল্লেখ করতে হয় বেগম মুজিবের ভূমিকার কথা। তিনি রাজনীতিতে কোনো দিনই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেননি। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে বঙ্গবন্ধুর হয়ে আজীবন সমস্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মরহুম কাজী জাফর আহমদের বক্তব্য অনুসারে, ১৯৭৩ সালে তিনি ন্যাপের মহাসচিব মনোনীত হন। সেই বছর পবিত্র ঈদ উপলক্ষে পার্টির চেয়ারম্যান মওলানা ভাসানীর জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি কেনেন এবং সেটা তাকে উপহার দেন। মওলানা ভাসানী তখন বলেন, কামালের মা (বেগম মুজিব) প্রতি বছর তাকে ঈদের জামা–কাপড় দেন এবং সেই জামা-কাপড় পরেই তিনি ঈদের নামাজ আদায় করেন। সুদীর্ঘ দিন এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এ থেকে বুঝতে হবে, ভাসানী-মুজিব সম্পর্কের গভীরতা। ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র যখন পাকাপোক্ত, তখন মোনাজাতের নামে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেন মওলানা ভাসানী। লক্ষ লক্ষ ছাত্র–জনতা যুক্ত হলেন তার মোনাজাতে। আওয়াজ উঠলো-জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।
মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে সমগ্র বাঙালী জাতিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন। ইতিহাসে একমাত্র পন্ডিত মতিলাল নেহেরু কৌশলে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নিজ পুত্র পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্য। আর মওলানা ভাসানী পথ ছেড়ে দিয়েছিলেন পুত্রতুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবসুও আপনাকে ভালোবাসেন। এরপরেও আপনি ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ভারত একটি আধিপত্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে সম্প্রসারণবাদী হিসেবে। হায়দরাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করে তারা ভারতের মানচিত্র সম্প্রসারিত করেছে। শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন্তু সেজন্য কাশ্মীর অধিগ্রহণ থেমে থাকেনি। সিকিমকেও অধিগ্রহণ করেছে ভারত। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন জাতীয়তাবাদী নেতার কারণেই বাংলাদেশকে অধিগ্রহণ করতে পারেনি ভারত। মওলানা ভাসানী আরো বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সমস্ত দেশে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করেছিল, তাদের সেনাবাহিনী আজও সেই সকল দেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কারণেই মূলত বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ভারত। কিন্তু ভারতের একটি প্রশাসনিক মহল তা মেনে নিতে পারেনি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৫৭ দিনের মাথায় ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই বছরের ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মোশতাক সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়। এরপর ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন শহীদ জিয়াউর রহমান।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ পর্যন্ত এক ঐতিহাসিক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। দেশবাসী এই মিছিলকে ফারাক্কা লংমার্চ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ এক চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়। বাকশাল ও সামরিক শাসনের ফলে রাজনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সীমান্ত অস্থির হয়ে পড়ে। সর্বোপরি ফারাক্কার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তর জনপদ মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় মওলানা ভাসানী ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে এক ঐতিহাসিক লংমার্চ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু মজলুম জননেতা সেই সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সময়টা সম্ভবত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব আমাকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য নিয়ে যান। হুজুর পূর্বেই আমাকে চিনতেন। হুজুর আমাকে লংমার্চের ধারণা প্রদান করেন এবং তার সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান। আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে ফারাক্কা লংমার্চের সাংগঠনিক কাজ শুরু করি। মওলানা ভাসানী এই ফারাক্কা লংমার্চ পরিচালনা কমিটির আহবায়ক মনোনীত হন। ন্যাপ ভাসানী, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), হাজী দানেশ ও সিরাজুল হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন জাগমুই এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টি-এই পাঁচটি দল থেকে দু’জন করে সদস্য নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। বাইরে থেকে মাত্র দু’জনকে এই পরিচালনা পর্ষদে মনোনয়ন প্রদান করেন মওলানা ভাসানী। একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান এবং অন্যজন শেখ শওকত হোসেন নিলু।
১৯৭৬ সালের ১৫ মে সকাল ১০ ঘটিকায় মওলানা ভাসানীর মাদরাসা ময়দানে উপস্থিত হওয়ার কথা। ১৪ মে সন্ধ্যার মধ্যেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের নেতাকর্মীরা দলে দলে এসে উপস্থিত হতে থাকেন রাজশাহীতে। চট্টগ্রাম থেকে ব্যারিস্টার সলিমুল্লাহ খান মিলকী, বরিশাল থেকে শ্রী সুনীলগুপ্ত ও সিরাজুল হক, খুলনা থেকে গাজী শহিদুল্লাহ, ফরিদপুর থেকে ব্যারিস্টার কামরুল ইসলাম সালাউদ্দিন, যশোর থেকে তরিকুল ইসলাম এবং ঢাকা থেকে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত হন রাজশাহীতে। এছাড়া মশিউর রহমান যাদু মিয়া, এস এ বারী এটি, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, হায়দার আকবর খান রনো ও মাওলানা আব্দুল মতিনরা ১৪ মে’র মধ্যেই রাজশাহীতে উপস্থিত হন।
১৫ মে সকাল ১০টার মধ্যেই মাদরাসা ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মওলানা ভাসানী একটি খোলা জিপে করে আবু নাসের খান ভাসানী, এমরান আলী সরকার ও গাজী শহিদ উল্লাহকে নিয়ে ১০টা বাজার ৫ মিনিট আগে মাদরাসা ময়দানে উপস্থিত হন। লক্ষ কণ্ঠে আওয়াজ ওঠে- ‘যুগ যুগ জিও তুমি মওলানা ভাসানী; সিকিম নয় ভুটান নয় এদেশ আমার বাংলাদেশ’। জনসভায় একমাত্র বক্তা মওলানা ভাসানী। দোয়া পরিচালনা করেন লেবার পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মতিন। এরপর ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা ইন্তেকাল করেন। সুতরাং ১৫ মে’র মাদরাসা ময়দানের জনসভাই তার জীবনের শেষ জনসভা ও ভাষণ। এক ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি তার ভাষণ দেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে একজন লোকও নড়াচড়া করেননি। জনসভা ছিল নিস্তব্ধ। মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ভারত একতরফাভাবে ভাটির দেশের জনগণের পানি কেড়ে নিয়ে এই অঞ্চলে এক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, হাজার বছরের এই অঞ্চলে মাটি-পানি এবং কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতীদের সমন্বিত শ্রমের মধ্য দিয়ে এক সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। সেই পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের উপরে এক মরণযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ভারত। এই ফারাক্কা বাঁধের ফলে ১০ লক্ষ জেলে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রের মধ্যে পলি পড়ে বাংলাদেশের যে নতুন ভূখন্ড জেগে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। ভারতের শাসকরা বাংলাদেশের বন্ধু জনগণকে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না, ধ্বংস করতে পারে না সভ্য জনসমাজকে।
বেলা ১১টায় রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয় লক্ষ লোকের গণমিছিল। মওলানা ভাসানী একখানা খোলা জিপে করে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলের নেতাকর্মীদের আপ্যায়নের জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, নারী-পুরুষ, ছাত্র-কৃষক সকলেই ছুটে আসে কাঁচা আম, মুড়ি, পানি ও লেবুর শরবত নিয়ে। এভাবেই গড়ে ওঠে এক ঐতিহাসিক গণজাগরণ। আমরা বিকেল ৫টার মধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে যাই। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে সেখানে এক ঐতিহাসিক মশাল মিছিল বের হয়। শেখ শুকত হোসেন নীলু, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুর রাজ্জাক সরকার ছাড়াও এসকেন্দার আলী ও রাজশাহীর মিলন এই মশাল মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মশালের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পরদিন ১৬ মে সকাল ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদ অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষ ফারাক্কা বাঁধের দুই মাইল ভাটিতে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। এরপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
জাতীয় জীবনে জাতীয় ঐক্যের বুনিয়াদ সৃষ্টি হয় এই ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের পানির ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় মজলুম জননেতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।