সব মানুষ হৃদয়হীন নয়। সব পুরুষ সমান নয়!
- প্রকাশের সময় : ০৫:০৩:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯
- / ৫০০ বার পঠিত
সুলতানা রহমান: আজ আমি আমার এক বন্ধু আর এক ছোট ভাইয়ের গল্প বলবো। তাদের দু’জনের সঙ্গেই প্রথম পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথমে বলি সহপাঠী বন্ধুটির গল্প। ধরা যাক বন্ধুটির নাম…..ক। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে থেকেই নিজ এলাকার এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার। কারণে অকারণে সে হুটহাট বাড়ি চলে যেতো। তার মন পরে থাকতো সেখানেই-মেয়েটির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে তারা মহা ধুমধামে বিয়ে করে। মাইক্রোবাস ভাড়া করে বন্ধুরা মিলে হৈহুল্লোর করে তার বিয়ে খাওয়া হলো। তখন আমাদের বয়সটাই এমন যে যার ক্যারিয়ার সংসার নতুন নতুন সবে শুরু করেছে। সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আড্ডবাজী কমে গেছে। আর হঠাৎ হঠাৎ আড্ডায় দু’ একবার দেখা হলেও বুঝতে পারিনি আড্ডা জমিয়ে রাখা বন্ধুর হাসিমুখ ক্রমশই মলিন হচ্ছে। ২০০৪/৫ সালের দিকে বন্ধুটি সপরিবারে অ্যামেরিকা পাড়ি জমায়। ফেসবুকের কল্যানে যোগাযোগ থাকলেও ওর সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না। আর ফেসবুকের দুনিয়ায় সবার জীবনে সুখের ছড়াছড়ি দেখে কারো ধরার জীবনে কষ্টের কথা অনুমান করাটাও কঠিন। অ্যামেরিকা প্রবাসী বন্ধুটির ‘না-জানি’ কত সুখের জীবন! এমন ভাবনা অমূলক নয়। বছর তিনেক আগে আমি অ্যামেরিকা আসর পর তার সঙ্গে আবার নিয়মিত যোগযোগ। একটা ছেলে তার। বিদেশের নতুন জীবনে বন্ধুটি আমায় কতভাবে যে সাহায্য করেছে! সবচেয়ে ভালোলাগা ছিলো-বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরন্ত দিনগুলোকে গল্পে গল্পে নতুন করে নিয়ে আসা, কেবল ওই দিনগুলোই সুখের মতো যাবতীয় যাতনা ভুলিয়ে দেয়। যে বন্ধুটি আমার অজানা অচেনা দুনিয়ায় যেকোনও বিপদে আপদে আপন জনের মতোই পাশে থাকে- সেই বন্ধুর স্ত্রী এবং ছেলেটিকে তখনো আমি দেখিনি। প্রায়ই নিয়ে আসতে বলি। কথা দিয়েও কথা রাখেনা। একদিন ওর স্ত্রী এবং ছেলের জন্য কিছু গিফট দিলাম। বন্ধুটি নিতে চাইলো না। আমি সাংঘাতিক বিষ্মিত হলাম। কারণ জানতে আমি নাছোড়বান্দা। শেষমেষ নিরুপায় হয়ে বললো- এগুলো বাসায় নিয়ে গেলে চরম অশান্তিতে পরবো। কে দিছে, কেন দিছে, কেন দিবে- হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েও বোঝাতে পারবোনা একজন বন্ধ,ু আরেক বন্ধুকে কারণ ছাড়াই দিতে পারে। বন্ধুটি আরো বললো- তুই কত দিন ধরে নিয়ে নিউইয়র্কে আছিস, কখনোই তোকে বাসায় নিতে পারিনি। কি অশান্তি নিয়ে থাকি বুঝবিনা!
তারপর ধীরে ধীরে জানলাম-অ্যামেরিকা আসার আগে থেকেই বউটি ওর বাবামাকে সহ্য করতে পারতোনা। বাবামার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের ছাড়াও ওর পক্ষে থাকা সম্ভব না। এরমধ্যে ডিভি লটারী জিতে যাওয়ায় পালানোর একটা পথ পায়। বউ নিয়ে প্রথমে নিউইয়র্ক আসে। এখানে বউয়ের ভালো লাগেনা। আবহাওয়া বদলালে ভালো লাগতে পারে ভেবে চলে গেলো অন্য স্টেইটে। এভাবে আরো ৩/৪টা স্টেইটে বসবাসের চেষ্টা করে আবার আসে নিউইয়র্ক। কোথাওই বউয়ের মন বসেনা। সবাই বললো বাচ্চা নিতে- সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাও হলো কিন্তু অবস্থা হলো আরো খারাপ। প্রায়ই আত্বহত্যার চেষ্টা করে। এবার যাওয়ার হলো মানসিক চিকিৎসকের কাছে। ডাক্তার জানালো ডিপ্রেসনের কথা। বিষন্নতার কারণে সে কোনও মানুষই সহ্য করতে পারেনা। সন্দেহপ্রবণ।
১০/১২ বছর ধরে অ্যামেরিকায় থেকেও বারবার স্থান বদল করার কারণে বন্ধুটি জীবনে খুব বেশি স্বচ্ছলতা আনতে পারেনি। তবু বউয়ের মন ভালো রাখতে নিউইয়র্কে এক বেড রুমের বাসা বদলিয়ে দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া নিলো। ছেলেটি ছোট হওয়ায় বাবা-মা’র সঙ্গেই থাকে, কিন্তু আরেকটি বেডরুমে কোনও বেড রাখা যাবে না। যদি কোনও মেহমান আসে সেই ভয়ে। বউ যা বলে তা-ই সই। তবু তার মন ভালো হয় না। কিছুতেই সন্তুষ্টি আসে না। ভাবলো চাকরি করলে ভালো থাকতে পারে। সেখানেও মন বসাতে পারেনি। ডাক্তারের পরামর্শে আবার নিউইয়র্ক ছেড়ে অন্য স্টেইটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্ধুটি।
পুরো গল্পটি খুব মন দিয়ে শুনে আমি জানতে চাইলাম- তুই বউকে টাকা-পয়সা দিস? বললো যখন যা দরকার সবই তো করি। আমি আবারও জোর দিলাম-সংসারের প্রয়োজনের বাইরেও তার যেকোনও কিছুর ইচ্ছে হতে পারে, তারও একটা হাত খরচের দরকার আছে। যে খরচের কোনও কৈফিয়ত কাউকে দিতে হবেনা!
বন্ধু নেতিবাচক ভাবে মাথা নেড়ে জানালো-ওর যখন যা দরকার সবই আমি করি! আমার বাবা-মাকে টাকা পাঠালেই ওর মাথা নষ্ট হয়ে যায়। সেকারণে ওকে আমি সব কিছু জানাইও না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাঙ্গন পছন্দ করিনা। অনেকেই সমস্যার সমাধান খোঁজে ডিভোর্সে। যেকোনও সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা খুব সহজ। পৃথিবীতে সব মানুষেরই কিছু না কিছু সমস্যা আছে। সমস্যা ছাড়া জীবন হয়না। এক আগুন থেকে আরেক আগুনে ঝাপ দেয়ার মধ্যে আমি সমাধান দেখিনা। আর সন্তান থাকলে তো কথা-ই নেই। বাবা-মা হয়ে ওঠা অতো সহজ নয়। আর জীবনের সুখ দুখ ভাগাভাগী করে নেয়ার জন্যই মানুষ বিয়ে করে। অনেকে অবশ্য শুধুই সঙ্গী বেছে নেয় নানান রকম হিসেব কষে, এক সঙ্গে থাকার পর সঙ্গীর সমস্যা দেখলে পালিয়ে যায়। এমন দম্পতি আর দাম্পত্যের কোন মানে হয়না। আমার বন্ধুটিও আমার সঙ্গে একমত। বললো- ‘হোক মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, তবু সে মা। দু’জনকেই ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। বউকে ভালো রাখতে পারলে সন্তানও ভালো থাকবে। আর মা পাশে আছে, কাছে আছে- একটি শিশুর জন্য এ এক বিরাট শক্তি।’ বন্ধুটির জন্য আমার অনেক মায়া হলো, ভালোও লাগলো। এতো দায়িত্বশীল আমার বন্ধু!
বউকে ভালো রাখার সব চেষ্টায় ব্যর্থ, ক্লান্ত বন্ধুকে আমি পরামর্শ দিলাম- ওর উপার্জন বউয়ের হাতে দিয়ে দিতে। নজরদারীতে রেখে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তত এক দুই মাস চেষ্টা করে দেখতে সে কিভাবে সংসার চালায়। কেন জানিনা বন্ধুটি এতে রাজী হলো না!
একই ধরণের সমস্যায় আক্রান্ত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাইটি। বন্ধুটির চেয়ে ওর অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। সে-ও নিউইয়র্কে থাকে, স্ত্রী সন্তানসহ। তার স্ত্রী বাইপোলার। অসংখ্যবার আতœহত্যার চেষ্টা করেছে। ভারসাম্যহীনতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। সামারে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন কাটালেও শীতকালটা চরম বিষন্নতায় কাটে। সেসময় অবস্থা এমন হয় ভাইটি বাসায় না থাকলেও শিশুকন্যাটি বাথরুমের সিটকিনি বন্ধ করে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে বাবাকে ফোন দেয়। যে অবস্থাতেই থাকুক সে ঘরে ছুটে যায়। আমার একবার সেরকম অবস্থা দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো। মেয়েটি বাথরুমে বসে ভয়ার্ত গলায় ফোন করে কাঁদছিলো। টেলিফোনের ওই প্রান্ত থেকে মেয়েটির কান্না আর ভাঙচুরের শব্দে আমি দিশেহারা বোধ করেছিলাম। ভাইটিকে বললাম- তুমি না হয় সহ্য করো, কিন্তু বাচ্চাটার জন্য তো এ এক ভয়াবহ ট্রমা। অসুস্থ পরিবেশে বাচ্চাটাও অসুস্থ হয়ে যাবে! এই সম্পর্ক থেকে বের হও।
আমার কথা শুনে ভাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। বললো- আপা ওকে তো আমি ভালোবাসি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় আমার সন্তানের মা। অসুস্থ দেখে তাকে ছেড়ে যাবো? আমার বাবা-মা যদি অসুস্থ হতো, তাদের কি ছাড়তে পারতাম? কিংবা আমি নিজে যদি এই রোগে আক্রান্ত হতাম-আর আমার বউ যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতো- আমার অনেক কষ্ট হতো। তার এই আবেগী কথার পিঠে আমার বলার মতো কোনও কথা ছিলোনা। কারণ আমি জানি- সব মানুষ হৃদয়হীন নয়। সব পুরুষ সমান নয়!