নিউজার্সীতে শামসুল আরেফীনের লেখালেখি ও বই পর্যালোচনা
- প্রকাশের সময় : ০৬:৩১:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৯
- / ৩৩৪ বার পঠিত
বিশেষ প্রতিনিধি: দেওয়ান শামসুল আরেফীন একজন সমাজবিজ্ঞানী। নিউজার্সির রাটগার্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ব বিভাগের শিক্ষক। রাজনৈতিক বিশ্লেষক। একজন বিশিষ্ট লেখক। অভিবাসী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও রয়েছে তার নিবিড় সম্পর্ক। সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখেন এবং সেসব লেখা প্রকাশ করেন বই আকারে। এ পর্যন্ত তার প্রায় দশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক প্রিয় এসব বইয়ের সিংহভাগ লেখাই সাপ্তাহিক বাংলাদেশ এর “প্রসঙ্গে- প্রসঙ্গান্তরে” কলাম এবং সাপ্তাহিক ঠিকানায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। তিন যুগেরও অধিক সময় নিউজার্সিতে বসবাসকারী দেওয়ান শামসুল আরেফীনের লেখা প্রবাস এবং দেশে পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নকালেই লেখালেখিতে তার হাতেখড়ি। শিক্ষাজীবন শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। অতপর উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। নূতন করে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হলেও থেমে থাকেনি তার লেখালেখি। এভাবেই গড়িয়ে গেছে অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময়। দেওয়ান শামসুল আরেফীনের লেখালেখির ৫৫ বছর ও সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত তার দু’টি বই ‘ওবামা’ এবং ‘নেলসন ম্যান্ডেলা এবং সন্ত্রান্স ও শান্তি’ এর উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ২০ অক্টোবর রোববার অপরাহ্নে নিউজার্সির পিসক্যাটাওয়ে শহরের জন এফ কেনেডি লাইব্রেরী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাংলাদেশী রোডিস স্কলার ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান ও লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে ডা. ওয়াজেদ এ খান দেওয়ান শামসুল আরেফীনের লেখালেখির ৫৫ বছর এবং তার লেখা “নেলসন ম্যান্ডেলা এবং সন্ত্রাস ও শান্তি” বইটির উপর আলোচনা করেন।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী আলোচনায় অংশ নেন ‘ওবামা’ গ্রন্থটির উপর।
ভিন্নধর্মী এ গ্রন্থ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের অধ্যাপক ড. জাহিদ হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত কাজী আফজালুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, বগুড়ার সাবেক মহাপরিচালক ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক সদস্য কে, এম, এস, এ কায়সার, রাটগার্টস ইউনিভার্সিটির বিজনেস ও ইকোনমিক্স এর অধ্যাপক ড. মাহমুদ হাসান ও লেখিকা মিসেস সেলিনা আকতার। হিমুর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দেওয়ান শামসুল আরিফীন।
লেখক তার বক্তব্যে লেখালেখির শুরুর দিকের স্মৃতিচারণ করেন। তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেরও আগে কলেজ জীবনের লেখালেখির প্রসঙ্গ। স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশে লন্ডন ‘জনমত’র বাংলাদেশে সহোদর প্রকাশনা ‘জনমত’ এ কার্যকরী সম্পাদক এবং ‘চরমপত্র’র সম্পাদনা পরিষদ সহ অন্যান্য সাময়িকীর সম্পাদক ও সংশ্লিষ্টতার কথা। এজন্য তাকে অনেক সময় প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে জানান শামসুল আরেফীন। তার বইগুলো প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
বইয়ের উপর পর্যালোচনা করতে গিয়ে বক্তাগণ দেওয়ান শামসুল আরেফীনকে একজন সফল লেখক হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, লেখকের জীবনের শুরু যে চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় ধরে তা তিনি সযতেœ ধরে রেখেছেন। ছাত্র জীবনে বামধারার রাজনীতির সাথে তার যে সম্পৃক্ততা ছিলো। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী যে আদর্শ তার মননে স্থান করে নিয়েছিলো। তার লেখনিতে বার বার তা উঠে এসেছে। পাকিস্তান আমলে ছাত্রজীবনে তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বৈষম্যহীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তাকে ‘চরমপত্র’র মতো পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদে কাজ করতে হয় বলে মন্তব্য করেন বক্তাগণ। সমাজবিজ্ঞানী হলেও শামসুল আরেফীনের লেখনীর সিংহভাগ জুড়ে আছে রাষ্ট্র ও এদেশের রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষন। তার লেখাগুলো আমেরিকার সমাজ ও রাজনীতি নির্ভর। তারপরও তিনি ভুলে যাননি বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি, চলমান সমস্যা ও এসবের ভয়াবহতা সম্পর্কেও তার লেখায় ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
দেশে দেশে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতিবিদরা কিভাবে সন্ত্রাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন ‘নেলসন ম্যান্ডেলা এবং সন্ত্রাস ও শান্তি’ এবং ‘মুনাফার সন্ত্রাস’ বইয়ে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন লেখক। দেওয়ান শামসুল আরেফীন সমাজ এবং রাষ্ট্রকে যে মাত্রা ও আঙ্গিকে দেখতে চান তার লেখনিতে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বলে মন্তব্য করেন আলোচকবৃন্দ। তিনি আমেরিকা এবং গোটা বিশ্বকে স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ঘটনার পরম্পরায় বিশ্লেষণ করেন। অনুসন্ধান করেন পেছনের কারণ সমুহ। প্রতিকারের পথ দেখাতে চেষ্টা করেন। সমসাময়িক প্রসঙ্গ এবং নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ তার বইগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট। আলোচকগণ মনে করেন দেওয়ান শামসুল আরেফীন লেখনীর মধ্য দিয়ে অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন এ সমাজে।
দেওয়ান শামসুল আরেফীনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ (১) ওবামা (২) নেলসন ম্যান্ডেলা এবং সন্ত্রাস ও শান্তি (৩) ডানের শত্রæ সত্য বামের শত্রæ সত্য-সত্যের মিত্র কে? (৪) মুনাফার সন্ত্রাস (৫) লাইফ এন্ড ডেট নো ফ্রিডম ইয়েট (৬) ফ্রোর্টেস আমেরিকা-বøু-স্কার্ট ডি কন্সট্রাকশনের গেøাবালাইজেশন (৭) তৃতীয় বিশ্বে পাতি বুর্জোয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (৮) রিপ্রেশন ইন মার্কস-ওয়েবার এন্ড ফ্রিউড (৯) ভাসানী দ্যা মওলানা ভাসানী দ্যা কমরেড। এছাড়া তার অনুবাদ গ্রন্থ ‘টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার দ্যা জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’ পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছে। দেওয়ান শামসুল আরেফীন নিউজার্সী এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দেশ এবং আন্তর্জাতিক আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে প্রগতিশীল ত্রৈমাসিক ‘দি টারগাম’ এবং দি লিভিংস্টন’র নিবন্ধকার। তার অনুদিত মায়া এঞ্জেল্যু, ল্যাংস্টন হিউগস, তানুর ওহিদা প্রমুখের কবিতা বাংলাদেশের বিচিত্রাসহ আমেরিকায় অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘আমার দেশ’ এ প্রকাশিত হয়েছে। দেশে থাকাকালীন তিনি সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ক সাময়িকী ‘স্বপক্ষে’ এর ছিলেন প্রধান সম্পাদক। দি মিশনের সহযোগী সম্পাদক এবং কবিতা সংকলন ‘কাক’ এবং ‘কৌনিক’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন দেওয়ান শামসুল আরেফীন। শুধু সাহিত্য নয় সামাজিক ক্ষেত্রে তার রয়েছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউজার্সীর সভাপতি ছিলেন তিনবার। ফোবানা অষ্টম এবং ১০ম সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন দেওয়ান শামসুল আরেফিন। লেখালেখির ৫৫ বছরে তার মেয়ে তন্মী, জামাতা মার্সেল নাতনি জেইন এবং সাদিয়া শুভেচ্ছা জানান।
লেখালেখির জন্য তাকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ ও সাপ্তাহিক ঠিকানার পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত বইয়ের বিক্রয়কৃত অর্থ তিনি দান করে দেয়ার ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে দোয়া মুনাজাত পরিচালনা করেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। দেওয়ান শামসুল আরেফীনের সতীর্থ বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সালাউদ্দিন জাকি অনুষ্ঠান উপলক্ষে লেখককে একটি পত্র পাঠিয়েছেন। লেখকের ডাক নাম -বাদল। জাকি তাকে এই নামে সম্বোধন করে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। অনুষ্ঠানে পত্রটি পাঠ করেন খন্দকার আনোয়ার। প্রতিকূল আবহাওয়া সত্তে¡ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।