নিউইয়র্ক ০৯:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মিলিয়নিয়ার ফাহিম খুনের নেপথ্যে-

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৩০:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০
  • / ২৩ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে। এর গা-শিউরে উঠা বর্ণনা দেয়া হয়েছে সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে নিউইয়র্কের মতো স্থানে কীভাবে এমন ভয়াবহতা সংঘটিত হলো! কি কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে! তার স্বজনরা এ সম্পর্কে কোনো ক্লু দিতে না পারলেও নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এনবিসি২-কে বলেছেন, আর্থিক কারণে এই হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে। তবে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) রাতে এবং বুধবার সকালেও গোয়েন্দারা ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ তন্ন তন্ন করে খুনিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালান। তারা স্থানীয় স্টোর, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এবং ট্র্যাফিক ক্যামেরাগুলোও পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এসব নিয়ে সারা দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ঠাসা।
তবে তার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, যে ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। তাদের এখন একটাই দাবি, খুনিকে গ্রেপ্তার করা হোক। পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতি প্রকাশ করেছে লন্ডনের অনলাইন ডেইলি মেইল। তাতে তারা বলেছেন, ‘যে নরঘাতক আমাদের প্রিয়জনের ওপর পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছে তাকে গ্রেপ্তার ছাড়া আর কোনো ভাষা বা পদক্ষেপ আমাদেরকে স্বস্তি দিতে পারবে না। এনওয়াইপিডি এবং আইনপ্রয়োগকারী অন্য যেসব সংস্থার সদস্যরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের কাছে আমাদের দাবি এই ভয়াবহ অপরাধের কারণ উদঘাটন করুন এবং ফাহিমের খুনিকে বিচারের আওতায় আনুন। ফাহিম সম্পর্কে আপনারা যা পড়ছেন, সে তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। সে তার চেয়েও অনেক বেশি। তার মেধাবী এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা ছিল সবাইকে নিয়ে, যেখানে সে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছিল। সে কাউকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চায় নি।
উল্লেখ্য, অল্প বয়সেই ব্যবসায় ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন ফাহিম সালেহ। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কিকব্যাক অ্যাপস। এ সংস্থার রয়েছে প্রাঙ্ক ডায়াল সহ চারটি অ্যাপ। এ ছাড়া লাগোসে রয়েছে তার মোটরবাইক ট্যাক্সি বিষয়ক অ্যাপ গোকোডো। ব্যস্ত সড়কে এই অ্যাপটি সেখানে খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ। সিলিকন ভ্যালি থেকে গত বছর এতে বিনিয়োগ হয় ৫৩ লাখ ডলার। বাংলাদেশে রাইট শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ। প্রথমে এটা মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহার হলেও এখন এই অ্যাপ ব্যবহার করে খাদ্য ও পোশাক কেনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। নাইজেরিয়ায় রয়েছে তার মোটরবাইক ট্যাক্সি বিষয়ক ব্যবসা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। ফাহিম সালেহ কলম্বিয়ায় রাইট শেয়ারিং কোম্পানিগুলোতেও বিনিয়োগ করেছেন।
ফাহিম সালেহ-কে যখন হত্যা করা হলো এর সমসাময়িক সময়ে সাবেক একজন জেল কর্মকর্তা হাডসন কাউন্টি কারেকশনাল ফ্যাসিলিটির উপ-পরিচালক কির্ক ইয়াডি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। প্রাঙ্কডায়াল অ্যাপ ব্যবহার করে তিনি দু’জন কর্মকর্তার ফোনালাপ রেকর্ড করে শুনেছিলেন। এ জন্য ইয়াডি নিজে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। তাকে এ অপরাধে ১৫ মাসের জেল দেয়া হয়। এই প্রাঙ্কডায়াল অ্যাপটি ২০১৫ সালে চালু করেছিলেন ফাহিম সালেহ। কিন্তু ফাহিম সালেহ’র বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মামলা করে বসে ইয়াডি। তিনি বলেন, আমি মনে করেছিলাম ওই অ্যাপ ব্যবহার করে কথোপকথন রেকর্ড করা আইনসম্মত।
মা-বাবা, বোন ও ভগ্নিপতির সাথে ফাহিম সালেহ (সর্ব বামে)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে ডেইলি মেইল লিখেছে, সালেহ’র এক বোন মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ম্যাটহাটানের ইস্ট হাউজটনে উপস্থিত হন তার এপার্টমেন্টে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করে তিনি প্লাস্টিকের ব্যাগে দেখতে পান তার ভাইয়ের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ভরা। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ ডাকা হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তারা মনে করছে এমন হত্যাকান্ড পেশাদার খুনিরা করে থাকতে পারে। খুনি তার সঙ্গে লিফটে করে উঠে আসে। তার সঙ্গেই লিফট থেকে নামে। সালেহ তার এপার্টমেন্টে প্রবেশ করতেই তার সঙ্গে সে ভেতরে প্রবেশ করে। খুনি ছিল মাস্ক, গেøাভস ও হ্যাট পরা। পুলিশ সূত্রগুলো তার এই পোশাককে নিনজা স্টাইলের বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, খুনির হাতে ছিল একটি স্যুটকেস। হত্যাকান্ড শেষ করে সে যখন সবকিছু গোছগাছ করে নিচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই অপ্রত্যাশিতভাবে ওই এপার্টমেন্টে যান সালেহ’র বোন।
এনবিসি’কে সূত্র বলেছেন, দৃশ্যত খুনি নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেখান থেকে অনায়াসে পালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে সে পেছন দিকের জরুরি এক্সিট ব্যবহার করে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তার আগে সে ফেলে যায় তার ইলেক্ট্রিক করাত। এই করাত দিয়েই সে ফাহিম সালেহকে হত্যা করে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে।
অন্য সূত্রগুলো দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট-কে বলেছেন, ওই এপার্টমেন্টে গিয়ে কলিংবেল চাপেন ফাহিমের বোন। এটা খুনির জন্য ছিল একটি সতর্ক সংকেত। ফলে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সিঁড়িপথে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পুলিশ সূত্রগুলো শুধু মনে করছে, এই হত্যার পেছনে আর্থিক কোনো কারণ থাকতে পারে। তবে তারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলে নি।
ওদিকে ফাহিম সালেহ’র এক বন্ধু বলেছেন, ঘটনার সময় ওই এপার্টমেন্টের আশপাশের প্রতিবেশীরা আর্তনাদ, তীব্র শব্দ শুনতে পেয়েছেন। তবে তারা কেউই জরুরি সেবার ৯১১ নম্বরে কল করেন নি। পুলিশ বলছে, সিসিটিভি ফুটেজে সন্দেহজনক খুনিকে সালেহ’র সঙ্গে সোমবার (১৩ জুলাই) ভবনে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তারা একসঙ্গে লিফটে উঠেছে। এরপর সালেহ’র সঙ্গে তার বাসায় প্রবেশ করেছে খুনি। পুলিশ বলেছে, আমাদের মনে হচ্ছে তার উদ্দেশ্য ছিল হত্যার পর মৃতদেহের অংশগুলো সরিয়ে ফেলে সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা, যাতে কেউ বুঝতে না পারে কি ঘটেছে। কিন্তু সে তার কাজ সম্পন্ন করার আগেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
নিউইয়র্ক পোস্টকে সূত্রগুলো বলেছেন, ফাহিম সালেহ’র সপ্তম তলার এপার্টমেন্টে একসঙ্গে আরোহণ করে খুনি। তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিলেন সালেহ। সালেহ’র এপার্টমেন্টের দরজা লিফট বরাবর। লিফটের দরজা খুললেই তার দরজা। ফলে লিফট থেকে সালেহ পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আক্রমণ শুরু হয়। ফুটেজে দেখা গেছে, গুলি করার পর অথবা হতভম্ব হয়ে মেঝেতে পড়ে যান সালেহ। এরপরই তার ওপর পুরোপুরি আক্রমণ শুরু হয়। এরপর পুলিশ সালেহ’র হাঁটুর নিচের অংশ আলাদা করা অবস্থায় পেয়েছে। দুটি হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পেয়েছে। শরীরের আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছিল। তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো, সেখানে খুব সামান্যই রক্ত ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, প্রমাণ রেখে যেতে চায় নি খুনি। পুলিশ এখন জানার চেষ্টা করছে, সালেহ’র বোন ওই এপার্টমেন্টে আসায় খুনি তার রক্তের হোলিখেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কিনা। গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন, খুনি এক্সিট ডোর ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে কিনা। এনওয়াইপিডির মুখপাত্র সার্জেন্ট কার্লোস নিয়েভেস বলেছেন, আমরা শুধু সালেহ’র মৃতদেহটা পেয়েছি। এতে মাথা, হাত এবং পা নেই। তবে সবই ওই ঘটনাস্থলে ছিল। কী কারণে হত্যা করা হয়েছে বলতে পারছি না।
উল্লেখ্য, ফাহিম সালেহ সৌদি আরবে এক বাংলাদেশী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তিনি বড় হন নিউইয়র্কে। গত বছর ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার দিয়ে কিনেছেন বিলাসবহুল ওই এপার্টমেন্ট। এটা কিনতে পেরে তিনি ছিলেন গর্বিত। মাঝে মধ্যেই এর বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করতেন। লিঙ্কডইনে তার প্রোফাইলে বলা হয়েছে, তিনি নাইজেরিয়ার লাগোসে একটি মোটরবাইক কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। এর আগে তিনি ছিলেন একজন ওয়েব ডেভেলপার। নাইজেরিয়ায় তার কোম্পানির নাম ছিল গোকোডো। নাইজেরিয়া সরকার এ বছর শুরুর দিকে তা বন্ধ করে দেয়। ফলে বড় একটি ধাক্কা লাগে এতে তার। বাধ্য হয়ে লে-অফ ঘোষণা করেন। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসকে পরিণত করেন ডেলিভারি কুরিয়ারে। ২০১৯ সালের মে মাসে সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রাইজ ক্যাপিটাল থেকে তিনি ৫৩ লাখ ডলার সংগ্রহ করেন গোকোডোর জন্য। কিন্তু তার সেই সেবা বন্ধ করে দেয়ায় তিনি বিরাট সমস্যায় পড়েন। এর ফলে ওই অর্থ ঋণ নেয়া বন্ধ করে দেন। গোকোডো ব্যবহার করেন যে প্রায় ৮০০ বাইকার তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে লে-অফ দেয়া হলো।
মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বিকালেই বন্ধুরা সালেহ’র এপার্টমেন্টে যান দেখতে। এ সময় এক দম্পতি বলেন, সালেহকে টার্গেট করা হয়ে থাকতে পারে। এক বন্ধু বলেছেন, তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, খুবই স্মার্ট এবং নরম মনের। সব সময় হাসতেন। তিনি নিজে নিজেই মিলিয়নিয়ার হয়েছেন। নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অনুন্নত দেশগুলোতে তিনি পৌঁছে দিতেন প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি। তবে কারো কাছ থেকে কোনো হুমকির কথা তিনি কখনো বলেন নি।
মঙ্গলবার রাতে অনলাইনে সালেহ’র প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে থাকেন অসংখ্য মানুষ। টরোন্টোতে বসবাসকারী একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লিখেছেন, শান্তিতে ঘুমাও ফাহিম সালেহ। তার পরিবার ও বন্ধুদের জন্য গভীর শোক। দিনের পর দিন পৃথিবীটা অমানবিক হয়ে উঠছে। ফাহিমের বন্ধুরা বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ফাহিম ছিলেন ইলন মাস্কের মতো।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

মিলিয়নিয়ার ফাহিম খুনের নেপথ্যে-

প্রকাশের সময় : ০৯:৩০:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০

হককথা ডেস্ক: রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে। এর গা-শিউরে উঠা বর্ণনা দেয়া হয়েছে সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে নিউইয়র্কের মতো স্থানে কীভাবে এমন ভয়াবহতা সংঘটিত হলো! কি কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে! তার স্বজনরা এ সম্পর্কে কোনো ক্লু দিতে না পারলেও নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এনবিসি২-কে বলেছেন, আর্থিক কারণে এই হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে। তবে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) রাতে এবং বুধবার সকালেও গোয়েন্দারা ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ তন্ন তন্ন করে খুনিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালান। তারা স্থানীয় স্টোর, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এবং ট্র্যাফিক ক্যামেরাগুলোও পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এসব নিয়ে সারা দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ঠাসা।
তবে তার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, যে ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে তারা কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। তাদের এখন একটাই দাবি, খুনিকে গ্রেপ্তার করা হোক। পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতি প্রকাশ করেছে লন্ডনের অনলাইন ডেইলি মেইল। তাতে তারা বলেছেন, ‘যে নরঘাতক আমাদের প্রিয়জনের ওপর পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছে তাকে গ্রেপ্তার ছাড়া আর কোনো ভাষা বা পদক্ষেপ আমাদেরকে স্বস্তি দিতে পারবে না। এনওয়াইপিডি এবং আইনপ্রয়োগকারী অন্য যেসব সংস্থার সদস্যরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের কাছে আমাদের দাবি এই ভয়াবহ অপরাধের কারণ উদঘাটন করুন এবং ফাহিমের খুনিকে বিচারের আওতায় আনুন। ফাহিম সম্পর্কে আপনারা যা পড়ছেন, সে তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। সে তার চেয়েও অনেক বেশি। তার মেধাবী এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা ছিল সবাইকে নিয়ে, যেখানে সে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছিল। সে কাউকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চায় নি।
উল্লেখ্য, অল্প বয়সেই ব্যবসায় ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন ফাহিম সালেহ। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কিকব্যাক অ্যাপস। এ সংস্থার রয়েছে প্রাঙ্ক ডায়াল সহ চারটি অ্যাপ। এ ছাড়া লাগোসে রয়েছে তার মোটরবাইক ট্যাক্সি বিষয়ক অ্যাপ গোকোডো। ব্যস্ত সড়কে এই অ্যাপটি সেখানে খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ। সিলিকন ভ্যালি থেকে গত বছর এতে বিনিয়োগ হয় ৫৩ লাখ ডলার। বাংলাদেশে রাইট শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ। প্রথমে এটা মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহার হলেও এখন এই অ্যাপ ব্যবহার করে খাদ্য ও পোশাক কেনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। নাইজেরিয়ায় রয়েছে তার মোটরবাইক ট্যাক্সি বিষয়ক ব্যবসা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। ফাহিম সালেহ কলম্বিয়ায় রাইট শেয়ারিং কোম্পানিগুলোতেও বিনিয়োগ করেছেন।
ফাহিম সালেহ-কে যখন হত্যা করা হলো এর সমসাময়িক সময়ে সাবেক একজন জেল কর্মকর্তা হাডসন কাউন্টি কারেকশনাল ফ্যাসিলিটির উপ-পরিচালক কির্ক ইয়াডি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। প্রাঙ্কডায়াল অ্যাপ ব্যবহার করে তিনি দু’জন কর্মকর্তার ফোনালাপ রেকর্ড করে শুনেছিলেন। এ জন্য ইয়াডি নিজে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। তাকে এ অপরাধে ১৫ মাসের জেল দেয়া হয়। এই প্রাঙ্কডায়াল অ্যাপটি ২০১৫ সালে চালু করেছিলেন ফাহিম সালেহ। কিন্তু ফাহিম সালেহ’র বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে মামলা করে বসে ইয়াডি। তিনি বলেন, আমি মনে করেছিলাম ওই অ্যাপ ব্যবহার করে কথোপকথন রেকর্ড করা আইনসম্মত।
মা-বাবা, বোন ও ভগ্নিপতির সাথে ফাহিম সালেহ (সর্ব বামে)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে ডেইলি মেইল লিখেছে, সালেহ’র এক বোন মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ম্যাটহাটানের ইস্ট হাউজটনে উপস্থিত হন তার এপার্টমেন্টে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করে তিনি প্লাস্টিকের ব্যাগে দেখতে পান তার ভাইয়ের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে ভরা। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ ডাকা হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তারা মনে করছে এমন হত্যাকান্ড পেশাদার খুনিরা করে থাকতে পারে। খুনি তার সঙ্গে লিফটে করে উঠে আসে। তার সঙ্গেই লিফট থেকে নামে। সালেহ তার এপার্টমেন্টে প্রবেশ করতেই তার সঙ্গে সে ভেতরে প্রবেশ করে। খুনি ছিল মাস্ক, গেøাভস ও হ্যাট পরা। পুলিশ সূত্রগুলো তার এই পোশাককে নিনজা স্টাইলের বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, খুনির হাতে ছিল একটি স্যুটকেস। হত্যাকান্ড শেষ করে সে যখন সবকিছু গোছগাছ করে নিচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই অপ্রত্যাশিতভাবে ওই এপার্টমেন্টে যান সালেহ’র বোন।
এনবিসি’কে সূত্র বলেছেন, দৃশ্যত খুনি নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেখান থেকে অনায়াসে পালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে সে পেছন দিকের জরুরি এক্সিট ব্যবহার করে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তার আগে সে ফেলে যায় তার ইলেক্ট্রিক করাত। এই করাত দিয়েই সে ফাহিম সালেহকে হত্যা করে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে।
অন্য সূত্রগুলো দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট-কে বলেছেন, ওই এপার্টমেন্টে গিয়ে কলিংবেল চাপেন ফাহিমের বোন। এটা খুনির জন্য ছিল একটি সতর্ক সংকেত। ফলে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সিঁড়িপথে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পুলিশ সূত্রগুলো শুধু মনে করছে, এই হত্যার পেছনে আর্থিক কোনো কারণ থাকতে পারে। তবে তারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলে নি।
ওদিকে ফাহিম সালেহ’র এক বন্ধু বলেছেন, ঘটনার সময় ওই এপার্টমেন্টের আশপাশের প্রতিবেশীরা আর্তনাদ, তীব্র শব্দ শুনতে পেয়েছেন। তবে তারা কেউই জরুরি সেবার ৯১১ নম্বরে কল করেন নি। পুলিশ বলছে, সিসিটিভি ফুটেজে সন্দেহজনক খুনিকে সালেহ’র সঙ্গে সোমবার (১৩ জুলাই) ভবনে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তারা একসঙ্গে লিফটে উঠেছে। এরপর সালেহ’র সঙ্গে তার বাসায় প্রবেশ করেছে খুনি। পুলিশ বলেছে, আমাদের মনে হচ্ছে তার উদ্দেশ্য ছিল হত্যার পর মৃতদেহের অংশগুলো সরিয়ে ফেলে সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলা, যাতে কেউ বুঝতে না পারে কি ঘটেছে। কিন্তু সে তার কাজ সম্পন্ন করার আগেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
নিউইয়র্ক পোস্টকে সূত্রগুলো বলেছেন, ফাহিম সালেহ’র সপ্তম তলার এপার্টমেন্টে একসঙ্গে আরোহণ করে খুনি। তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিলেন সালেহ। সালেহ’র এপার্টমেন্টের দরজা লিফট বরাবর। লিফটের দরজা খুললেই তার দরজা। ফলে লিফট থেকে সালেহ পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আক্রমণ শুরু হয়। ফুটেজে দেখা গেছে, গুলি করার পর অথবা হতভম্ব হয়ে মেঝেতে পড়ে যান সালেহ। এরপরই তার ওপর পুরোপুরি আক্রমণ শুরু হয়। এরপর পুলিশ সালেহ’র হাঁটুর নিচের অংশ আলাদা করা অবস্থায় পেয়েছে। দুটি হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পেয়েছে। শরীরের আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছিল। তবে বিস্ময়ের বিষয় হলো, সেখানে খুব সামান্যই রক্ত ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, প্রমাণ রেখে যেতে চায় নি খুনি। পুলিশ এখন জানার চেষ্টা করছে, সালেহ’র বোন ওই এপার্টমেন্টে আসায় খুনি তার রক্তের হোলিখেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কিনা। গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন, খুনি এক্সিট ডোর ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে কিনা। এনওয়াইপিডির মুখপাত্র সার্জেন্ট কার্লোস নিয়েভেস বলেছেন, আমরা শুধু সালেহ’র মৃতদেহটা পেয়েছি। এতে মাথা, হাত এবং পা নেই। তবে সবই ওই ঘটনাস্থলে ছিল। কী কারণে হত্যা করা হয়েছে বলতে পারছি না।
উল্লেখ্য, ফাহিম সালেহ সৌদি আরবে এক বাংলাদেশী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তিনি বড় হন নিউইয়র্কে। গত বছর ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার দিয়ে কিনেছেন বিলাসবহুল ওই এপার্টমেন্ট। এটা কিনতে পেরে তিনি ছিলেন গর্বিত। মাঝে মধ্যেই এর বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করতেন। লিঙ্কডইনে তার প্রোফাইলে বলা হয়েছে, তিনি নাইজেরিয়ার লাগোসে একটি মোটরবাইক কোম্পানিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। এর আগে তিনি ছিলেন একজন ওয়েব ডেভেলপার। নাইজেরিয়ায় তার কোম্পানির নাম ছিল গোকোডো। নাইজেরিয়া সরকার এ বছর শুরুর দিকে তা বন্ধ করে দেয়। ফলে বড় একটি ধাক্কা লাগে এতে তার। বাধ্য হয়ে লে-অফ ঘোষণা করেন। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসকে পরিণত করেন ডেলিভারি কুরিয়ারে। ২০১৯ সালের মে মাসে সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রাইজ ক্যাপিটাল থেকে তিনি ৫৩ লাখ ডলার সংগ্রহ করেন গোকোডোর জন্য। কিন্তু তার সেই সেবা বন্ধ করে দেয়ায় তিনি বিরাট সমস্যায় পড়েন। এর ফলে ওই অর্থ ঋণ নেয়া বন্ধ করে দেন। গোকোডো ব্যবহার করেন যে প্রায় ৮০০ বাইকার তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে লে-অফ দেয়া হলো।
মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বিকালেই বন্ধুরা সালেহ’র এপার্টমেন্টে যান দেখতে। এ সময় এক দম্পতি বলেন, সালেহকে টার্গেট করা হয়ে থাকতে পারে। এক বন্ধু বলেছেন, তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, খুবই স্মার্ট এবং নরম মনের। সব সময় হাসতেন। তিনি নিজে নিজেই মিলিয়নিয়ার হয়েছেন। নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অনুন্নত দেশগুলোতে তিনি পৌঁছে দিতেন প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি। তবে কারো কাছ থেকে কোনো হুমকির কথা তিনি কখনো বলেন নি।
মঙ্গলবার রাতে অনলাইনে সালেহ’র প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে থাকেন অসংখ্য মানুষ। টরোন্টোতে বসবাসকারী একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লিখেছেন, শান্তিতে ঘুমাও ফাহিম সালেহ। তার পরিবার ও বন্ধুদের জন্য গভীর শোক। দিনের পর দিন পৃথিবীটা অমানবিক হয়ে উঠছে। ফাহিমের বন্ধুরা বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ফাহিম ছিলেন ইলন মাস্কের মতো।