নিউইয়র্ক ১১:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আকাশ ছোঁয়া হল না ফাহিমের

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:০১:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০
  • / ১১৯ বার পঠিত

হাসান আকবর: শুধু একগুচ্ছ স্বপ্নই নয়, একটি সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটিয়েছে খুনীর দল। তারা টুকরো টুকরো করে কেটেছে একটি শরীর। আর একই সাথে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে মা-বাবার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। বোনের আশা, ভরসা। আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিল ফাহিমের। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই স্বপ্নকে মুঠোয় ভরতে শুরুও করেছিলেন। কিন্তু তার সব স্বপ্ন, সব আশা ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে খুনীর দল। সম্ভাবনার বরপুত্র বাংলাদেশী এই তরুণকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক দ্ব›েদ্বর জের ধরে নাইজেরিয়ার পেশাদার খুনীর দল তাকে খুন করেছে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকা ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এই হত্যাকান্ড ঘটে। ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে খুন করা হয় জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পাঠাও’র সহ প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে।
ফাহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে। স›দ্বীপের হরিশপুর গ্রামের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালাহউদ্দিন আহমেদ বিশ্বখ্যাত আইবিএম কর্পোরেশনের এডভাইজার হিসেবে আমেরিকায় চাকরি করতেন। আইবিএম থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন নিউইয়র্ক থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার উত্তরের ডাচেস কাউন্টির ফুকেটসি এলাকায়। স্ত্রী রায়হানা, দুই কন্যা এ্যাঞ্জেলা ও রুবি এবং একমাত্র পুত্র ফাহিম সালেহকে নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের চমৎকার সুখী সংসার। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সালাহউদ্দিন আহমেদ স›দ্বীপের মানুষ আর স্ত্রী রায়হানা নোয়াখালীর। ফাহিমের জন্ম এবং বেড়ে উঠা যুক্তরাষ্ট্রেই। স্কুল এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া অত্যন্ত সফলতার সাথে শেষ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
পারিবারিক সূত্রগুলো বুধবার (১৫ জুলাই) জানায়, ফাহিম ২০০৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর থেকে চাকরি খুঁজছিলেন। নিউইয়র্কের পাশাপাশি তিনি বোস্টনের বিভিন্ন কোম্পানিতেও চাকরির আবেদন করেন। ওই সময় তিনি চাকরিও পেয়ে যান। কিন্তু জন্ম থেকে নিউইয়র্কের সাথে অন্যরকমের এক মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া ফাহিম বিশ্বের নিউইয়র্ক শহর ছাড়তে চাননি। তাই বোস্টনের খ্যাতনামা একটি কোম্পানির অ্যাপয়নমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পর যোগদান করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি তৈরি করেন প্রাংক ডায়াল ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইটটি খুবই অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে। দুনিয়ার নানা দেশের হাজারো মানুষ প্রাংক কল কেনার জন্য শত শত ডলার খরচ করতে থাকেন। এই সময় বেশ কিছু ওয়েব এডও তৈরি করেছিলেন তিনি। ইনফরমেশন টেকনোলজিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ফাহিম সালেহর সঙ্গে নাইজেরিয়ার এক তরুণও লেখাপড়া করতেন। দু’জনে মিলে ২০টি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। কিশোরদের জন্য তৈরি করা এসব ওয়েব থেকে বছরে অন্তত তিন লাখ ডলার আয় হতো তাদের যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির। প্রাংক ডায়ালের মতো ওয়েব ডেভলপ করে এই কোম্পানির আয় রাতারাতি বেড়ে যায়। দু’হাতে প্রচুর ডলার আসতে থাকে ফাহিমের। তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে পুরোপুরি ওয়েব ডেভলপার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কোম্পানির সমৃদ্ধিতে আতœনিয়োগ করেন ফাহিম।
মা-বাবা, বোন ও ভগ্নিপতির সাথে ফাহিম সালেহ (সর্ব বামে)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত
ফাহিমের চাচাত ভাই, চ্যানেল আই’র সিনিয়র প্রডিউসার মোহাম্মদ শওকত আলী জানান, ফাহিম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, ভদ্র এবং সজ্জন। ২০১৪ সালে দেশে এসেছিলেন ফাহিম। ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে। পাঠাও’র বিকাশে নানাভাবে কাজ করেন। প্রথমদিকে পাঠাও দিয়ে ডিজিটাল ডেলিভারির কথা থাকলেও পরবর্তীতে পাঠাও-কে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন।
টেক দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ফাহিম সালেহর মাথা ভর্তি ছিল নিত্যনতুন উদ্ভাবনী আইডিয়া। এজন্য তাকে বিশেষ কদরও করতেন এই দুনিয়ার রতি মহারথিরা। কাড়ি কাড়ি ডলার আসতো তার একাউন্টে। প্রচুর অর্থ খরচ করতেন নিজের জন্য। পরিবারের জন্য। পিতা মাতার অসম্ভব ভক্ত ছিল ফাহিম। পিতা সালাহউদ্দীন আহমেদের গত জন্মদিনে সাড়া জাগানো একটি টেসলা গাড়ি উপহার দেন তিনি। বিদ্যুৎ চালিত এই গাড়ি এখন দুনিয়ার গাড়ি প্রেমিদের নিকট অন্যতম আকর্ষণীয় কার হিসেবেও বিবেচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও, নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া ও আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নাইজেরিয়ায় চালু করা ওকাডা ওই দেশের বর্তমান সময়কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং এ্যাপ। অত্যন্ত মেধাবী ফাহিম সালেহর স্বপ্ন ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপসকে ভিন্নমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। তার আশা ছিল ইন্দোনেশিয়ার ওজেকের মতো পাঠাও’ও একদিন দারুণ এক সুপার অ্যাপে পরিণত হবে। শুধু রাইড শেয়ারিংই নয়, পেমেন্ট এবং ই-কর্মাসও করা যাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। এজন্য নানাভাবে কাজ করছিলেন তিনি। অ্যাপসের মানোন্নয়নে রাতে দিনে পরিশ্রম করছিলেন। নিউইয়র্ক শহরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফাহিম সালেহ। পিতা-মাতা নিউইয়র্ক থেকে দেড়শ’ মাইল দূরে থাকেন। অথচ ফাহিমকে প্রতিদিনই ছুটতে হয় নিউইয়র্কে। তাই ছোটাছুটি না করে মন দিয়ে কাজ করে অ্যাপসের উন্নতি ঘটানোর জন্য তিনি বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় বিশ কোটি টাকা (২২ লাখ ডলার) দিয়ে কিনেন একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। নিউইয়র্কের অন্যতম অভিজাত এলাকা ম্যানহাটনে নিজের রোজগারের টাকা দিয়েই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটে একা বসবাস করে অ্যাপস নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করতেন তিনি। ঘাতকের দল সেই ফ্ল্যাটেই সম্ভাবনার এই বরপুত্রকে নির্মমভাবে খুন করে।
দৈানক আজাদী’র প্রথম পাতায় ফাহিম সালেহ’র খুন বিষয়ে বিশেষ রিপোর্ট
ফাহিম সালেহর পারিবারিক সূত্র জানায়, ভাইকে না দেখে ফাহিম সালেহর বোন ৯১১ এ ফোন করেন। ফোন পেয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ ম্যানহাটনের ওই ফ্ল্যাটে যায়। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে একটি মস্তকবিহীন দেহ পড়ে থাকেত দেখেন। এমনকি হাত এবং পা গুলোও শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল। মৃতদেহের পাশেই পড়েছিল একটি ইলেক্ট্রিক করাত। এছাড়া কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগেও ফাহিমের শরীরের খন্ডবিখন্ড কয়েকটি অংশ পাওয়া যায়। তার শরীরের সবগুলো অংশই পাওয়া গেছে। খুনীরা নির্মমভাবে তাকে খুন করে ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। সবগুলো টুকরোই ড্রয়িংরুমে ফেলে রেখে খুনী ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেছে। কী কারণে ফাহিম সালেহকে এমন নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে তা গতরাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ফাহিম সালেহর বাবা সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদ্বৃতি দিয়ে পারিবারিক একটি সূত্র জানায়, ফাহিম গত কিছুদিন ধরে পিতার কাছে তার নাইজেরিয়ান পার্টনারের ব্যাপারে নানা কথা বলতেন। নাইজেরিয়ানেরা অত্যন্ত রাফ এবং তাদের সাথে ব্যবসা করা কঠিন বলেও তিনি পিতার কাছে আক্ষেপ করছিলেন। ফাহিমের খুনীদের গ্রেপ্তার এবং ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নিউইয়র্ক পুলিশ কাজ করছে বলেও পারিবারিক সূত্রটি জানিয়েছে।
পুলিশের উদ্বৃতি দিয়ে পারিবারিক সূত্র আরো জানায়, ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে। যাতে সোমবার (১৩ জুলাই) দুপুরে স্যুট পরিহিত এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তার হাতে মোজা, মাথায় হ্যাট ও মুখে মাস্ক পরা ছিল। লোকটির হাতে একটি স্যুটকেসও ছিল। পেশাদার একজন খুনী এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও পুলিশ প্রাথমিকভাবে মন্তব্য করেছে।
ফাহিম সালেহকে উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘ইলন মাস্ক’ বলা হতো বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কের প্রবাসী সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম বাচ্চু। বুধবার আলাপকালে চট্টগ্রামের এই সাংবাদিক বলেন, ফাহিম সালেহ আইটি জগতে বাংলাদেশের ইমেজকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে উন্নয়নশীল দেশের ইলন রিভ মাস্ক হিসেবে বিবেচনা এবং সম্মান করা হতো। খুনীরা একটি অপার সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিল বলেও সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম বাচ্চু মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গতঃ ইঞ্জিনিয়ার ইলন রিভ মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকার একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহনকারী এই প্রকৌশলী বিশ্বের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি খাতের কৃতি উদ্যোক্তা। তিনি মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএঙের সিইও এবং সিটিও, বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরসের সিইও ও পণ্য প্রকৌশলী, সোলার সিটির চেয়ারম্যান ও পেপ্যালের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার মোট সম্পদের পরিমান প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। ফাহিম সালেহর ভিতরে একদিন ইলন মাস্ক-কে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সম্ভাবনা ছিল বলেও সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের অত্যন্ত মেধাবী এবং সম্ভাবনাময় যুবক ফাহিম সালেহর নির্মম হত্যাকান্ডে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকের ছায়া বিরাজ করছে স›দ্বীপে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা ছিল ফাহিমের। মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে আইটি দুনিয়ায় শুরু হয়েছিল তার দাপুটে পদচারণা। ঘাতকের দল সব সম্ভাবনার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। (দৈনিক আজাদী)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আকাশ ছোঁয়া হল না ফাহিমের

প্রকাশের সময় : ১০:০১:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই ২০২০

হাসান আকবর: শুধু একগুচ্ছ স্বপ্নই নয়, একটি সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটিয়েছে খুনীর দল। তারা টুকরো টুকরো করে কেটেছে একটি শরীর। আর একই সাথে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে মা-বাবার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। বোনের আশা, ভরসা। আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিল ফাহিমের। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই স্বপ্নকে মুঠোয় ভরতে শুরুও করেছিলেন। কিন্তু তার সব স্বপ্ন, সব আশা ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে খুনীর দল। সম্ভাবনার বরপুত্র বাংলাদেশী এই তরুণকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক দ্ব›েদ্বর জের ধরে নাইজেরিয়ার পেশাদার খুনীর দল তাকে খুন করেছে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকা ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এই হত্যাকান্ড ঘটে। ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে খুন করা হয় জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পাঠাও’র সহ প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে।
ফাহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে। স›দ্বীপের হরিশপুর গ্রামের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালাহউদ্দিন আহমেদ বিশ্বখ্যাত আইবিএম কর্পোরেশনের এডভাইজার হিসেবে আমেরিকায় চাকরি করতেন। আইবিএম থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন নিউইয়র্ক থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার উত্তরের ডাচেস কাউন্টির ফুকেটসি এলাকায়। স্ত্রী রায়হানা, দুই কন্যা এ্যাঞ্জেলা ও রুবি এবং একমাত্র পুত্র ফাহিম সালেহকে নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের চমৎকার সুখী সংসার। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সালাহউদ্দিন আহমেদ স›দ্বীপের মানুষ আর স্ত্রী রায়হানা নোয়াখালীর। ফাহিমের জন্ম এবং বেড়ে উঠা যুক্তরাষ্ট্রেই। স্কুল এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া অত্যন্ত সফলতার সাথে শেষ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
পারিবারিক সূত্রগুলো বুধবার (১৫ জুলাই) জানায়, ফাহিম ২০০৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর থেকে চাকরি খুঁজছিলেন। নিউইয়র্কের পাশাপাশি তিনি বোস্টনের বিভিন্ন কোম্পানিতেও চাকরির আবেদন করেন। ওই সময় তিনি চাকরিও পেয়ে যান। কিন্তু জন্ম থেকে নিউইয়র্কের সাথে অন্যরকমের এক মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া ফাহিম বিশ্বের নিউইয়র্ক শহর ছাড়তে চাননি। তাই বোস্টনের খ্যাতনামা একটি কোম্পানির অ্যাপয়নমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পর যোগদান করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যেই তিনি তৈরি করেন প্রাংক ডায়াল ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইটটি খুবই অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে। দুনিয়ার নানা দেশের হাজারো মানুষ প্রাংক কল কেনার জন্য শত শত ডলার খরচ করতে থাকেন। এই সময় বেশ কিছু ওয়েব এডও তৈরি করেছিলেন তিনি। ইনফরমেশন টেকনোলজিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ফাহিম সালেহর সঙ্গে নাইজেরিয়ার এক তরুণও লেখাপড়া করতেন। দু’জনে মিলে ২০টি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। কিশোরদের জন্য তৈরি করা এসব ওয়েব থেকে বছরে অন্তত তিন লাখ ডলার আয় হতো তাদের যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির। প্রাংক ডায়ালের মতো ওয়েব ডেভলপ করে এই কোম্পানির আয় রাতারাতি বেড়ে যায়। দু’হাতে প্রচুর ডলার আসতে থাকে ফাহিমের। তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে পুরোপুরি ওয়েব ডেভলপার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কোম্পানির সমৃদ্ধিতে আতœনিয়োগ করেন ফাহিম।
মা-বাবা, বোন ও ভগ্নিপতির সাথে ফাহিম সালেহ (সর্ব বামে)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত
ফাহিমের চাচাত ভাই, চ্যানেল আই’র সিনিয়র প্রডিউসার মোহাম্মদ শওকত আলী জানান, ফাহিম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, ভদ্র এবং সজ্জন। ২০১৪ সালে দেশে এসেছিলেন ফাহিম। ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে। পাঠাও’র বিকাশে নানাভাবে কাজ করেন। প্রথমদিকে পাঠাও দিয়ে ডিজিটাল ডেলিভারির কথা থাকলেও পরবর্তীতে পাঠাও-কে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন।
টেক দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ফাহিম সালেহর মাথা ভর্তি ছিল নিত্যনতুন উদ্ভাবনী আইডিয়া। এজন্য তাকে বিশেষ কদরও করতেন এই দুনিয়ার রতি মহারথিরা। কাড়ি কাড়ি ডলার আসতো তার একাউন্টে। প্রচুর অর্থ খরচ করতেন নিজের জন্য। পরিবারের জন্য। পিতা মাতার অসম্ভব ভক্ত ছিল ফাহিম। পিতা সালাহউদ্দীন আহমেদের গত জন্মদিনে সাড়া জাগানো একটি টেসলা গাড়ি উপহার দেন তিনি। বিদ্যুৎ চালিত এই গাড়ি এখন দুনিয়ার গাড়ি প্রেমিদের নিকট অন্যতম আকর্ষণীয় কার হিসেবেও বিবেচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও, নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া ও আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নাইজেরিয়ায় চালু করা ওকাডা ওই দেশের বর্তমান সময়কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং এ্যাপ। অত্যন্ত মেধাবী ফাহিম সালেহর স্বপ্ন ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপসকে ভিন্নমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। তার আশা ছিল ইন্দোনেশিয়ার ওজেকের মতো পাঠাও’ও একদিন দারুণ এক সুপার অ্যাপে পরিণত হবে। শুধু রাইড শেয়ারিংই নয়, পেমেন্ট এবং ই-কর্মাসও করা যাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। এজন্য নানাভাবে কাজ করছিলেন তিনি। অ্যাপসের মানোন্নয়নে রাতে দিনে পরিশ্রম করছিলেন। নিউইয়র্ক শহরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফাহিম সালেহ। পিতা-মাতা নিউইয়র্ক থেকে দেড়শ’ মাইল দূরে থাকেন। অথচ ফাহিমকে প্রতিদিনই ছুটতে হয় নিউইয়র্কে। তাই ছোটাছুটি না করে মন দিয়ে কাজ করে অ্যাপসের উন্নতি ঘটানোর জন্য তিনি বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় বিশ কোটি টাকা (২২ লাখ ডলার) দিয়ে কিনেন একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। নিউইয়র্কের অন্যতম অভিজাত এলাকা ম্যানহাটনে নিজের রোজগারের টাকা দিয়েই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটে একা বসবাস করে অ্যাপস নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করতেন তিনি। ঘাতকের দল সেই ফ্ল্যাটেই সম্ভাবনার এই বরপুত্রকে নির্মমভাবে খুন করে।
দৈানক আজাদী’র প্রথম পাতায় ফাহিম সালেহ’র খুন বিষয়ে বিশেষ রিপোর্ট
ফাহিম সালেহর পারিবারিক সূত্র জানায়, ভাইকে না দেখে ফাহিম সালেহর বোন ৯১১ এ ফোন করেন। ফোন পেয়ে নিউইয়র্ক পুলিশ ম্যানহাটনের ওই ফ্ল্যাটে যায়। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে একটি মস্তকবিহীন দেহ পড়ে থাকেত দেখেন। এমনকি হাত এবং পা গুলোও শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল। মৃতদেহের পাশেই পড়েছিল একটি ইলেক্ট্রিক করাত। এছাড়া কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগেও ফাহিমের শরীরের খন্ডবিখন্ড কয়েকটি অংশ পাওয়া যায়। তার শরীরের সবগুলো অংশই পাওয়া গেছে। খুনীরা নির্মমভাবে তাকে খুন করে ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। সবগুলো টুকরোই ড্রয়িংরুমে ফেলে রেখে খুনী ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেছে। কী কারণে ফাহিম সালেহকে এমন নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে তা গতরাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ফাহিম সালেহর বাবা সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদ্বৃতি দিয়ে পারিবারিক একটি সূত্র জানায়, ফাহিম গত কিছুদিন ধরে পিতার কাছে তার নাইজেরিয়ান পার্টনারের ব্যাপারে নানা কথা বলতেন। নাইজেরিয়ানেরা অত্যন্ত রাফ এবং তাদের সাথে ব্যবসা করা কঠিন বলেও তিনি পিতার কাছে আক্ষেপ করছিলেন। ফাহিমের খুনীদের গ্রেপ্তার এবং ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নিউইয়র্ক পুলিশ কাজ করছে বলেও পারিবারিক সূত্রটি জানিয়েছে।
পুলিশের উদ্বৃতি দিয়ে পারিবারিক সূত্র আরো জানায়, ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে। যাতে সোমবার (১৩ জুলাই) দুপুরে স্যুট পরিহিত এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তার হাতে মোজা, মাথায় হ্যাট ও মুখে মাস্ক পরা ছিল। লোকটির হাতে একটি স্যুটকেসও ছিল। পেশাদার একজন খুনী এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও পুলিশ প্রাথমিকভাবে মন্তব্য করেছে।
ফাহিম সালেহকে উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘ইলন মাস্ক’ বলা হতো বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কের প্রবাসী সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম বাচ্চু। বুধবার আলাপকালে চট্টগ্রামের এই সাংবাদিক বলেন, ফাহিম সালেহ আইটি জগতে বাংলাদেশের ইমেজকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে উন্নয়নশীল দেশের ইলন রিভ মাস্ক হিসেবে বিবেচনা এবং সম্মান করা হতো। খুনীরা একটি অপার সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিল বলেও সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম বাচ্চু মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গতঃ ইঞ্জিনিয়ার ইলন রিভ মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকার একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহনকারী এই প্রকৌশলী বিশ্বের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি খাতের কৃতি উদ্যোক্তা। তিনি মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএঙের সিইও এবং সিটিও, বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা মোটরসের সিইও ও পণ্য প্রকৌশলী, সোলার সিটির চেয়ারম্যান ও পেপ্যালের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার মোট সম্পদের পরিমান প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। ফাহিম সালেহর ভিতরে একদিন ইলন মাস্ক-কে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সম্ভাবনা ছিল বলেও সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের অত্যন্ত মেধাবী এবং সম্ভাবনাময় যুবক ফাহিম সালেহর নির্মম হত্যাকান্ডে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকের ছায়া বিরাজ করছে স›দ্বীপে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা ছিল ফাহিমের। মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে আইটি দুনিয়ায় শুরু হয়েছিল তার দাপুটে পদচারণা। ঘাতকের দল সব সম্ভাবনার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। (দৈনিক আজাদী)