এনন টেক্সের ৫৭৬৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি : অপসারণ হচ্ছেন জনতা ব্যাংকের এমডি!

- প্রকাশের সময় : ০৮:০৩:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২০
- / ২৭৬ বার পঠিত
‘আমি একা নই, আরও অনেকে জড়িত’ : আব্দুছ ছালাম আজাদ * বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বিশেষ প্রতিবেদন * ভুয়া আমদানি দেখিয়ে ১ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে * ‘অপসারণ যথেষ্ট নয়, ক্রিমিনাল কেস করা উচিত’ : খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
মনির হোসেন ও হামিদ বিশ্বাস: জনতা ব্যাংকের বহুল সমালোচিত এনন টেক্স গ্রুপের ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় বর্তমান এমডি মো. আবদুছ ছালাম আজাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইন-কানুন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রুপটির ঋণের অনুমোদন, বিতরণ এবং পরিবীক্ষণে সহায়তা করেছেন তিনি। তার প্রত্যক্ষ সহায়তায়ই এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানির নামে প্রায় ১ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
ইতিমধ্যে তাকে অপসারণের সুপারিশ করেছে পরিদর্শক দল। বিষয়টির চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার জন্য ব্যাংকিং রেগুলেশন ও পলিসি ডিপার্টমেন্টে (বিআরপিডি) রয়েছে। অন্যদিকে এ ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি আলাদাভাবে তদন্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ওই রিপোর্টেও এমডির সংশ্লিষ্টতার বিষয় উঠে এসেছে।
তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তদন্ত রিপোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপসারণ যথেষ্ট নয়, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ ধরনের অপরাধীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এনন টেক্স গ্রুপের মালিক ইউনূছ বাদল।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এমডি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ সোমবার (২০ জানুয়ারী) নিজ কার্যালয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-কানুন মেনেই এনন টেক্সকে ঋণ দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, সেজন্য আমি একা নই, অনেকেই দায়ী। তার মতে, এ ঘটনায় আরও অনেকের নাম আসা উচিত। এছাড়া এটা অনেক আগের ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কেন তদন্ত করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, ওই সময়ে আমি কর্পোরেট শাখার দায়িত্বে ছিলাম। শাখা ম্যানেজারের ঋণ দেয়ার অনুমতি নেই। আর এমডি সাড়ে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এর চেয়ে বড় ঋণ হলে বোর্ডের অনুমোদন লাগে।
ফলে এনন টেক্সের সব ঋণ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপনের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। তবে অপসারণের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাকে কিছু জানানো হয়নি। চিঠি পেলে জবাব দেবেন মো. আব্দুছ ছালাম।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এনন টেক্সের এই ঋণ জালিয়াতির সময় বর্তমান এমডি শাখা ম্যানেজার ছিলেন। এরপরও কীভাবে সরকার তাকে প্রমোশন দিয়ে এমডি পর্যন্ত নিয়ে আসে, তা বোধগম্য নয়। এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ সংবাদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো তাকে অপসারণের সুপারিশ করবে। কিন্তু এ ঘটনায় অপসারণ যথেষ্ট নয়।
এতে তিনি অপসারণের মাধ্যমে দায়মুক্তি পেয়ে যাবেন। তিনি বলেন, অর্থ জালিয়াতির জন্য তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ক্রিমিনাল কেস করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
দুদকও এ কাজ করতে পারে। সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর বলেন, হয়তো অভিযুক্ত এমডি অপসারণ এড়াতে বিভিন্ন তদবির করছেন। কিন্তু তদবির করে দায়মুক্তি পেলে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি আরও উৎসাহিত হবে।
পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে এনন টেক্সের ২২টি প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাব খোলা হয়। এর মধ্যে কর্পোরেট শাখায় ২০টি এবং লোকাল অফিসে ২টি। ওইসব অ্যাকাউন্টে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপটির ঋণের স্থিতি ছিল ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদন, বিতরণ, পরিবীক্ষণ এবং বারবার পুনঃতফসিলে অনেক গুরুতর অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে।
তড়িঘড়ি করে হিসাব খুলে আলোচ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ব্যাংক কর্তৃক প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদনের পর মঞ্জুরির শর্ত পরিপালন না করে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব কাজ করেছেন ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপক শাখা ম্যানেজার এবং বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ সালাম আজাদ।
১৫টি প্রকল্প দেখিয়ে ঋণ নেয়া হলেও ৯টি প্রকল্প স্থাপনই হয়নি। ফলে ব্যাংক থেকে প্রকল্প সম্পাদন প্রতিবেদন ইস্যু করেনি। এক্ষেত্রে সাজানো দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে এনন টেক্স গ্রুপের প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপনের জন্য বিদেশি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির অর্থ নিজেদের ইনভেনটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয়েছে। এর বড় অংশই পাচার করা হয়েছে।
এসব ঋণ নেয়া ও টাকা পাচারে সরাসরি সহায়তা করেছে ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। অনেক ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের নতুন ঋণের অর্থ অপর প্রতিষ্ঠানের নামে আংশিক পরিশোধ করে খেলাপি না দেখিয়ে ঋণ নিয়মিত দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় পুরোটাই কুঋণে রূপ নিয়েছে।
জানতে চাইলে বিএফআইইউ’র প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, তদন্ত রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে তা আমরা দুদকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পাঠিয়েছি। এরপর আর আমাদের কোনো করণীয় থাকে না। সরকারের অন্যান্য এজেন্সিসহ বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে মামলা করাসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ব্যাংকের লোকাল অফিসের ২টি ও কর্পোরেট অফিসের ২০টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের জামানত ৫৬ একর জমি। ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্য ৬৭৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে স্থাপিত যন্ত্রপাতিসহ মোট সহায়ক জামানতের মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু জমির স্পষ্ট সীমানা না থাকায় এর দাম জানা সম্ভব হয়নি।
ভৌত অবকাঠামোতে ওভারল্যাপিং থাকায় জামানত বিক্রি করে টাকা আদায় সম্ভব নয়। এছাড়া এই ২২টি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ইউনূছ বাদল ও তার সহযোগীর অনেক প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। এতে অনিয়মের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে দেখা গেছে, ৪টি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ইউনূছ বাদল, ৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় তার বড় ভাই মোহাম্মদ ইউসূফ এবং ১১টি প্রতিষ্ঠান তার ব্যবসায়িক সহযোগীদের মালিকানায়। এই অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রায় একই ঠিকানা, ওয়েবসাইট এবং একই ধরনের ইমেইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিদর্শক দল মনে করছে, এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবসাবহির্ভূত লেনদেন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পুনঃতফসিলের অর্থ ইউনূস বাদলের প্রতিষ্ঠান থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরিদর্শনের সময় গ্রুপের কাগজপত্র ও অন্যান্য দলিল চাওয়া হলে ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুসারে কাগজপত্র দেয়া হয়নি।
ঋণ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি, কিছু প্রতিষ্ঠানের হিসাবের নমুনা স্বাক্ষর কার্ড পাওয়া যায়নি। এছাড়া শাখা ব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় দেয়া ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করে এমডির পদে থেকে পুনঃতফসিল করেছেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। এসব কারণে পরিদর্শনের রিপোর্ট ইতিমধ্যে দুদকে পাঠানো হয়েছে। তবে পুনঃতফসিলে তার হাত নেই বলে জানান আব্দুছ ছালাম আজাদ।
অ্যাকাউন্টে জালিয়াতি: বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুসারে এনন টেক্স গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান সিমি নিট টেক্স লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২৫৩ কোটি টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক।
ব্যাংকের ১৭১তম বোর্ড সভায় প্রকল্প স্থাপনের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০:৪০ অনুপাতে ৯৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে বৈদেশিক যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১ কোটি ৪৮ লাখ ইউএস ডলারের ঋণপত্র খোলার অনুমোদন দেন তৎকালীন শাখা ম্যানেজার মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ।
এক্ষেত্রে মেশিনারিজ সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির তিনটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হল- ওয়াইসুক ওভারসিস, ইউনিভার্সেল টেকনোলজিক্যাল লিমিটেড এবং ইউনি এশিয়া অ্যাসোসিয়েশটস। কিন্তু প্রাইম ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ইউনূস বাদল নিজেই ইউনিভার্সেল টেকনোলজিক্যাল লিমিটেডের মালিক। প্রাইম ব্যাংকে এই প্রতিষ্ঠানের একটি হিসাবে রয়েছে। যার নম্বর ১৫৯১১০৮০০০৬৩৭২।
অর্থাৎ নিজেই পণ্যের আমদানিকারক আবার রফতানিকারকও। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রাইম ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ওয়াইসুক ওভারসিস মালিক ইউনূস বাদল। আবার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের তথ্য অনুসারে একই কোম্পানির মালিক এনন টেক্সের বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক মো. কবির হোসেন।
এই কোম্পানির নামে ১ হাজার ৭২ কোটি ৭২ লাখ টাকা বের করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাইম ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ইউনি এশিয়া অ্যাসোসিয়েটসের মালিক ইউনূস বাদলের স্ত্রী জামিলা আক্তার সীমা এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়ালের তথ্য অনুসারে ওই কোম্পানির মালিক কবির হোসেন। পে-অর্ডারের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানকে ১৫১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির সঙ্গে এই কোম্পানির কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ নিজেরাই আমদানিকারক তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। অন্যদিকে পণ্য বাংলাদেশে আসার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এসব কাজ বড় ধরনের অপরাধ।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়ম এবং মুদ্রাপাচারের অকাট্য প্রমাণ থাকলে তাকে অপসারণের সুযোগ আছে।
কারণ তার নৈতিক স্খলন ঘটেছে। আর একজন ব্যাংকার বা এমডির নৈতিক স্খলন ঘটলে তিনি আর স্বপদে বহাল থাকতে পারেন না। তবে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে অপসারণ করতে চাইলেও পারবে না। কারণ তারা শুধু সুপারিশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাওয়াটাই মুখ্য।
যাদের কারণে আজ ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা, সুশাসনের ঘাটতি; তাদের উল্লেখযোগ্য একজন হলেন জনতার বর্তমান এমডি। এখন চাইলে তাকে অপসারণ করতে পারে সরকার। এতে প্রমাণ হবে সরকার সুশাসনের পক্ষে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিতে সরকারের কোনো আন্তরিকতার ঘাটতি বা সদিচ্ছার অভাব নেই। একই সঙ্গে তার অপসারণ কার্যকর করলে ব্যাংকের ওপর মানুষেরও আস্থা বাড়বে।
কোম্পানি ভিন্ন তথ্য একই: মো. আব্দুছ ছালাম আজাদের সহযোগিতায় এনন টেক্সের মোট ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। বিভিন্ন নামে এবং আলাদা মালিকানায় এসব কোম্পানি নিবন্ধিত। কিন্তু কোম্পানির ঠিকানা, ওয়েবসাইট এবং ই-মেইল আইডিতে একই। কিন্তু এসব কিছু যাছাই না করে ঋণ দিয়েছে ব্যাংক।
জালিয়াতিতে এমডি জড়িত: একটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের তথ্য যাছাই, জামানতের সম্পদের মূল্যায়ন এবং ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়া মূলত ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকেই করা হয়। বড় ঋণের অনুমোদন দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে। অনুমোদনের পর বিতরণ ও পরিবীক্ষণও করে শাখা অফিস।
এনন টেক্সের ঋণ বিতরণের সময় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ছিলেন মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। এসব অনুমোদনের ব্যাপারে তিনি প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করেছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া তিনটি ভুয়া রফতানি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এলসির অর্থছাড়ের অনুমোদন করেন তিনি। এক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে অর্থছাড় করেছেন। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, এলসির বিপরীতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট সি ইন্টারন্যাশনালের কাছে হস্তান্তর করার এখতিয়ার প্রধান কার্যালয়ের আওতাভুক্ত।
কিন্তু এনন টেক্সের ক্ষেত্রে শাখার ম্যানেজার মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ আমদানির ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধের অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে নিয়মের তোয়াক্কা করেননি তিনি। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, এই অনুমোদনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের অর্থ গ্রাহককে বের করে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। ভুয়া আমদানির নামে বের করে নেয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পান আব্দুছ ছালাম আজাদ।
বর্তমানে তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এছাড়া রিপোর্টে জালিয়াতির সহযোগিতার জন্য যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- ব্যাংকের তৎকালীন আরও দুই কর্মকর্তার নাম আসে । এদের একজন ম্যানেজার অপরজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক।
অপসারণ: নিয়ম অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডিকে অপসারণের ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুধু সুপারিশ করা হয়। জনতা ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিদর্শন কমিটির রিপোর্টের আলোকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। আর এটি চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার জন্য ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। এর আগে জালিয়াতির দায়ে বেসিক ব্যাংকের এমডি কাজী ফকরুল ইসলাম ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করা হয়।
এমডির পরিচিতি: ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুছ ছালাম আজাদ। এর আগে তিনি একই ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তারও আগে তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৮৩ সালে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকে ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। জনতা কর্পোরেট ভবন, কামাল আতাতুর্ক শাখার প্রধানসহ বিভিন্ন শাখায় দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া তিনি প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখা ও ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবদুছ ছালাম আজাদ ১৯৫৮ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। (দৈনিক যুগান্তর)