আওয়ামী লীগের জন্ম ও প্রসঙ্গ কথা

- প্রকাশের সময় : ০২:৫৫:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুন ২০২০
- / ১৪৯ বার পঠিত
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের যেদিন জন্ম হয়, মওলানা ভাসানী সেদিন আসামের কারাগারে। স্বাধীন পাকিস্তানে ফিরেই তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে ঢাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইষ্ট হাউসের দক্ষিণ দিকের মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দান করেন। একই বছর পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিষদ অধিবেশনে তিনি বাংলায় কথা বলার দাবী উত্থাপন করেন। ১৯ মার্চ বাজেট অধিবেশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, “আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?”
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ও ২৪ জুন মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ তরুণ কর্মীদের নিয়ে ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলন আহবান করেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন বিকেলে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মীদের বিদ্রোহী গ্রæপের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা ভাসানী। শেরে বাংলা ফজলুল হকও কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়ে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ দিয়েছিলেন। সভায় উপস্থিত প্রায় শ’তিনেক প্রতিনিধির সম্মতিতে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সহ-সভাপতি যথাক্রমেঃ আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ এমএলএ, আলী আমজাদ খান এবং আবদুস সালাম খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, সহ-সম্পাদক যথাক্রমেঃ শেখ মুজিবুর রহমান, খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ ও এ কে রফিকুল হোসেন, কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান, সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ প্রমূখ। ২৪ জুন সদ্যগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় আরমানিটোলা মাঠে। সভায় সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী সরকারের বাইশ মাসের অপকীর্তির খতিয়ান তুলে ধরে সবাইকে আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহবান জানান। ১১ অক্টোবর আরমানিটোলা মাঠের আরেক জনসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যসমস্যা সমাধানে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের ব্যর্থতার জন্য তাঁর পদত্যাগ দাবী করে বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবীতে ভুখামিছিল বের করলে ১৩ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ২৪ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী আবারও আরমানিটোলা ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দান করেন। ঐ দিন একই সময়ে পল্টন ময়দানে লিয়াকত আলীর জনসভায় হাতেগোনা মানুষের উপস্থিতি তখনকার সময়ে মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা জানান দেয়।
১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ৬ ফেব্রæয়ারী অনুষ্ঠিত কর্মপরিষদের সভায় চিরবিদ্রোহী ভাসানী ঐ দিন (২১ তারিখ) ১৪৪-ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দান করেন। ২১ ফেব্রæয়ারী শহীদানের ঘটনায় ২২ ফেব্রæয়ারী তিনি নিহতদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাযায় ইমামতি করেন এবং মোনাজাতের সময় পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে ক্রোধে ফেটে পরেন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনটিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিতে পরিণত করার প্রস্তাব রাখেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব দ্বিমত পোষণ করলেও শেখ মুজিব তাঁর প্রস্তাবকে জোড়ালো সমর্থন দান করেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন সম্পর্কে একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, “মওলানা ভাসানীর বর্ণনাতীত ও অপরিসীম ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমই আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে সক্ষম করে। অত্যাচারী জালেম মুসলিম লীগ সরকারের আমলে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সরকারী চাকরী এডভোকেট জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন। জনাব আতাউর রহমান খান স্বীয় ওকালতি পেশায় অধিকাংশ সময়ই মগ্ন ও স্বীয় পরিবার পরিজনদের তত্ত¡বাবধানে ব্যস্ত ছিলেন। অবসর সময়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেন। ফলে সরকারী অত্যাচার, নির্যাতন, জেল, জুলুম, আর্থিক কষ্টভোগ সবকিছুই সহ্য করতে হইত সর্বত্যাগী মওলানা ভাসানীকেই। মজলুম নেতার উপযুক্ত পার্শ্বচর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তরুণ নেতা শামসুল হক ও যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে ঢাকা কারাগারে আটকাবস্থায় জনাব শামসুল হক মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলেন ও মানসিক ব্যধিগ্রস্ত অবস্থায় কারামুক্তি লাভ করেন। জনাব শামসুল হক ১৯৫২ সালে কারান্তরালে থাকা বিধায় যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে সভাপতি মওলানা ভাসানীর অনুরোধক্রমে জনাব শামসুল হকের স্থলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।” ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ৫৪’র অগ্নিপরীক্ষার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৩ আসনে জয়লাভ করে।
১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের ২য় কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন মওলানা ভাসানী। এই অধিবেশনেই দলের নাম ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়।
[তথ্য সূত্রঃ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ।]