শফিক আজাদ, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সেই লক্ষ্যে দ্রæত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে; যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ধাপে ভাসানচর যাচ্ছে ৬শ’ রোহিঙ্গা পরিবার। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বশীল প্রশাসনের কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ার মতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এজন্য প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুত করা হয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপ ঘুরে আসে ২২টি এনজিও প্রতিনিধি দল। ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য মজুত করা হয়েছে ৬৬ টন খাদ্যসামগ্রী।
ক্যাম্প-২০ এর হেডমাঝি মোহাম্মদ হোছন বলেন, ক্যাম্প-২০ এবং ২০ এক্সটেনশন থেকে ৮টি রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখাকালীন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই সব পরিবার ক্যাম্পে অবস্থান করছে। ক্যাম্প-১৭ এর হেডমাঝি মোহাম্মদ নুর বলেন, তার ক্যাম্প থেকে ৭০ পরিবারের নাম দেয়া হলেও ৯টি পরিবার ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। ক্যাম্প-৫ এর হেডমাঝি জাফর আলম বলেন, এ ক্যাম্প থেকে ৫টি রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক।
এদিকে শেষ পর্যন্ত ১ লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচর যাচ্ছে- এমন খবরে উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রকাশ করছেন। এ প্রসঙ্গে উখিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক তহিদুল আলম তহিদ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেয়ার আগে ২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেয়ার বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারা। সেখানে উন্নতমানের একটি আবাসিক এলাকায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তার সবই রয়েছে ভাসানচরে।
এদিকে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম এনে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এ অস্থায়ী আবাসস্থল এখন কর্মমুখর। দ্বীপটি বাসস্থানের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন পপ্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, মসজিদ, স্কুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য সেখানে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর পালন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত ভবনসমূহ ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি ঘর, প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে রুম রয়েছে। এর সঙ্গে একটি চারতলাবিশিষ্ট কম্পোজিট স্ট্রাকচারের (স্টিল) শেল্টার স্টেশন রয়েছে; যা আনুমানিক ২৬০ কিলোমিটার ঘণ্টায় ঘূণিঝড় স্থানীয়। প্রকল্পটিতে যেন এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারে- সেই লক্ষ্যে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। মোট ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি।
প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের একপ্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুররুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্যপ্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাস ব্যবস্থা। ধর্মীয় ইবাদত পালনে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিনটি শেল্টার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির কাজ শেষপর্যায়ে। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা বলেন, সরকারের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে পরিবেশবান্ধব ভাসানচরে স্থানান্তর একটি মহতী উদ্যোগ। তিনি আরও বলেন, আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ও নিরাপদ জায়গা মনে হচ্ছে ভাসানচর।
আরেক বেসরকারি সংস্থা মুক্তিথর মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন কর্মকর্তা ফয়সাল বারী বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারে ভূমিধস হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা বন উজাড় করছে। এখানে আমার মনে হয় থাকা এবং খাওয়ার বিষয়টা খুবই ভালো হবে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে কবেনাগাদ তাদের স্থানান্তর করা হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
এদিকে গত ২ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে- কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে জাতিসংঘ অবগত আছে। কিন্তু শরণার্থীদের স্থানান্তরে প্রস্তুতি কিংবা রোহিঙ্গাদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটিকে যুক্ত করা হয়নি। এ স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে তথ্যও কম আছে বলে বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তীতে মিয়ানমারে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে এদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করে আসছে। (দৈনিক যুগান্তর)