নিউইয়র্ক ০১:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কোভিড-১৯ জয়ী ইলিয়াস খসরু বলছি…

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:২৮:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মে ২০২০
  • / ১৩৫ বার পঠিত

হককথা ডেস্ক: করোনাভাইরাস সহ একাধিক শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ এক মাস হাসপাতালে থেকে পরম করুনাময় আল্লাহর অসীম রহমত, নিজের ভাগ্য আর পরিবারে-পরিজন সহ শুভাকাঙ্খীদের দোয়ায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। আমি মৃত্যু কি তা দেখে এসেছি। আমি আমার সন্তানদের জন্যই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। সেই সাথে দেশ ও প্রবাসের প্রিয়জন আর শুভাকাঙ্খীদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। জীবনের বাকী সময়টা আমি মানবতার সেবায় কাটিয়ে দিতে চাই।

হুইল চেয়ারে করে ঘরে ফেরার দিনটি আমার জন্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অনুভূতির। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার কান্নার মধ্যে নিজেও স্থির থাকতে পারছিলাম না। আমি বাসায় বিশ্রামে আছি। চিকিৎসক সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন। একেবারে সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে।
আমি গত ফেব্রæয়ারীর মাঝামাঝি সপরিবারে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব যাই। ফিরে আসি ২৮ ফেব্রæয়ারী। তখনো নিউইয়র্কে করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো খবর ছিল না। সৌদী আরব থেকে ফিরে আসার ৪/৫ দিন পরই অসুস্থ বোধ করি। শরীরে ব্যথা, জ্বর ও কাঁশিতে কাবু হয়ে পড়লে ব্রæকলীনের ব্রæকডিল হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে এসে আবার অসুস্থবোধ করি। পরবর্তীতে ম্যানহাটানের কর্নেল হাসপাতালে যাই গত ৯ মার্চ। কর্নেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব হয়। একথা শুনে ছেলে নাদের স্যান্ডউইচ কিনে এনে দেয়। সেই খাবার খাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। এর পরের ঘটনা আর আমার মনে নেই।
হাসপাতালে আমাকে এক মাসেরও বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছে। এত দিন ভেন্টিলেশনে থাকা এমন মাত্র দু’জন রোগী করোনা জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বলে শুনেছি। চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছিলেন আমার শরীরের সব ফাংশন বিকল হয়ে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ও পালস বন্ধ হয়ে পড়েছে। আমার পরিবারের কাছে ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চেয়ে হাসপাতাল থেকে ফোন করাও হয়েছিল। কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি। পরদিন হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, আমি বেঁচে আছি, আমাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। তবে নতুন করে চিকিৎসার কিছু নেই। আমার বেঁছে থাকাটা মিরাকল ছাড়া কিছু নয়। যিনি জীবন দিয়েছেন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি। অবশেষে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি।
হাসপাতালে যাওয়ার ১০ দিন পরে আমার একবার চেতনা ফিরে আসে। এ সময় মনে হয় , হাত-পা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে। একজন চিকিৎসক আমাকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি জানান। এ সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। আমাকে কথা বলতেও বারণ করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার আগে শুধু শুনেছিলাম, চীনে এমন একটা রোগে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ খবর শুনে আমি পরিবারের লোকজনের কথা জানতে চাই। এ রোগে কেউ আমার কাছে আসতে পারবে না বলে জানানো হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সরাই আমার সর্বোচ্চ সেবা করেছেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার অচেতন হয়ে যাই আমি। এভাবে মাস চলে যায়। ছেলে সৈয়দ নাদের হাসপাতালে যোগাযোগ রাখে। তাকে শুধু জানানো হয়, আমার অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। একপর্যায়ে জানানো হয় আমার কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করছে না। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশনে থাকা মানুষের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। এতে আমার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। আমার জন্য দেশে গ্রামের বাড়িতে লোকজন প্রার্থনা করতে থাকেন। এর মধ্যেই এক রাতে জানানো হয় আমার শরীরের সব কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে গেছে। ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চান চিকিৎসকেরা। তবে ভেন্টিলেশন না খোলার অনুরোধ জানিয়ে বুকে পাথর বাঁধে আমার পরিবার। হাসপাতাল থেকেও এ নিয়ে আর কোনো জোর করা হয়নি। চিকিৎসকদের বিস্মিত করে কয়েক ঘণ্টা পরই আমি নাকি একটু নড়ে চড়ে ওঠি। এরপরের দিনগুলোতে আমার শরীরের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়। পরে আবার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকেরা আর কোনো আশার কথা শোনাতে পারেন না। মধ্য এপ্রিলের দিকে একবার চেতনা ফেরে আমার। চিকিৎসকেরা আবার উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বারবার এসে দেখতে থাকেন আমাকে।
একমাস পর আমার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় কাউকে চিনতে পারিনি আমি। সব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক কিং ও মাইকসন মাথায় হাত দিয়ে আমাকে জানান, তুমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছ। তুমি এঞ্জেল। এক মাসের বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থেকে এর আগে এই হাসপাতাল থেকে আর একজন রোগী এভাবে ফিরে এসেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম চিকিৎসকদের। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, আমরা তোমার জন্য কিছুই আলাদা করে করিনি। এ জীবন যিনি সৃষ্টি করেছেন বলে তুমি বিশ্বাস করো, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাও। আমি হাসপাতালেও বাংলাদেশি সৌজন্যতা ভুলে যায়নি। আমি চিকিৎসকদের কথা দিয়েছি সব ভালো হয়ে গেলে নিজে রান্না করে আমেরিকার এই চিকিৎসকদের দাওয়াত করে খাওয়াবো। এই কথা শুনে দুই চিকিৎসক ও নার্স কেঁদেছিলেন। এ ছিল তাদের খুশির কান্না। (প্রসঙ্গত: সৈয়দ ইলিয়াস খসরু টাইম টেলিভিশনের আউটরিচ ডিরেক্টর ও একজন কমিউনিটি নেতা।) -সাপ্তাহিক নবযুগ

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

কোভিড-১৯ জয়ী ইলিয়াস খসরু বলছি…

প্রকাশের সময় : ১০:২৮:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মে ২০২০

হককথা ডেস্ক: করোনাভাইরাস সহ একাধিক শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ এক মাস হাসপাতালে থেকে পরম করুনাময় আল্লাহর অসীম রহমত, নিজের ভাগ্য আর পরিবারে-পরিজন সহ শুভাকাঙ্খীদের দোয়ায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। আমি মৃত্যু কি তা দেখে এসেছি। আমি আমার সন্তানদের জন্যই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। সেই সাথে দেশ ও প্রবাসের প্রিয়জন আর শুভাকাঙ্খীদের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। জীবনের বাকী সময়টা আমি মানবতার সেবায় কাটিয়ে দিতে চাই।

হুইল চেয়ারে করে ঘরে ফেরার দিনটি আমার জন্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অনুভূতির। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার কান্নার মধ্যে নিজেও স্থির থাকতে পারছিলাম না। আমি বাসায় বিশ্রামে আছি। চিকিৎসক সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন। একেবারে সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে।
আমি গত ফেব্রæয়ারীর মাঝামাঝি সপরিবারে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব যাই। ফিরে আসি ২৮ ফেব্রæয়ারী। তখনো নিউইয়র্কে করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো খবর ছিল না। সৌদী আরব থেকে ফিরে আসার ৪/৫ দিন পরই অসুস্থ বোধ করি। শরীরে ব্যথা, জ্বর ও কাঁশিতে কাবু হয়ে পড়লে ব্রæকলীনের ব্রæকডিল হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে এসে আবার অসুস্থবোধ করি। পরবর্তীতে ম্যানহাটানের কর্নেল হাসপাতালে যাই গত ৯ মার্চ। কর্নেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব হয়। একথা শুনে ছেলে নাদের স্যান্ডউইচ কিনে এনে দেয়। সেই খাবার খাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। এর পরের ঘটনা আর আমার মনে নেই।
হাসপাতালে আমাকে এক মাসেরও বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থাকতে হয়েছে। এত দিন ভেন্টিলেশনে থাকা এমন মাত্র দু’জন রোগী করোনা জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বলে শুনেছি। চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছিলেন আমার শরীরের সব ফাংশন বিকল হয়ে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ও পালস বন্ধ হয়ে পড়েছে। আমার পরিবারের কাছে ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চেয়ে হাসপাতাল থেকে ফোন করাও হয়েছিল। কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি। পরদিন হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, আমি বেঁচে আছি, আমাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। তবে নতুন করে চিকিৎসার কিছু নেই। আমার বেঁছে থাকাটা মিরাকল ছাড়া কিছু নয়। যিনি জীবন দিয়েছেন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি। অবশেষে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি।
হাসপাতালে যাওয়ার ১০ দিন পরে আমার একবার চেতনা ফিরে আসে। এ সময় মনে হয় , হাত-পা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে। একজন চিকিৎসক আমাকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি জানান। এ সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। আমাকে কথা বলতেও বারণ করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার আগে শুধু শুনেছিলাম, চীনে এমন একটা রোগে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ খবর শুনে আমি পরিবারের লোকজনের কথা জানতে চাই। এ রোগে কেউ আমার কাছে আসতে পারবে না বলে জানানো হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সরাই আমার সর্বোচ্চ সেবা করেছেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার অচেতন হয়ে যাই আমি। এভাবে মাস চলে যায়। ছেলে সৈয়দ নাদের হাসপাতালে যোগাযোগ রাখে। তাকে শুধু জানানো হয়, আমার অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। একপর্যায়ে জানানো হয় আমার কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করছে না। দীর্ঘদিন ভেন্টিলেশনে থাকা মানুষের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। এতে আমার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। আমার জন্য দেশে গ্রামের বাড়িতে লোকজন প্রার্থনা করতে থাকেন। এর মধ্যেই এক রাতে জানানো হয় আমার শরীরের সব কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে গেছে। ভেন্টিলেশন খুলে ফেলার অনুমতি চান চিকিৎসকেরা। তবে ভেন্টিলেশন না খোলার অনুরোধ জানিয়ে বুকে পাথর বাঁধে আমার পরিবার। হাসপাতাল থেকেও এ নিয়ে আর কোনো জোর করা হয়নি। চিকিৎসকদের বিস্মিত করে কয়েক ঘণ্টা পরই আমি নাকি একটু নড়ে চড়ে ওঠি। এরপরের দিনগুলোতে আমার শরীরের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়। পরে আবার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকেরা আর কোনো আশার কথা শোনাতে পারেন না। মধ্য এপ্রিলের দিকে একবার চেতনা ফেরে আমার। চিকিৎসকেরা আবার উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বারবার এসে দেখতে থাকেন আমাকে।
একমাস পর আমার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় কাউকে চিনতে পারিনি আমি। সব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক কিং ও মাইকসন মাথায় হাত দিয়ে আমাকে জানান, তুমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছ। তুমি এঞ্জেল। এক মাসের বেশি সময় ভেন্টিলেশনে থেকে এর আগে এই হাসপাতাল থেকে আর একজন রোগী এভাবে ফিরে এসেছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম চিকিৎসকদের। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, আমরা তোমার জন্য কিছুই আলাদা করে করিনি। এ জীবন যিনি সৃষ্টি করেছেন বলে তুমি বিশ্বাস করো, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাও। আমি হাসপাতালেও বাংলাদেশি সৌজন্যতা ভুলে যায়নি। আমি চিকিৎসকদের কথা দিয়েছি সব ভালো হয়ে গেলে নিজে রান্না করে আমেরিকার এই চিকিৎসকদের দাওয়াত করে খাওয়াবো। এই কথা শুনে দুই চিকিৎসক ও নার্স কেঁদেছিলেন। এ ছিল তাদের খুশির কান্না। (প্রসঙ্গত: সৈয়দ ইলিয়াস খসরু টাইম টেলিভিশনের আউটরিচ ডিরেক্টর ও একজন কমিউনিটি নেতা।) -সাপ্তাহিক নবযুগ