নিউইয়র্ক ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

উপকূলবাসীদের কাছে আতঙ্কের মাস ‘নভেম্বর’

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:০২:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০১৯
  • / ২৬৪ বার পঠিত

শফিকুল ইসলাম ইরান, বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি: উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা উপজেলা বেতাগী। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে চরম আতঙ্কে বিষখালী নদী পাড়ের মানুষ। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ। আর নভেম্বর মাস আসলেই আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী। তাদের কাছে নভেম্বর মানেই এক আতঙ্কের নাম।

জানা গেছে, ১৯০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসেই মোট ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, বন্য ও গৃহপালিত পশুর মৃত্যু ও সম্পদহানী ঘটে। এর মধ্যে ‘বুলবুল’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের তথ্যেও বেশ আতঙ্কিত ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমপি) দুর্যোগ কোষ থেকে বিগত বছরগুলোর মধ্যে শুধু নভেম্বর মাসের সংগঠিত ঘূর্ণিঝড় গুলো হচ্ছে:
সাল ১৯০৪ নভেম্বর: সোনাদিয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু এবং বহু মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সেই সঙ্গে বিষখালি নদীতে বিলীন হয় অর্ধশত বসতবাড়ি।
সাল ১৯৭০ হারিকেন (১১-১৩ নভেম্বর): সারাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচন্ড বাতাস দুদিন ধরে বার বার আঘাত হানে চট্টগ্রামে এবং সেই সঙ্গে বরগুনার বেতাগীসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা-জেলা শহরেও ব্যাপক তান্ডব চলে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক প্রাণহানি, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয়। সারাদেশের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এই দুর্যোগে দেশের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিলো। ৩৫ হাজার হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭২ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও জানা যায়, উপকূলসহ সারাদেশে এর মধ্যে ৪০ হাজারের ও বেশি অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে সমুদ্র ও বড় নদীতে মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করে। মোট ২০ সহ¯্রাধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণও ছিল বেশ। লাখ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। চার লাখ ঘরবাড়ি এবং তিন হাজারের ও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংগঠিত হওয়ায় প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। হারিকেন নামক এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মি.।
সাল ১৯৭১ (৫-৬ নভেম্বর): চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে (ক্ষয় ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি)। বেতাগীর চরখালি ও মাছুয়াখালীতে ব্যাপক গবাদি পশু মারা যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাল ১৯৭১ (২৮-৩০ নভেম্বর): বরগুনা জেলাসহ সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৫-১১৩ কিলোমিটার বায়ু প্রবাহ ও ১-২ মি. কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসহ ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। এছাড়াও সমগ্র খুলনা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করে এবং খুলনা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
সাল ১৯৭৪ (২৪-২৮ নভেম্বর): বরগুনা জেলার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা এবং কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ সমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও ৩-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। প্রায় ২ শতাধিক মানুষ ও প্রায় ১ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয় এবং ২ হাজারের ও বেশি ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।
সাল ১৯৮৩ (৫-৬ নভেম্বর): প্রতি ঘণ্টায় ১৩৬ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহ ও ২মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বেতাগী, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। অর্ধশত নৌকা ও তিন শতাধিক মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয় একইসঙ্গে। ধ্বংস হয় দুই হাজার বসতবাড়ি।
সাল ১৯৮৬ (৮-৯ নভেম্বর): উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনা, বেতাগী বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পরে। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিলোমিটার, খুলনায় ৯০ কিলোমিটার, বরিশালে ৮০ কিলোমিটার। এতে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৭ হাজার ২০০ হেক্টর ফসলি জমি বিনষ্ট হয়।
সাল ১৯৮৮ (২৪-৩০ নভেম্বর): বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনাসহ উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছাস হয়। এতে ৫ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫ হাজার গবাদি পশু মারা যায়। বহু সংখ্যক বন্য পশু মারা যায়। তার মধ্যে ছিল হরিণ ১৫ হাজার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯টি এবং ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় শত কোটি টাকার।
সাল ১৯৯৫ (২১-২৫ নভেম্বর): উপকূলবর্তী দ্বীপ সমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭ হাজার গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে। একইসঙ্গে বরগুনার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রে যাওয়া জেলে নিখোঁজসহ ব্যাপক সম্পদ বিনষ্ট হয়।
সাল ২০০৭ সিডর (১৫ নভেম্বর): প্রলয়ঙ্করী সুপার সাইক্লোন। ঠিক ১২ বছর পূর্বে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। এক যুগ অতিক্রম হলেও সেই আতঙ্ক এখনো ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ। বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী বরগুনা, বেতাগী, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলা এই সুপার সাইক্লোন সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অনন্য জেলাগুলো হচ্ছে, ঝালকাঠি, বরিশাল ও ভোলা, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী সাইক্লোন সিডরের কারণে সারাদেশে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক মারা যায়, নিখোঁজ হয় ১ হাজার ৩ জন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ধ্বংস হয় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি, দুই লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। মারা যায় সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক প্রাণী। সিডরের তান্ডবে বেতাগীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় প্রায় অর্ধশত গ্রাম। এ সময় সদর ও লক্ষীপুরায় ঘরবাড়ি এবং গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। উপজেলার মোকামিয়া, চরখ, মাছুয়াখালিতে ব্যাপক সম্পদহানী হয়, বিনষ্ট হয় ঘরবাড়ি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আজও ক্ষোভ সিডরের পর দীর্ঘসময় অতিক্রম হলেও সংস্কার হয়নি বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধটি। পাশাপাশি এসব এলাকায় নির্মাণ হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। এখনো একের পর এক দুর্যোগের কথা শুনলেই আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করেন উপকূলবাসী।
সাল ২০১৯ (৯ নভেম্বর): আলোচিত ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। চলতি বছরের গত ৯ নভেম্বর থেকে আলোচিত ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ বেতাগীতে তেমন কোনো ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া না গেলেও বিগত দিনগুলো স্মৃতিচারণ করে আতঙ্কিত ছিল বিষখালি নদী পাড়ের মানুষ।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বেতাগী উপজেলা প্রশাসন সহ নানা ধরণের সহযোগী সংগঠনের ছিল সর্তকতামূলক নানা ব্যবস্থাপনা। উপজেলার ১টি পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে আসা জনসাধারণের জন্য ছিল শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
বেতাগী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, পিছনের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করেই ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় ব্যাপক সর্তকতা অবলম্বন করেছি। তিনি আরও বলেন, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তবে এই প্রথম ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো সত্তে¡ও কোনো ধরণের মারাত্মক দুর্ঘটনা কিংবা সম্পদ বিনষ্ট হয়নি।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিব আহসান বলেন, বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেতাগী উপজেলাসহ উপকূলবাসীর জন্য নভেম্বর একটি আতঙ্কের মাস। এ জন্যই ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় আমাদের উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক সর্তক ছিল। কেননা সারা দেশের ইতিহাসে সব বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই নভেম্বর মাসেই সংগঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

উপকূলবাসীদের কাছে আতঙ্কের মাস ‘নভেম্বর’

প্রকাশের সময় : ০১:০২:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০১৯

শফিকুল ইসলাম ইরান, বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি: উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা উপজেলা বেতাগী। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে চরম আতঙ্কে বিষখালী নদী পাড়ের মানুষ। বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ। আর নভেম্বর মাস আসলেই আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী। তাদের কাছে নভেম্বর মানেই এক আতঙ্কের নাম।

জানা গেছে, ১৯০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসেই মোট ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, বন্য ও গৃহপালিত পশুর মৃত্যু ও সম্পদহানী ঘটে। এর মধ্যে ‘বুলবুল’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের তথ্যেও বেশ আতঙ্কিত ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমপি) দুর্যোগ কোষ থেকে বিগত বছরগুলোর মধ্যে শুধু নভেম্বর মাসের সংগঠিত ঘূর্ণিঝড় গুলো হচ্ছে:
সাল ১৯০৪ নভেম্বর: সোনাদিয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু এবং বহু মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সেই সঙ্গে বিষখালি নদীতে বিলীন হয় অর্ধশত বসতবাড়ি।
সাল ১৯৭০ হারিকেন (১১-১৩ নভেম্বর): সারাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্টকারী ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। হারিকেনের তীব্রতা নিয়ে প্রচন্ড বাতাস দুদিন ধরে বার বার আঘাত হানে চট্টগ্রামে এবং সেই সঙ্গে বরগুনার বেতাগীসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা-জেলা শহরেও ব্যাপক তান্ডব চলে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক প্রাণহানি, সম্পদ ও ফসলের ধ্বংস সাধন হয়। সারাদেশের সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এই দুর্যোগে দেশের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিলো। ৩৫ হাজার হাজার সমুদ্রনির্ভর মৎস্যজীবী ও ৭২ হাজার অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও জানা যায়, উপকূলসহ সারাদেশে এর মধ্যে ৪০ হাজারের ও বেশি অভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবী ঘূর্ণিঝড় চলাকালে সমুদ্র ও বড় নদীতে মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করে। মোট ২০ সহ¯্রাধিক মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়। সম্পদ ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণও ছিল বেশ। লাখ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। চার লাখ ঘরবাড়ি এবং তিন হাজারের ও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রে ভরা জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড়টি সংগঠিত হওয়ায় প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। হারিকেন নামক এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৬ মি.।
সাল ১৯৭১ (৫-৬ নভেম্বর): চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে (ক্ষয় ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি)। বেতাগীর চরখালি ও মাছুয়াখালীতে ব্যাপক গবাদি পশু মারা যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাল ১৯৭১ (২৮-৩০ নভেম্বর): বরগুনা জেলাসহ সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ৯৫-১১৩ কিলোমিটার বায়ু প্রবাহ ও ১-২ মি. কম উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসহ ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হয়। এছাড়াও সমগ্র খুলনা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করে এবং খুলনা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
সাল ১৯৭৪ (২৪-২৮ নভেম্বর): বরগুনা জেলার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা এবং কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ সমূহে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও ৩-৫.২ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। প্রায় ২ শতাধিক মানুষ ও প্রায় ১ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয় এবং ২ হাজারের ও বেশি ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়।
সাল ১৯৮৩ (৫-৬ নভেম্বর): প্রতি ঘণ্টায় ১৩৬ কি.মি. বেগে বায়ু প্রবাহ ও ২মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বেতাগী, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার উপকূল ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। অর্ধশত নৌকা ও তিন শতাধিক মৎস্যজীবী নিখোঁজ হয় একইসঙ্গে। ধ্বংস হয় দুই হাজার বসতবাড়ি।
সাল ১৯৮৬ (৮-৯ নভেম্বর): উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনা, বেতাগী বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর চরাঞ্চল ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পরে। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১০ কিলোমিটার, খুলনায় ৯০ কিলোমিটার, বরিশালে ৮০ কিলোমিটার। এতে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৯৭ হাজার ২০০ হেক্টর ফসলি জমি বিনষ্ট হয়।
সাল ১৯৮৮ (২৪-৩০ নভেম্বর): বরিশাল, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, খুলনাসহ উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। মংলায় চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু জলোচ্ছাস হয়। এতে ৫ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হয় এবং ৬৫ হাজার গবাদি পশু মারা যায়। বহু সংখ্যক বন্য পশু মারা যায়। তার মধ্যে ছিল হরিণ ১৫ হাজার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯টি এবং ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় শত কোটি টাকার।
সাল ১৯৯৫ (২১-২৫ নভেম্বর): উপকূলবর্তী দ্বীপ সমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার বেগে বায়ু প্রবাহসহ তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যু ও ১৭ হাজার গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটে। একইসঙ্গে বরগুনার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রে যাওয়া জেলে নিখোঁজসহ ব্যাপক সম্পদ বিনষ্ট হয়।
সাল ২০০৭ সিডর (১৫ নভেম্বর): প্রলয়ঙ্করী সুপার সাইক্লোন। ঠিক ১২ বছর পূর্বে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। এক যুগ অতিক্রম হলেও সেই আতঙ্ক এখনো ভুলতে পারেনি উপকূলের মানুষ। বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী বরগুনা, বেতাগী, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলা এই সুপার সাইক্লোন সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অনন্য জেলাগুলো হচ্ছে, ঝালকাঠি, বরিশাল ও ভোলা, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী সাইক্লোন সিডরের কারণে সারাদেশে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক মারা যায়, নিখোঁজ হয় ১ হাজার ৩ জন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। ধ্বংস হয় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি, দুই লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। মারা যায় সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক প্রাণী। সিডরের তান্ডবে বেতাগীতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় প্রায় অর্ধশত গ্রাম। এ সময় সদর ও লক্ষীপুরায় ঘরবাড়ি এবং গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। উপজেলার মোকামিয়া, চরখ, মাছুয়াখালিতে ব্যাপক সম্পদহানী হয়, বিনষ্ট হয় ঘরবাড়ি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আজও ক্ষোভ সিডরের পর দীর্ঘসময় অতিক্রম হলেও সংস্কার হয়নি বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধটি। পাশাপাশি এসব এলাকায় নির্মাণ হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। এখনো একের পর এক দুর্যোগের কথা শুনলেই আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করেন উপকূলবাসী।
সাল ২০১৯ (৯ নভেম্বর): আলোচিত ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। চলতি বছরের গত ৯ নভেম্বর থেকে আলোচিত ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ বেতাগীতে তেমন কোনো ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া না গেলেও বিগত দিনগুলো স্মৃতিচারণ করে আতঙ্কিত ছিল বিষখালি নদী পাড়ের মানুষ।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বেতাগী উপজেলা প্রশাসন সহ নানা ধরণের সহযোগী সংগঠনের ছিল সর্তকতামূলক নানা ব্যবস্থাপনা। উপজেলার ১টি পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে আসা জনসাধারণের জন্য ছিল শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
বেতাগী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, পিছনের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করেই ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় ব্যাপক সর্তকতা অবলম্বন করেছি। তিনি আরও বলেন, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তবে এই প্রথম ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো সত্তে¡ও কোনো ধরণের মারাত্মক দুর্ঘটনা কিংবা সম্পদ বিনষ্ট হয়নি।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিব আহসান বলেন, বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেতাগী উপজেলাসহ উপকূলবাসীর জন্য নভেম্বর একটি আতঙ্কের মাস। এ জন্যই ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ মোকাবেলায় আমাদের উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক সর্তক ছিল। কেননা সারা দেশের ইতিহাসে সব বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই নভেম্বর মাসেই সংগঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (যুগান্তর)