জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভ

- প্রকাশের সময় : ১০:৫৩:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / ৮৯ বার পঠিত
এ কে এম আতিকুর রহমান: ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশন শুরু হয়েছে। অধিবেশনটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন ২৮তম অধিবেশনের সভাপতি ইকুয়েডর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত। আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফলিকাকে ২৯তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। যেহেতু সে বছর আফ্রিকা থেকে সভাপতি নির্বাচন করা হবে এবং তিনি আফ্রিকার একমাত্র মনোনয়ন ছিলেন, তাই বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। আর প্রথা অনুযায়ী প্রথম দিনের ওই অধিবেশনেই বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের ৮ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর তথা তাঁর মন্ত্রিসভার অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাক্ষরিত ওই আবেদনপত্রটি জাতিসংঘ মহাসচিবকে তারযোগে পাঠানো হয়, যার অনুলিপি ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকেও দেওয়া হয়।
সেই আবেদনপত্রে বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তিনি বিনীতভাবে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আবেদনটি পাঠিয়েছেন। তিনি আরো ঘোষণা দেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ সনদের সব দায়বদ্ধতার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ এবং ওই বাধ্যবাধকতাগুলো পালনের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে। আবেদনটি যত শিগগির সম্ভব নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপনের জন্যও তিনি মহাসচিবকে অনুরোধ করেন।
ওই সময় ঢাকায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি ব্রিফিংয়ের জন্য ডাকা হয় এবং তাঁদের জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য বাংলাদেশের প্রার্থিতাকে সমর্থন করার জন্য অনুরোধ করা হয়। সর্বোপরি ১০ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের জন্য বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন।
আমরা জানি, আমাদের জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। প্রথম প্রচেষ্টার সময় চীনের ভেটো আমাদের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ৮ আগষ্ট সদস্য পদের জন্য আবেদন পাঠিয়েছিল, তবে ১১ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশের আবেদনটি পুনরায় বিবেচনার জন্য ২১ আগষ্ট পর্যন্ত মুলতবি করতে সব সদস্যই সম্মত হয়। ২৩ আষ্ট বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য যুক্তরাজ্য, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগো¯øাভিয়া সমর্থিত একটি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ২৫ তারিখে চীন ওই প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করার ফলে ওই সময় বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বের অনেক পত্রিকা জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবেদনে চীনের ভেটো প্রয়োগের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লিখেছিল। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল নিউইয়র্ক পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোষ্ট, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, দ্য সান (বাল্টিমোর), সানডে স্টার, ডেইলি নিউজ, হেরাল্ড ট্রিবিউন, প্রাভদা, জাপান টাইমস, আসাহি ইভনিং নিউজ, ফ্রি প্রেস, দ্য স্কটসম্যান ইত্যাদি। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের ২৬ আগষ্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আমেরিকা শাখা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের চীনা মিশনের সামনে বিক্ষোভ করে চীনা ভেটোর নিন্দা জানায়। সে সময় তারা বিভিন্ন পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড বহন করার পাশাপাশি চীন সরকারকে উদ্দেশ করে লেখা একটি খোলা চিঠি জনসাধারণের মধ্যে বিতরণও করে।
বাংলাদেশ অনুকূল পরিস্থিতি খুঁজতে থাকে। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ পুনরায় আবেদন করে। কারণ এরই মধ্যে এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। দিল্লি চুক্তির ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ইতিবাচক রূপ নেয়। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। জাতির জনক পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী কনফারেন্সে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চীন তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭৪ সালের ১০ জুন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের প্রস্তাবটি উত্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে না গিয়ে ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অতঃপর প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশসহ সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়। আমরা জানি, প্রতিবছরই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনটি বসে ১৭ সেপ্টেম্বর। আর প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে ওই দিনই সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।
সেদিন গ্রানাডা ও গিনি বিসাউ আমাদের মতোই জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের স্বাদ গ্রহণ করে।
এ উপলক্ষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই ঐতিহাসিক ঘটনায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভিনন্দন গ্রহণ করেন এবং ধন্যবাদ জানিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। অভিনন্দনকারী সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিংও উপস্থিত ছিলেন। (দৈনিক কালের কন্ঠ)
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব