নিউইয়র্ক ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ভাসানী : রাজনৈতিক ইতিহাসের মহানায়ক

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:০৪:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০
  • / ১৪৪ বার পঠিত

ড. মাহবুব হাসান:

তাঁর পাখনায় ছিলো রৌদ্রগন্ধ ঘুম
ছিলো বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ
প্রাণবান সেই পুরুষ-হৃদয়ে লেগেছিলো
খেটে-খাওয়া মানুষের ঘামের সাহস ;
(মওলানা ভাসানী : তোমার প্রতীক )
কবিতার এ-কটি পঙক্তি যাঁর চিন্তাসা¤্রাজ্য ও রাজনৈতিক চরিত্র আঁকছে, তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিত্ব মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি সত্যিকার অর্থেই খেটে-খাওয়া মানুষের ‘ঘামের সাহস’ অর্জন করেছিলেন, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, তাঁর রাজনীতিই ছিলো গণমানুষের জন্য, তাদের উন্নতি ও কল্যাণ এবং বঞ্চনার অবসানের মাধ্যমে প্রকৃত রাজনৈতিক ও মানবিক আকাশ সৃষ্টি করা। ওই স্বপ্নময় আকাশের নিচে যারা বাস করে তাদের মতোই তিনিও এক সাধারণ পরিবারের মানুষ ছিলেন। অবিভক্ত উপমহাদেশের বাংলা-আসাম প্রদেশের রাজনৈতিক মানুষটির জন্ম হয়েছিলো ১৮৮০ সালে, বর্তমান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। আর তাঁর রাজনৈতিক উত্থান আসামের ব্রক্ষপুত্রের চরাঞ্চল ‘ভাসান’-এ। তরুণ মওলানা ওই ভাসান চরের প্রতিনিধি হিসেবে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখান থেকেই তার নামের সাথে ভাসানী শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। এবং আমরা মাত্র একটি শব্দেই তাকে চিনতে পারি তাহলো ‘ভাসানী’। কেউ কেউ বলেন ‘মওলানা ভাসানী’, পরবর্তীকালে তার নামের সাথে তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রও যোগ হয়ে যায়, আর তাহলো ‘লাল মওলানা’। তিনি রাজনৈতিক চিন্তায় ছিলেন বিপ্লবী। বলা হয় চীনাপন্থী বিপ্লবী। আসলে তিনি মাওবাদী ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক মতবাদই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। কেবল ‘বিপ্লব’ ও ‘স্বাধীনতা’ এই দুটি সত্তাই তিনি লালন করেছেন আমৃত্যু। তাই বিপ্লবের রঙ হিসেবে রক্তের লালকেই সিম্বল বা প্রতীক করা হয়েছে। ‘লাল মওলানা’ বললে তাই উপমহাদেশের একমাত্র রাজনীতিকে চিত্রিত করা হয়, তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর তাঁর অস্থায়ী নিবাস হয় টাঙ্গাইলের সন্তোসে, এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পাশে, ছোটো ছনে ছাওয়া দোচালায়।
ড. মাহবুব হাসান

কিন্তু এটুকুই তো নয়, তিনি যে মনন-মানসে বিপ্লবী ছিলেন তার নমুনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনধারার প্রতিটি বাঁকেই রয়ে গেছে। যারা তাকে জানতে চান, তাদের উচিত তাঁকে পাঠ করা। কারণ, আজকের বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতার তিনিই ছিলেন উদ্যোক্তা ও নিয়ামক শক্তি। তাঁর চেয়েও সিনিয়র শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে ভাসানীর মতো প্রাগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন সেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জনের পর ‘রাজনৈতিক ভূ-স্বামী’ ও ধনিকদের কব্জাগত হয়ে গেছে, তিনি বেরিয়ে এলেন ওই রাজনীতি থেকে। এবং তিনি গড়ে তুললেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পরই। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সভাপতি আর টাঙ্গাইলের জননেতা শামসুল হক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। শেখ মুজিব ছিলেন এই কমিটির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি সভাপতি হিসেবেই দলটিকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে দিলেন। একজন মুসলিম হিসেবে নয়, তিনি নিজেকে রাজনৈতিক মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় গড়ে নিয়েছিলেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনটি সাধিত হয়েছিলো ‘হক-ভাসানী’র নেতৃত্বাধীন হিসেবে। সেই নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলো আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব এই বিজয়ের পথ ধরেই রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রবেশ করেন।
পাকিস্তানী তথা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজেনৈতিক ভূ-স্বামী’দের সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক গ্রাসের অন্ন থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ১৯৪৯ সালেই বলেছিলেন বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। ১৯৫৮ সালে তাই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশে ‘আস-সালামুআলাইম’ বলে বিদায় জানিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন তিনি এবং তাঁর দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেন, সামরিক সরকারের ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। এবং তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকেও নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে আহবান জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হলেও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ফ্রেমওয়র্কে একটি ধারা ছিলো এই যে, সামরিক সরকার যদি মনে করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, তাহলে তাই হবে। তার মানে তাদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা দেয়া বা না-দেয়া। এবং ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে গণহত্যা করে জনগণের রায়কে উল্টে দিতে তৎপর হয়েছিলো। গোটা ষাটের দশক জুড়ে বাংলাদেশে যে গণজোয়ার ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো, তার সিংহাসনে ছিলেন মওলানা ভাসানী। ৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা উত্থাপনের পর পাকিস্তানী আইয়ুব শাহী তাকে কারা বন্দী করেন। তার মুক্তির প্রথম আওয়াজ তোলেন মওলানা ভাসানী। গড়ে তোলেন উত্তাল গণজোয়ার। তার সাথে যোগ দেয় ছাত্র সংগঠনগুলো। ৬৯-এর ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে মুক্তি পান শেখ মুজিব। এবং তিনি পাকিস্তানী শাসকদের প্ররোচনায় বিশ্বাস করে নির্বাচনে অংশ নেবার ঘোষণা দেন। মওলানার নিষেধ তিনি মানেননি। তিনি ভেবেছিলেন জনগণের রায় সামরিক সরকার মেনে নেবেন। কিন্তু দূরদর্শী মওলানা বুঝেছিলেন পাকিস্তানী শাসকেরা মেনে নেবে না। সেটাই সত্য হয়েছিলো।
স্বাধীনতার পরও তিনি গণমানুষের পক্ষে তার রাজনীতি জারি রেখেছিলেন। শেখ মুজিব সরকারের সমালোচনাই কেবল করেননি তিনি, তিনি অনেক ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ, অশীতিপর রাজনীতিকের প্রতি সম্মান জানাননি শেখ মুজিব। অথচ শেখ মুজিব ছিলেন ভাসানীর আর্শিবাদপুষ্ট এক তরুণ রাজনীতিক। তাকে নানা পর্যায়ে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন মওলানা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীকে ‘পিতার মতোই শ্রদ্ধা’ করতেন, কিন্তু নিজের ত্রæটিগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পিতৃত্ব’ দাবি করার জন্য যদি কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কারণ তিনি কেবল স্বাধীনতা শব্দটিকে মনেপ্রাণে লালনই করেননি, তা রাজনৈতিক বিশ্বাসের সোপান করে তুলেছিলেন। বন্দুকের নল ছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি সেই লক্ষ্যেই রাজনীতি জারি রেখেছিলেন আমৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সেই সত্যই প্রমাণ করেছে। আমরা ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর অগণন মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করেছি কাঙ্খিত স্বাধীনতা। নির্বাচনের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়িমাত্র। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা সেই সিঁড়িও গুড়িয়ে দিয়েছিলো।
মওলানা ভাসানী ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক মিছিল করেছিলেন ১৯৭৬ সালে, তাও ছিলো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে আরেক রাজনৈতিক ইতিহাস। তিনি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই যাকে জাতির বিবেক, জাতির পিতার ভূমিকায় অভিসিক্ত করতে পারে। তিনি যে ‘জাতির জনকেরও জনক এবং গুর’ এটা আজ আমরা ভুলে বসে আছি। আজ তাকে আমরা স্মরণ করি না। এই ব্যর্থতা কিন্তু তার নয়। আমাদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞানতা, ইতিহাস বিমুখতা, গড্ডলে গা ভাসানো, অন্যের জিহবায় ঝাল ও নুন পরখের অভ্যাসেরই কুফল এটা। আমরা চাই রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিটি পদক্ষেপের অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ হোক। তাহলেই কেবল ‘অবদান’ কার তা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম জানেন না যে রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রকৃত জ্যোতিষ্ক কে ছিলেন। কারণ তাঁর নামটিও আজকে উচ্চারণ করতে চায় না এবং জানেও না তিনি কে এবং কি ছিলেন।
নিউইয়র্ক
১১ নভেম্বর ২০২০

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ভাসানী : রাজনৈতিক ইতিহাসের মহানায়ক

প্রকাশের সময় : ০৬:০৪:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০

ড. মাহবুব হাসান:

তাঁর পাখনায় ছিলো রৌদ্রগন্ধ ঘুম
ছিলো বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ
প্রাণবান সেই পুরুষ-হৃদয়ে লেগেছিলো
খেটে-খাওয়া মানুষের ঘামের সাহস ;
(মওলানা ভাসানী : তোমার প্রতীক )
কবিতার এ-কটি পঙক্তি যাঁর চিন্তাসা¤্রাজ্য ও রাজনৈতিক চরিত্র আঁকছে, তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিত্ব মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি সত্যিকার অর্থেই খেটে-খাওয়া মানুষের ‘ঘামের সাহস’ অর্জন করেছিলেন, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, তাঁর রাজনীতিই ছিলো গণমানুষের জন্য, তাদের উন্নতি ও কল্যাণ এবং বঞ্চনার অবসানের মাধ্যমে প্রকৃত রাজনৈতিক ও মানবিক আকাশ সৃষ্টি করা। ওই স্বপ্নময় আকাশের নিচে যারা বাস করে তাদের মতোই তিনিও এক সাধারণ পরিবারের মানুষ ছিলেন। অবিভক্ত উপমহাদেশের বাংলা-আসাম প্রদেশের রাজনৈতিক মানুষটির জন্ম হয়েছিলো ১৮৮০ সালে, বর্তমান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। আর তাঁর রাজনৈতিক উত্থান আসামের ব্রক্ষপুত্রের চরাঞ্চল ‘ভাসান’-এ। তরুণ মওলানা ওই ভাসান চরের প্রতিনিধি হিসেবে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখান থেকেই তার নামের সাথে ভাসানী শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। এবং আমরা মাত্র একটি শব্দেই তাকে চিনতে পারি তাহলো ‘ভাসানী’। কেউ কেউ বলেন ‘মওলানা ভাসানী’, পরবর্তীকালে তার নামের সাথে তাঁর রাজনৈতিক চরিত্রও যোগ হয়ে যায়, আর তাহলো ‘লাল মওলানা’। তিনি রাজনৈতিক চিন্তায় ছিলেন বিপ্লবী। বলা হয় চীনাপন্থী বিপ্লবী। আসলে তিনি মাওবাদী ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক মতবাদই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। কেবল ‘বিপ্লব’ ও ‘স্বাধীনতা’ এই দুটি সত্তাই তিনি লালন করেছেন আমৃত্যু। তাই বিপ্লবের রঙ হিসেবে রক্তের লালকেই সিম্বল বা প্রতীক করা হয়েছে। ‘লাল মওলানা’ বললে তাই উপমহাদেশের একমাত্র রাজনীতিকে চিত্রিত করা হয়, তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর তাঁর অস্থায়ী নিবাস হয় টাঙ্গাইলের সন্তোসে, এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পাশে, ছোটো ছনে ছাওয়া দোচালায়।
ড. মাহবুব হাসান

কিন্তু এটুকুই তো নয়, তিনি যে মনন-মানসে বিপ্লবী ছিলেন তার নমুনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনধারার প্রতিটি বাঁকেই রয়ে গেছে। যারা তাকে জানতে চান, তাদের উচিত তাঁকে পাঠ করা। কারণ, আজকের বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতার তিনিই ছিলেন উদ্যোক্তা ও নিয়ামক শক্তি। তাঁর চেয়েও সিনিয়র শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে ভাসানীর মতো প্রাগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন সেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জনের পর ‘রাজনৈতিক ভূ-স্বামী’ ও ধনিকদের কব্জাগত হয়ে গেছে, তিনি বেরিয়ে এলেন ওই রাজনীতি থেকে। এবং তিনি গড়ে তুললেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পরই। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সভাপতি আর টাঙ্গাইলের জননেতা শামসুল হক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। শেখ মুজিব ছিলেন এই কমিটির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি সভাপতি হিসেবেই দলটিকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে দিলেন। একজন মুসলিম হিসেবে নয়, তিনি নিজেকে রাজনৈতিক মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় গড়ে নিয়েছিলেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনটি সাধিত হয়েছিলো ‘হক-ভাসানী’র নেতৃত্বাধীন হিসেবে। সেই নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলো আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব এই বিজয়ের পথ ধরেই রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রবেশ করেন।
পাকিস্তানী তথা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজেনৈতিক ভূ-স্বামী’দের সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক গ্রাসের অন্ন থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ১৯৪৯ সালেই বলেছিলেন বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। ১৯৫৮ সালে তাই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশে ‘আস-সালামুআলাইম’ বলে বিদায় জানিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন তিনি এবং তাঁর দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেন, সামরিক সরকারের ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। এবং তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকেও নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে আহবান জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হলেও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ফ্রেমওয়র্কে একটি ধারা ছিলো এই যে, সামরিক সরকার যদি মনে করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, তাহলে তাই হবে। তার মানে তাদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা দেয়া বা না-দেয়া। এবং ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে গণহত্যা করে জনগণের রায়কে উল্টে দিতে তৎপর হয়েছিলো। গোটা ষাটের দশক জুড়ে বাংলাদেশে যে গণজোয়ার ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো, তার সিংহাসনে ছিলেন মওলানা ভাসানী। ৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা উত্থাপনের পর পাকিস্তানী আইয়ুব শাহী তাকে কারা বন্দী করেন। তার মুক্তির প্রথম আওয়াজ তোলেন মওলানা ভাসানী। গড়ে তোলেন উত্তাল গণজোয়ার। তার সাথে যোগ দেয় ছাত্র সংগঠনগুলো। ৬৯-এর ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে মুক্তি পান শেখ মুজিব। এবং তিনি পাকিস্তানী শাসকদের প্ররোচনায় বিশ্বাস করে নির্বাচনে অংশ নেবার ঘোষণা দেন। মওলানার নিষেধ তিনি মানেননি। তিনি ভেবেছিলেন জনগণের রায় সামরিক সরকার মেনে নেবেন। কিন্তু দূরদর্শী মওলানা বুঝেছিলেন পাকিস্তানী শাসকেরা মেনে নেবে না। সেটাই সত্য হয়েছিলো।
স্বাধীনতার পরও তিনি গণমানুষের পক্ষে তার রাজনীতি জারি রেখেছিলেন। শেখ মুজিব সরকারের সমালোচনাই কেবল করেননি তিনি, তিনি অনেক ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ, অশীতিপর রাজনীতিকের প্রতি সম্মান জানাননি শেখ মুজিব। অথচ শেখ মুজিব ছিলেন ভাসানীর আর্শিবাদপুষ্ট এক তরুণ রাজনীতিক। তাকে নানা পর্যায়ে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন মওলানা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীকে ‘পিতার মতোই শ্রদ্ধা’ করতেন, কিন্তু নিজের ত্রæটিগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পিতৃত্ব’ দাবি করার জন্য যদি কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কারণ তিনি কেবল স্বাধীনতা শব্দটিকে মনেপ্রাণে লালনই করেননি, তা রাজনৈতিক বিশ্বাসের সোপান করে তুলেছিলেন। বন্দুকের নল ছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি সেই লক্ষ্যেই রাজনীতি জারি রেখেছিলেন আমৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সেই সত্যই প্রমাণ করেছে। আমরা ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর অগণন মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করেছি কাঙ্খিত স্বাধীনতা। নির্বাচনের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়িমাত্র। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা সেই সিঁড়িও গুড়িয়ে দিয়েছিলো।
মওলানা ভাসানী ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক মিছিল করেছিলেন ১৯৭৬ সালে, তাও ছিলো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে আরেক রাজনৈতিক ইতিহাস। তিনি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই যাকে জাতির বিবেক, জাতির পিতার ভূমিকায় অভিসিক্ত করতে পারে। তিনি যে ‘জাতির জনকেরও জনক এবং গুর’ এটা আজ আমরা ভুলে বসে আছি। আজ তাকে আমরা স্মরণ করি না। এই ব্যর্থতা কিন্তু তার নয়। আমাদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞানতা, ইতিহাস বিমুখতা, গড্ডলে গা ভাসানো, অন্যের জিহবায় ঝাল ও নুন পরখের অভ্যাসেরই কুফল এটা। আমরা চাই রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিটি পদক্ষেপের অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ হোক। তাহলেই কেবল ‘অবদান’ কার তা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম জানেন না যে রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রকৃত জ্যোতিষ্ক কে ছিলেন। কারণ তাঁর নামটিও আজকে উচ্চারণ করতে চায় না এবং জানেও না তিনি কে এবং কি ছিলেন।
নিউইয়র্ক
১১ নভেম্বর ২০২০