স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ আর নেই

- প্রকাশের সময় : ১১:২৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই ২০২০
- / ১৭৮ বার পঠিত
হককথা রিপোর্ট: বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, টাঙ্গাইলের কৃতিসন্তান জননেতা শাহজাহান সিরাজ (৭৭) আর নেই। আজ মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) বেলা ৩.৩০ টায় (বাংলাদেশ সময়) রাজধানী ঢাকার এভার কেয়ার নামক একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিলেন। তার ইন্তেকালে দেশ, জাতি এক গর্বিত সন্তান হারালো। সমাপ্তি ঘটলো এক জীবন্ত ইতিহাসের। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের মৃত্যুতে দেশবাসীসহ প্রবাসী বাংলাদেশীরা শোকাহত। তাঁর ইন্তেকালে সর্বস্তরের মানুষ গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছে।
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, বুধবার বেলা ১১টায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় তাঁর প্রথম জানাজা, বাদ জোহর কালীহাতি উপজেলায় দ্বিতীয় জানাজা হবে। পরবর্তীতে বুধবার বাদ এশা গুলশান সোসাইটি জামে মসজিদে তৃতীয় জানাজার পর বনানী কবরস্থানে শাহজাহান সিরাজের মরদেহ দাফন করা হবে।
স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী শাহজাহান সিরাজ দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ২০১২ সালে তাঁর ফুসফুসে, এরপর মস্তিষ্কে ক্যানসার ধরা পড়ে। অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। অনেক দিন ধরে তিনি হাসপাতালে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন। গতকাল সোমবার (১৩ জুলাই) অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এভার কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ, মেয়ে সারওয়াত সিরাজ ও ছেলে রাজীব সিরাজকে রেখে গেছেন। রাজীব সিরাজ দেশের বাইরে আছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকরত অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে শাহজাহান সিরাজ (বা থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত: জননেতা শাহজাহান সিরাজ-এর জন্ম: ১ মার্চ, ১৯৪৩। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম ছাত্রনেতা। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ৩ বার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর মনোনয়নে এবং ১ বার বিএনপি’র মনোনয়নে জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহজাহান সিরাজ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
বা থেকে শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। ছবি: সংগৃহীত
শাহজাহান সিরাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ‘চার খলিফা’ বলা হতো শাহজাহান সিরাজ ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। সেখান থেকেই পরবর্তী দিনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্র জনসভায় বঙ্গবন্ধু’র সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাজাহান সিরাজ। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এক বিশেষ মুহূর্তে আ স ম আবদুর রব-এর সাথে শাহজাহান সিরাজ। ছবি: সংগৃহীত
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে শাহজাহান সিরাজ ছাত্র-রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সেই সময় তিনি ‘বাংলার আলীড়গ’ নামে খ্যাত টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র-রাজনীতিতে উঠে আসেন। ১৯৬৪-৬৫ এবং ১৯৬৬-৬৭ দুই মেয়াদে তিনি দুইবার সা’দাত কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যত্থানে অংশগ্রহন করেন। এরপর তিনি ১৯৭০-৭২ মেয়াদে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ (যার অন্য নাম নিউক্লিয়াস) এর সক্রিয় কর্মী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সর্বদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। পরবর্তীতে জাসদ ভেঙ্গে গেলে তিনি একাংশের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাসদের মনোনয়নে ৩ বার তিনি জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
শাহজাহান সিরাজ ১৯৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির মনোনয়নেও একবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়া সরকারের শেষ পর্যায়ের দিকে নৌপরিবহন মন্ত্রি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ কেন্দ্রীয় বিএনপি’র নেত্রী।